ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিয়াজুল হক

পর্যটন শিল্প অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আঁধার

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৭ আগস্ট ২০১৬

পর্যটন শিল্প  অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আঁধার

পর্যটন এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ না করেই বিপুল আয় করা সম্ভব। পর্যটনের জন্য তেমন কিছু সৃষ্টি করতে হয় না। শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণকে রূপান্তরের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলেই চলে। পর্যটন স্পটগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাত থেকে বিপুল আয় করা সম্ভব। একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সরকারের বৈদেশিক আয় হয়েছে ৪ হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১০ সালে এ শিল্পে বৈদেশিক আয় ছিল ৫৫৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ২২৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১১ সালে ৬২০ কোটি ১৬ লাখ, ২০১২ সালে ৮২৫ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০১৩ সালে ৯৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশী পর্যটকদের মাধ্যমে আয় হয়েছে সরকারের। ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তথ্যমতে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের মে ২০১৬ পর্যন্ত এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৭১৪৩.৬২ লাখ টাকা। যা লক্ষ্য অর্জনের শতকরা ৬৯.৮৭%। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নতির জন্য দর্শনীয় বস্তুর অভাব নেই। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী যুগে যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশী-বিদেশী ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের জন্য ছোট এই দেশে রয়েছে শত শত মনোরম আকর্ষণীয় স্থান ও সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ : লালবাগ কেল্লা, মুঘল ঈদগাহ, আহসান মঞ্জিল, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁও, উয়ারী বটেশ্বর, ময়নামতি, পাহাড়পুর, কান্তজীড় মন্দির, মহাস্থানগড়। সমুদ্র সৈকত : কক্সবাজার, পতেঙ্গা, পারকী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, কটকা। পাহাড় ও দ্বীপ : রাঙামাটি হ্রদ জেলা, কাপ্তাই হ্রদ শহর, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, মহেশখালী দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ। ঐতিহাসিক স্থানসমূহ : জাতির পিতার সমাধিসৌধ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, জাতীয় কবির সমাধিসৌধ, কার্জন হলো, বলধা গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, বাহাদুর শাহ পার্ক, দীঘাপতিয়া রাজবাড়ী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবরস্থান, শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সাগরদাড়ি, মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, ত্রিশাল, গান্ধী আশ্রম। বন ও জলাবন : সুন্দরবন, রাতারগুল জলাবন। অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থানসমূহ ঃ জাতীয় সংসদ ভবন, বঙ্গভবন, শাঁখারি বাজার, সদরঘাট, রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, জাতীয় চিড়িয়াখানা, জাতীয় উদ্যান, বাটালী পাহাড়, যমুনা ব্রিজ, মাধবকু-ু, জাফলং। প্রথমেই আমাদের পর্যটন শিল্পকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। প্রচার করতে হবে কক্সবাজার পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কিংবা ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য। পৃথিবীর কাছে আমাদের খাবার, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে। বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে আধুনিক ও চিত্তবিনোদনের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে হবে। অন্যথায় তারা আসবে না। পর্যটন খাতে বিনিয়োগ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের তুলনায় কোন অংশেই কম লাভজনক নয়, বরং কোন কোন দেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অধিক লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পর্যটন শিল্পের প্রসারের ফলে জাতীয় আয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব। দেশের যেসব অঞ্চল সাধারণভাবে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকা-ের জন্য উপযুক্ত নয়, সেসব অঞ্চলে পর্যটন শিল্প প্রসারের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি ও উন্নয়নের ধারাপ্রবাহে সামাজিক সমতা সৃষ্টি সম্ভব। ভয়াবহ বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। পর্যটন খাতে উদ্বৃত্ত অর্থের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য শিল্পের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এর বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব। পর্যটন প্রসারের উদ্দেশ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তরাঁ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণের ফলে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়। দেশী-বিদেশী সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এই শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে। পর্যটন একটি অদৃশ্য রফতানি শিল্প। পর্যটন শিল্পকে অর্থনৈতিকভাবে অনুকূল করতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত আনুষঙ্গিক বিষয়, যেমন- বিদ্যুত, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নতমানের করতে হবে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আরও উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের সমুদ্র সৈকত, রাঙ্গামাটির সুভলং ঝরনা এবং বান্দরবানের শৈলপ্রপাত ও বগা লেক তথা সর্বত্র পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে হবে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একমাত্র লক্ষ্যই হলো বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা সকলেই চাই সেই লক্ষ্য দ্রুত অর্জিত হোক। পুনরায় নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করে আমাদের পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাক আরও অনেক দূরের গন্তব্যে। কারণ পর্যটন শিল্পের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই বিরাজমান দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
×