ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চোরাচালান উঃ কোরীয় দূতাবাস কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ আগস্ট ২০১৬

চোরাচালান উঃ কোরীয়  দূতাবাস কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের উদ্যোগ

আজাদ সুলায়মান ॥ কূটনীতিক সুবিধায় চোরাচালান করার অভিযোগে ঢাকায় উত্তর কোরীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ওই কর্মকর্তার নামে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা বিপুলপরিমাণ পণ্য জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। গত মঙ্গলবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে অভিযান চালিয়ে এ কন্টেনার আটক করা হয়। এতে ছিল ১৬ লাখ শলাকা সিগারেট ও বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রিক পণ্য। যার বাজার মূল্য সাড়ে তিন কোটি টাকা। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব পণ্য রাজধানীর খোলা বাজারে বিক্রি করারও প্রস্তুতি ছিল। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২০১৬ সালের ২(২)৭০ রেজ্যুলেশন অনুযায়ী ঢাকায় উত্তর কোরীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি হান সন ইক-কে বহিষ্কার করার সুপারিশ পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ কূটনীতিককে বহিষ্কার করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, কূটনীতিক সুবিধার আড়ালে বার বারই উত্তর কোরীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এ ধরনের চোরাচালানে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। হাতেনাতে সোনা, মদ, সিগারেট, যৌন উত্তেজক ওষুধ ও দামী ইলেকট্রনিক্স পণ্যসহ আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কমলাপুরের আইসিডিতে যে কন্টেনার আটক করা হয়েছে তার তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে বেশ প্রমাণাদিও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এ ধরনের চোরাচালানে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য মাঠে নামে শুল্ক গোয়েন্দা। গত সপ্তাহে হঠাৎ সোর্স নিশ্চিত করে-কমলাপুর আইসিডিতে ঢাকায় উত্তর কোরীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি হান সন ইকের নামে একটি বড় কন্টেনার এসেছে। এ কন্টেনারে খাদ্যদ্রব্য রয়েছে বলে ঘোষণা দেয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সুনিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান অভিযান চালিয়ে কন্টেনারটি আটক করেন। এ অভিযানে অংশ নেয় অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, আমদানিকারক, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট। সবার উপস্থিতিতে কন্টেনারটি খোলার পর দেখা যায়, এতে রয়েছে ৮ হাজার ৯৯ কার্টন ( ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৮০০ শলাকা) সিগারেট ও বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক্স পণ্য। জানা যায়, এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কূটনীতিক মহলে তোলপাড় চলে। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাজস্ব বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চোরাচালানে জড়িত থাকার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। গত এপ্রিল মাসেও খাদ্যদ্রব্য আমদানির মিথ্যা ঘোষণায় একই ধরনের একটি কন্টেনার খালাস করা হয় ওই কর্মকর্তার নামে। এর আগেও ২০১২ সালে উত্তর কোরীয় দূতাবাসের কতিপয় কূটনীতিকের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকিসহ অন্যান্য কাস্টমস অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি পাক টং চ্যানের নামের আসা একটি কন্টেনারে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য জব্দ করা হয়Ñ যার বাজার দর ছিল দেড় কোটি টাকা। এ ঘটনায় তাকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত বছরের ৭ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উত্তর কোরীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি সন ইয়াং ন্যামকে ২৭ কেজি সোনার চালানসহ আটক করা হয়। পরে দুদেশের কূটনীতিক দেনদরবারের মাধ্যমে তার কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়। সোনার চালানটি ঠিকই জব্দ করা হয়। ওই ঘটনার দু’মাসের মাথায় ১৪ মে বনানীর পিয়ং ইয়ং রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে বিপুুল পরিমাণ যৌন উত্তেজক ওষুধ ও অবৈধ মাদকদ্রব্য জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। এ ঘটনায় রেস্টুরেন্টটির মালিক ডরয়াং সুন হুয়া নামের একজন উত্তর কোরীয় মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই অভিযান পরিচালনার সময় দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মি. মিং হান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সরকারী কাজে বাধা প্রদান করেন। যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে উল্লেখ করে একটি অভিযোগ পাঠায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। উল্লেখ্য, ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৬১-এর ৪১ অনুযায়ী প্রত্যেক কূটনীতিককে আবশ্যিকভাবে কর্মরত দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হয়। আর্টিকেল ৪২ অনুযায়ী কোন বিদেশী কূটনীতিক কোনভাবেই তার ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে কোন প্রকার ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। দি কাস্টমস এ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ৩২ ধারার আওতায় মি. হান সন হক কর্তৃক মিথ্যা ঘোষণাসংক্রান্ত অপরাধটিতে ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত লঙ্ঘন ও কূটনীতিক সুবিধার অপব্যবহার করা হয়েছে। এখানে আরও বড় শর্তারোপ করা হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও রেজ্যুলেশনে। ২২৭০ (২০১৬)-এর আর্টিকেল ১৮ অনুযায়ী উত্তর কোরীয় দূতাবাস কিংবা দূতাবাসে কর্মরত কোন কূটনীতিকের নামে আমদানিকৃত যে কোন প্রকার কার্গো পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিদর্শনকালে যদি এ ধরনের প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় ঘটে বা চোরাচালান ধরা পড়ে, তাহলে আর্টিকেল ১৩ অনুযায়ী ওই কূটনীতিককে বহিষ্কার করা আবশ্যক। ডক্টর মইনুল খান জানিয়েছেন, ভিয়েনা কনভেনশন ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজ্যুলেশন অনুযায়ী এখন মি. হান সন ইক-কে বহিষ্কারের কোন বিকল্প নেই।
×