ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লীগের পর জয়ের নামে এবার ধান্ধাবাজি সংগঠন!

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৮ আগস্ট ২০১৬

লীগের পর জয়ের নামে এবার ধান্ধাবাজি সংগঠন!

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ এর শেষ কোথায়? কেউ-ই তা জানে না। ভুঁইফোঁড় সংগঠনের লাগাম কোনমতেই টেনে ধরতে পারছে না শাসক দল আওয়ামী লীগ। বরং দিনে দিনে বেড়েই চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে নামসর্বস্ব সংগঠনের সংখ্যা। এসব নামসর্বস্ব সংগঠনের পেছনে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেলসহ বিভিন্ন নামে শতাধিক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে ওঠার পর এবার সুযোগ সন্ধানীদের চোখ পড়েছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকে। এবার ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ লীগ’ নামে আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে যথেচ্ছভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নাম ব্যবহার করে গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠনকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ‘ধান্ধাবাজি সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এদের লাগাম টেনে ধরার কোন উদ্যোগই চোখে পড়ে না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত সাতটি সহযোগী ও দুটি ভাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শত শত ভুঁইফোঁড় সংগঠনের দায় নেতারা নিতে না চাইলেও এসব সংগঠনের নানান কর্মসূচীতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা ও মন্ত্রীদের অংশগ্রহণেই তাদের বৈধতা দিতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। তিনি জনকণ্ঠের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এসব ধান্ধাবাজ ও বাটপাড়দের নাম-ঠিকানা দিন, আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এদের দমন করব। এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক নেই। এরা আওয়ামী লীগের কেউ নয়, বরং আওয়ামী লীগের শত্রু, অনুপ্রবেশকারী। ভুঁইফোঁড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের আওয়ামী লীগের নামে নানান কর্মসূচীতে দেখা গেলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের নেপথ্যের প্রধান কাজই হচ্ছে সংগঠনের নামে তদ্বির, ধান্ধাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলসহ নানা অপকর্ম। প্রকাশ্য প্রায় প্রতিদিনই ভুঁইফোঁড় সংগঠনের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেলেও যেন দেখার কেউ নেই আওয়ামী লীগে। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোন নেতার ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ছাপানোর ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশ থাকলেও রাজধানীসহ সারাদেশে অলি-গলিতে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নেতাদের বড় বড় ছবি দিয়ে ছেয়ে গেলেও এদের একজনের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠছে মূলত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে। আর এ শাস্তিহীনতার সুযোগ নিয়ে এর অপব্যবহার করছে একটি সুবিধাভোগী চক্র। এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠন মূলত লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন সর্বস্ব। বাস্তবে এসব সংগঠনের কোন কার্যক্রম যেমন নেই, তেমনি নেই কোন কার্যালয়ও। গত দুই সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও নামসর্বস্ব সংগঠনগুলোর কোন অফিসের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এটাও সত্যি আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যান। সেখানে বক্তব্য দিয়ে তাদের জিইয়ে রাখেন, যা সত্যিই দুঃখজনক। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় নতুন একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের ব্যানার ও পোস্টার হাসির খোরাকের জন্ম দিয়েছে। ওই পোস্টার ও ব্যানারে লেখা রয়েছেÑ ‘সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’! ঢাকা জেলা কমিটির ঠিকানা লেখা হয়েছে কালীগঞ্জ বাজার, চৌধুরী মার্কেট, নারায়ণগঞ্জ। এ কমিটির আহ্বায়ক রনি আহম্মেদের সঠিক পরিচয় কিংবা কী করেন, সে সম্পর্কে জানা যায়নি। আরেকটি সংগঠন সহসাই আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, যার নাম দেয়া হয়েছেÑ ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’! এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সভাপতি হচ্ছেন হাসু সরদার। তিনি দাবি করেন, এ সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা জড়িত। ইতোমধ্যে তারা ১০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ কয়েকটি জেলা কমিটি দিয়েছেন বলেও দাবি হাসু সরদারের। তবে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা কেউ-ই চেনেন না এই হাসু সরদারকে। মূলত আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা, একপাশে বঙ্গবন্ধু অন্যপাশে শেখ হাসিনার ছবি। ছবি আছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়েরও। এরপর ন্যায়-নীতি প্রকাশের চেষ্টায় চোখা কিছু শব্দ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে সেøাগান। শব্দগুলো হলোÑ নীতি-আদর্শ, স্বচ্ছতা-চরিত্র, সততা-একতা। ভোগে নয়-ত্যাগে বিশ্বাসী। বেশ কয়েকটি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোঁড় সংগঠনের ব্যানার-পোস্টারে এমন নানান নীতিবাক্য ছাপানো থাকলেও উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাউকে কাউকে কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করিয়ে সেই ছবি দেখিয়ে নানান তদ্বির, টেন্ডারবাজি ও দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলোর ব্যাপারে অভিযোগের পাহাড় জমলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণের সত্যতা পাওয়া যায়নি। ‘আওয়ামী ওলামা লীগ’ নামে বিবদমান দুটি সংগঠনের কর্মকা- আওয়ামী লীগের আদর্শ-ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত হানলেও সেদিকে নজর নেই আওয়ামী লীগের। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামের নীতি-আদর্শের মতো অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার লোগো ব্যবহার করে গজিয়ে ওঠা এই ভুঁইফোঁড় সংগঠনের ব্যানারে নানান আপত্তিকর ফতোয়া জারি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানালেও ‘এদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক নেই’Ñ শুধু এটুকু বলেই দায় এড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছেÑ যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ। দলের গঠনতন্ত্রে এর বাইরে কোন সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে গত সাড়ে সাত বছরে নামসর্বস্ব প্রায় এক শ’ সংগঠন গড়ে উঠেছে। যাদের কাজ নানা রকম তদ্বির। কেউ-কেউ সুবিধা পেলে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিও করছেন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে। এটি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের মাত্রাতিরিক্ত তৎপরতা খোদ শাসক দলকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অনুসন্ধান করে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বাইরে থাকা এমন শতাধিক সংগঠনের নাম জানা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছেÑ জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হর্কাস লীগ, আওয়ামী মোটরচালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিক্সা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হর্কাস লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, আমরা মুজিব হবো, চেতনায় মুজিব, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, বাংলাদশে আওয়ামী পর্যটন লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরতœ পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, আমরা নৌকার প্রজন্ম আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, তৃণমূল লীগ, একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটিসহ অজস্র সংগঠনের নাম।
×