সাদামাটা পারফর্মেন্স। শুরুটা তেমন প্রত্যাশিত হয়নি। তারপরও শ্যামলবরণ আরচার শ্যামলী রায়ের মুখে উজ্জ্বল হাসি। ৩১তম রিও অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী দিন দুপুরে মহিলা আরচারির ব্যক্তিগত বাছাইয়ের র্যাঙ্কিং পর্বে শ্যামলী হয়েছেন ৬৪ জনের মধ্যে ৫৩। এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কে, তা জানা যাবে আজ। আর তার ভাগ্য পরীক্ষা ব্রাজিল সময় ৮ আগস্ট। এর আগে অবশ্য বাংলাদেশের আর কোন ক্রীড়াবিদের ইভেন্ট নেই। শ্যামলীর সঙ্গে এদিন পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে লড়বেন শূটার আবদুল্লাহ হেল বাকী। সেটাও বাছাই পর্বের। অর্থাৎ মাঝের এই দু’দিন কেবল অপেক্ষা।
ইভেন্ট শেষে শ্যামলীর অভিব্যক্তিটা হচ্ছে, ‘আরও একটু ভাল করতে পারলে ভাল লাগতো। তবে এটা তো কেবলই শুরু। এখনই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। ৬০০ স্কোর করে ৫৩তম স্থান পাওয়ায় এই মুহূর্তে আমি তেমন হতাশ নই। আবার খুশিতে আত্মহারাও নই। ৮ তারিখের আসল পর্বে দেখবেন ঠিকই ভাল করব। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
বাংলাদেশের হয়ে রিও অলিম্পিকে খেলতে এসেছেন মোট সাত ক্রীড়াবিদ। তাদেরই একজন নারী তীরন্দাজ শ্যামলী রায়। ঢাকা থেকে রিওতে উড়ে আসার আগে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলেন নিজের সেরা পারফর্মেন্সটাই প্রদর্শন করবেন। রিওতে এসে ৭ সদস্যের দলের মধ্যে সবার আগে মাঠে নামেন শ্যামলী। তবে র্যাঙ্কিং রাউন্ডে সাদামাটা শুরু করেন বাংলাদেশের এই তীরন্দাজ।
কেন এই সাদামাটা সূচনা? এ জন্য অনুশীলনকেই কিছুটা দায়ী করলেন বাংলাদেশের এই কৃতী আরচার। তার কথায়, ‘রিও আসার পর মাত্র একদিনের জন্য অনুশীলনের সময় পেয়েছি। এ রকম বড় আসরে এতো অল্প প্রস্তুতি নিয়ে খেলা কঠিন। যদিও আমি বিদেশী কোচের অধীনে দেশে অনুশীলনেই ছিলাম। কিন্তু দেশ আর বিদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য। প্রথমত জীবনের প্রথম অলিম্পিক, যেন পুকুরে বাস করে সাগরে ঝাঁপ দেয়ার মতো। তারপরও সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তীর-ধনুক হাতে প্রথম দিনটা ভাল-মন্দের মধ্যে কেটেছে। তবে এটা ক্যারিয়ারে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে অলিম্পিকের মতো বড় আসরে খেলার। আর এই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে চাই বাছাইপর্বে। আত্মবিশ্বাস আছে মনের মধ্যে। আমি স্টেপ বাই স্টেপ এগুতে চাই। কাজেই বেশি দূরে যেতে চাই না। আট তারিখের বাছাইপর্ব উতরিয়ে পরবর্তী পর্বে জায়গা করে নেয়াই এই মুহূর্তে আমার লক্ষ্য। মাঝে দু’দিন অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছি। এই সময়টায় নিজেকে আরও ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ পাব।’
