ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাটপণ্যের তীর্থ কেন্দ্র হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৮ আগস্ট ২০১৬

পাটপণ্যের তীর্থ কেন্দ্র হচ্ছে

কাওসার রহমান ॥ বহুমুখী পাটপণ্যের তীর্থ কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার। সব ধরনের সেবা একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে এ কেন্দ্রে গড়ে তোলা হচ্ছে উদ্যোক্তাদের বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রির কেন্দ্রীয় সেলস সেন্টার। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হচ্ছে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। উদ্যোক্তাদের কাছে সহজে কাঁচামাল পৌঁছে দিতে চালু করা হয়েছে কাঁচামাল ব্যাংক। সেই সঙ্গে তেজগাঁওয়ের মনিপুরীপাড়ার জেডিপিসি ভবনটিকে পাটের পাটপণ্যের আদলে সাজসজ্জার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যাতে বাইরে থেকেই দৃশ্যমান হয় ভবনটি বহুমুখী পাটপণ্যের একটি সুতিকাগার। গতানুগতিক বস্তা, ব্যাগে আর আগের মতো সীমাবদ্ধ নেই পাট। এখন ঘর সাজানোসহ নানা সামগ্রী তৈরি হচ্ছে পাট থেকে। এর মধ্যে রয়েছে শতরঞ্জি, গায়ের ব্লেজার, জুতা, বাহারি রং-বেরঙের ব্যাগ, মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, ঝুড়ি, ওড়নার মতো বিচিত্র সব জিনিসপত্র। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে ১৩৩ ধরনের পাটপণ্য। এটা সম্ভব হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাট থেকে তৈরি সুতার কারণে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত এসব পাটপণ্য বিক্রির কেন্দ্রীয় কোন সেলস সেন্টার নেই। উদ্যোক্তারা দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সেলস সেন্টার বা বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য। উদ্যোক্তাদের সেই প্রাণের দাবি এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। তেজগাঁওয়ের জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) স্থাপন করা হচ্ছে এই বিক্রয় কেন্দ্র। ভবনের দ্বিতীয় তলা পুরোটা জুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই সেলস সেন্টার। চলতি মাসেই এ সেলস সেন্টার ক্রেতাদের জন্য উন্মুক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে জেডিপিসির নির্বাহী পরিচালক নাসিমা বেগম বলেন, সেলস সেন্টারটিকে সাজাতে মোট সাতটি সেগমেন্টে ভাগ করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পাটপণ্যগুলোকেও এই সাত ভাগে ভাগ করে এই প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্রে রাখা হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন ব্যাগ জাতীয় পণ্যগুলো এক সেগমেন্টে রাখা হবে। অফিস আইটেমগুলো রাখা হবে আরেক সেগমেন্টে। একইভাবে ঘরের গার্ডেনিং বা ডাইনিং রিলেটেড পণ্যগুলোকে রাখা হবে অপর একটি সেগমেন্টে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাসিমা বেগম বলেন, ভবনের নিচ তলায় থাকবে একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার। প্রত্যেক পণ্যের একটি কোড নম্বর থাকবে। কোড নম্বরের বিপরীতে প্রত্যেক পণ্যের দাম লেখা থাকবে। একজন ক্রেতা দোতলায় এসে প্রদর্শনী কেন্দ্র পরিদর্শন করে কোন পণ্য পছন্দ করে কিনতে চাইলে ডকুমেন্টেশন সেন্টার থেকে মূল্য জেনে নিয়ে অর্ডার দিতে পারবেন বা কিনে নিতে পারবেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক পণ্যের গায়ে পণ্যের নাম, উদ্যোক্তার নাম ও মূল্যসংক্রান্ত ট্যাগ লাগানো থাকবে। এখানে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে দরকষাকষির কোন সুযোগ থাকবে না। তবে এখানে একটি পণ্যের বেশি স্টক রাখা হবে না। কোন ক্রেতা বেশি পরিমাণে কোন পণ্য কিনতে চাইলে অর্ডার দিতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা ওই ক্রেতাকে ডেলিভারি দেয়া হবে। অন্যদিকে অর্ডার পাওয়ার পর উদ্যোক্তাকে পণ্যটি উৎপাদন করে সরবরাহের জন্য বলা হবে। ক্রেতার পণ্য এই সেলস সেন্টারের মাধ্যমেই ডেলিভারি দেয়া হবে। নাসিমা বেগম জানান, সাতটি সেগমেন্টের বাইরে সেলস সেন্টারে একটি কক্ষে সব পণ্যের একটি করে আইটেম রাখা হবে। যাতে কোন কোন দর্শক বা ক্রেতা ওই রুমে ঢুকেও এক নজরে দেশের বহুমুখী পাটপণ্য সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘চন্দ্র শেখর ও শৈবাল সাহার মতো নামকরা ডিজাইনার দিয়ে এই সেলস সেন্টারের ডিজাইন করা হয়েছে। এখানে পণ্যগুলো সুন্দরভাবে সাজানো হবে। লাইটিং করে পণ্যগুলোকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে ক্রেতা-দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হবে।’ সরাসরি বিক্রির পাশাপাশি এই বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ই-কমার্সের মাধ্যমেই পণ্য বিক্রি করা হবে। এ জন্য জেডিপিসির ওয়েবসাইটে ই-কমার্সের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। যাতে এই বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পণ্য কেনাবেচা করা যায়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বহুমুখী পাটপণ্য বিশ্বের প্রায় ১১৮টি দেশে রফতানি হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বহুমুখী পাটপণ্যের খাতটি দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়াও জেডিপিসিকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এ টু আই) কর্মসূচীর আওতায় ‘ডিজিটাল জুট মার্কেট প্লেস’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে জেডিপিসির পুরো কার্যক্রমে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। গত পহেলা জুলাই থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর ফলে শুধু ডিজিটাল পদ্ধতিতে পণ্য কেনাবেচার সুযোগই থাকছে না, পাটপণ্যসংক্রান্ত সব ধরনের সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেয়া হবে। পাটপণ্যের উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা কাঁচামাল। বিশেষ করে জেডিপিসির তালিকাভুক্ত বহুমুখী পাটপণ্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক বৃহৎ উদ্যোক্তা ছাড়া বেশিরভাগই মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এসব মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট ও স্বল্প পরিসরে পণ্য উৎপাদন করে থাকে এবং সে অনুযায়ী স্বল্প পরিমাণ কাঁচামাল (ফেব্রিক্স, সুতা প্রভৃতি) প্রয়োজন হয়। কিন্তু মিলগুলো স্বল্প পরিমাণ মালামাল বিক্রয় করে না। ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাঁচামালের জন্য হোলসেল মার্কেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু হোলসেল মার্কেটের বেশিরভাগ কাঁচামাল স্টক লটের বিধায় সেগুলো মান সম্মত হয় না। আবার দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে তারা প্রয়োজনীয় উৎপাদনের জন্য চাহিদামাফিক মানসম্মত কাঁচামাল পায় না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই সমস্যা দূর করে তাদের সুলভ ও ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত, পরিমাণমাফিক, কাঁচামাল সরবরাহের উদ্দেশ্যে জেডিপিসি ভবনে একটি কাঁচামাল ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জেডিপিসির নির্বাহী পরিচালক নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমরা পাটপণ্যের সব সেবা একই ছাতার নিচে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে উদ্যোক্তারা একই স্থানে এসে সব ধরনের সেবা পেতে পারেন। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশ পাট গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপিত কাঁচামাল ব্যাংকটি জেডিপিসি ভবনের নিয়ে আসা হয়েছে। এই ব্যাংক থেকে ছোট মাঝারি বড় সব উদ্যোক্তা তাদের প্রয়োজনমতো পাটপণ্য তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারছে।’ সেবা প্রদানের পাশাপাশি পাটপণ্যের উদ্যোক্তা তৈরিতেও কাজ করছে জেডিপিসি। এ উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। পাটপণ্য বহুমুখীকরণের এ উদ্যোগ গ্রহণের ফলে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শ’ জন সফল উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাসিমা বেগম বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে যাতে প্রশিক্ষণার্থীরা পাটপণ্য তৈরিতে এগিয়ে আসে সেজন্য জেডিপিসি থেকে ফলোআপ করা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে পাটপণ্য উৎপাদনে যুক্ত হচ্ছে কিনা? প্রশিক্ষণার্থীরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাটপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হয় সেজন্য তাদের সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যাগুলো জেনে নিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করছি। উদ্যোক্তাদের প্রধান সমস্যা ব্যাংক ঋণ ও কাঁচামাল প্রাপ্তি। এ দুটোকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই সঙ্গে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমরা জেডিপিসি ভবনকেও পাট পণ্যের আদলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে বাইরে দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ বুঝতে পারে এটি দেশের পাট পণ্যের একটি তীর্থস্থান।’ বিদেশে চাহিদা বেশি থাকালেও সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরেও বেড়েছে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার। চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদনেও এসেছে বৈচিত্র্য। উৎপাদনে গতানুগতিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এখন বহুমুখী গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে পাট। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যে নান্দনিকতার ছোঁয়ার কারণে রুচিশীল ক্রেতাদের নজর কাড়ছে। তারই ফলে বাড়ছে পাটজাত বহুবিধ পণ্যের রফতানিও। পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে পাটের অবদান বাড়ছে ক্রমেই। ফলে ধীরে ধীরে হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করেছে সোনালি আঁশ। এ প্রসঙ্গে নাসিমা বেগম বলেন, বাণিজ্যের বিভিন্ন ধারাকে জনপ্রিয় করতে পাট দিয়ে নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও চটকে বিভিন্ন আকৃতিতে কেটে সেলাই ও নক্সা করে তৈরি হচ্ছে শৌখিন পণ্য। তিনি আরও বলেন, দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে পাটের বাজার তৈরির জন্য আমরা দেশে-বিদেশে মেলায় অংশগ্রহণ করছি। বিদেশে আমরা যত মেলায় অংশ নিচ্ছি, দেখা গেছে মেলায় নেয়া সব পাটপণ্যই বিক্রি হয়ে যায়। এতে বোঝা যায়, বিদেশে আমাদের পাটপণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরেও আমরা মেলার আয়োজন করছি। যাতে দেশের অভ্যন্তরে পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি সব মন্ত্রণালয়কে পাটপণ্য ব্যবহারের জন্য ডিও লেটার প্রদান করা হয়েছে। যাতে তারা দেশের আয়োজিত সভা-সেমিনারে পাটপণ্য ব্যবহার করে। এ জন্য প্রত্যেক চিঠির সঙ্গে উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পাটপণ্যের একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পাট ও পাটপণ্য রফতানিতে বিশ্বে প্রথম ও পাট উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জাতীয় রফতানি আয়ের শতকরা ৪ দশমিক ৯ ভাগ পাট খাত থেকে অর্জিত হচ্ছে। এই খাত রফতানি আয়ের বৃহত্তম খাতও বটে।
×