জীবনের প্রথম অলিম্পিক, কেমন লাগছে? শ্যামলী রায়ের উত্তর, ‘একটু নয়, বড় ধরনের নার্ভাস কাজ করছিল খেলা শুরুর আগে। তবে সেটা ধীরে ধীরে অনেকটাই দূর হয়ে যায়। অলিম্পিক খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে এ বিষয়টা কাজ করতো না মনের মধ্যে। আমার মনে হয় পৃথিবীর সব ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রেই প্রথম অলিম্পিক খেলতে গেলে একটা টেনশন কাজ করে। মন থেকে এটা শতভাগ দূর করে শুরু করলে আরও ভাল স্কোর করতে পারতাম। এখন যেটার অপেক্ষায় আছি। দোয়া চাইবেন আমার জন্য। অবশ্যই বাছাই পেরিয়ে পরের রাউন্ডে খেলার মতো মানসিক অবস্থা ফিরে পেয়েছি।’ ২০১৫ সালে ব্যাংককে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে গড়া ৬১৮ স্কোর গড়লেও এবারের অলিম্পিকে মেয়েদের ব্যক্তিগত ইভেন্টের র্যাঙ্কিং রাউন্ডে ৭২০-এর মধ্যে ৬০০ স্কোর করেন শ্যামলী। ফলে অংশগ্রহণকারী ৬৪ জনের মধ্যে তিনি ৫৩তম হন। এখন সেরা বত্রিশে ওঠার এলিমিনেশন্স রাউন্ডে শ্যামলীকে লড়তে হবে ১২তম হওয়া মেক্সিকোর গ্যাব্রিয়েলা বায়ার্দোর বিপক্ষে। ৭২০-এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার মিসুন চই ৬৬৯ স্কোর করে প্রথম হয়েছেন। উল্লেখ্য, র্যাঙ্কিং রাউন্ডে কোন প্রতিযোগীকে বাদ দেয়া হয় না।
রিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নিতে গত ২ আগস্ট দেশ ছাড়েন আরচার শ্যামলী রায়। ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে বিশ্ব ক্রীড়ার সবচেয়ে বড় এ আসরে অংশ নিলেও শ্যামলীর লক্ষ্য লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের বুকে তুলে ধরা। সব শিরোপাই যেন তুচ্ছ অলিম্পিক পদকের সামনে। তাই প্রতিটি এ্যাথলেটেরই জীবনে লক্ষ্য থাকে অলিম্পিকের মতো ক্রীড়া জগতের এই মহাযজ্ঞে অংশ নেয়ার। যদিও বাংলাদেশের এ্যাথলেটদের জন্য তা আকাশ কুসুম কল্পনা। কারণ প্রতিবারই তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় ‘দয়া-দাক্ষিণ্যের’ ওয়াইল্ড কার্ডের আশায়! এবার গলফার সিদ্দিকুর সরাসরি অংশ নিলেও ওয়াইল্ড কার্ড পেয়ে বাংলাদেশের হয়ে রিও অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করবেন বাকি ছয় এ্যাথলেট। যাদের মধ্যে আরচার শ্যামলী রায় অন্যতম।
নড়াইলের মেয়ে শ্যামলী। কখনও ভাবেননি জাতীয় দলে দুই বছর খেলার পরই ভাগ্যদেবী এমন মুখ তুলে তাকাবে তারদিকে। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৩২তম হওয়ায় মূলত রিও অলিম্পিকের দরজা খুলে যায় তার জন্য। অনুশীলন চালাচ্ছিলেন ওয়াইল্ড কার্ড পাওয়ার আগে থেকেই। কিন্তু কেবল ঘরোয়া অনুশীলনই যে বিশ্বক্রীড়ার এই মহাযজ্ঞের প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট নয়, সেটা নিজেও ভালমতোই জানেন শ্যামলী। তাছাড়া ২০১৬ সালে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেননি তিনি (রিও অলিম্পিক বাদে)। যদি কোন টুর্নামেন্টে অংশ নিতেন, তাহলে বুঝতেন তার অবস্থান কোথায়, তার অনুশীলনটা কতটা ভাল হচ্ছে।
সাফল্যের পথ কখনই মসৃণ নয়। পথটা বন্ধুর বলেই রিও অলিম্পিকে অন্তত কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাতে চান শ্যামলী। দেশ ছাড়ার আগে এমনটাই জানিয়ে এসেছিলেন তিনি। এখন দেখার বিষয়, সেরা বত্রিশে ওঠার এলিমিনেশন্স রাউন্ডে শ্যামলবরণ আরচার শ্যামলী রায়ের প্রচেষ্টা সফল হয় কি না।