ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রবীন্দ্রপ্রয়াণ দিবস

উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সবল উচ্চারণ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৭ আগস্ট ২০১৬

উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সবল উচ্চারণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাঙালীর যাপিত জীবনে সর্বক্ষণই তিনি বিরাজমান। আপন সৃষ্টির নির্যাসে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলেছেন জাতিসত্তার মননকে। এভাবেই বাঙালীর প্রাণের মানুষে পরিণত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই আত্মপরিচয়টি মেলে ধরেছিলেন এভাবে- সেতারেতে বাঁধিলাম তার, গাহিলাম আরবার/মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক ...। সৃষ্টির আলোয় ছড়িয়েছিলেন রবির কিরণ। শিল্প-সাহিত্যের আলোকধারায় ছুঁয়েছিলেন বাঙালীর মন-প্রাণ। দিয়েছিলেন বাঙালীর সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার পথের দিশা। তার হাত ধরেই বাংলাসাহিত্য জাতীয়তার গ-ি পেরিয়ে পেয়েছিল আন্তর্জাতিকতার ঠিকানা। স্বদেশের ঠিকানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিকতায় ঠাঁই করে নিয়েছিল বাঙালিত্বের গৌরববৌধ। বাংলা পঞ্জিকার হিসাবে শনিবার ছিল বাইশে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৫তম প্রয়াণবার্ষিকী। মৌলবাদী আগ্রাসনের অস্থির সময়ে কবির মহাপ্রস্থানের দিনটিতে বারংবার উচ্চারিত হয়েছে শান্তির বারতা। ব্যক্ত হয়েছে হিংসার পথ দূরে ঠেলে মানবতার পথে ধাবিত হওয়ার প্রত্যয়। রবির সৃজনীশক্তির আলোয় উগ্রপন্থার অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে গাওয়া হয়েছে জীবনের জয়গান। নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে পালিত হয়েছে কবিগুরুর প্রয়াণবার্ষিকী। এ উপলক্ষে পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বকবিকে নিবেদিত বিশেষ সংবাদ। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ছিল বহুমাত্রিক আয়োজন। কোথাও উচ্চারিত হয়েছে দোলায়িত ছন্দে বিশ্বকবির অবিনাশী কবিতা। আবার কোন চ্যানেলে দিনভর নানা শিল্পীর সুরেলা ধ্বনিতে গীত হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কোথাওবা প্রচারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটক। বিভিন্ন বেতারেও হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। আর প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে সংস্কৃতিবান বাঙালী প্রাত্যহিক জীবনাচারে সহজাতভাবেই স্মরণ করেছে কবিগুরুকে। ছায়ানটের স্মরণে রবীন্দ্রনাথ ॥ শনিবার শ্রাবণ সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমন্ত্রিত শিল্পীরা গানে গানে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান কবিকে। সম্মেলক ও একক গান এবং একক নাট্যাভিনয়ে সাজানো হয় এ স্মরণানুষ্ঠান।। শুরুতেই ছিল ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মেলক গান। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায় ‘যে ধ্রুপদ দিয়েছো বাঁধি’। সমবেত সঙ্গীত শেষে কবিগুরুর একক গান নিয়ে মঞ্চে আসেন সত্যম কুমার দেবনাথ। পরিবেশন করেন ‘যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে’। বিক্রম দাস গেয়ে শোনান ‘ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের’। সেঁজুতি বড়ুয়া পরিবেশন করেন ‘আরো আঘাত সইবে’। মৃৃত্তিকা সহিতা গেয়ে শোনান ‘আমি তোমারি মাটির কন্যা’। আব্দুল ওয়াদুদ পরিবেশন করেন ‘নহ মাতা নহ কন্যা’ ও সেমন্তী মঞ্জুরী পরিবেশন করেন ‘আমি চিত্রাঙ্গদা’। একক গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মেলক সঙ্গীত। তাদের কণ্ঠে গীত হয় ‘শ্রাবণের ধারার মতো’, ‘শ্রাবণের গগনের গায়’ ও ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’ শিরোনামের কয়েকটি গান। সুরের সুধায় আয়োজনটি হয়ে ওঠে রবীন্দ্র বন্দনাময়। গান শেষে কবির ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প অবলম্বনে পরিবেশিত হয় শামীম নাজনীন অভিনীত একক নাটক। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কবিগুরুর প্রয়াণবার্ষিকীর এ আয়োজন। বাংলা একাডেমির আয়োজন ॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সূচনা হয় শনিবার। এদিন বিকেলে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আহমদ রফিক রচিত রবীন্দ্রজীবন গ্রন্থের তৃতীয় খ-ের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক শফি আহমেদ ও অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। অতিথিরা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুভূতি প্রকাশ করে আহমদ রফিক বলেন, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যের এক সৃষ্টিশীল বিস্ময়। তার বিচিত্রগামী জীবন ধারণ করেছে তার নিজের জীবন এবং একই সঙ্গে বাংলা, ভারত ও বিশ্বপরিসরে। রবীন্দ্রজীবন-তৃতীয় খ-ে তার কর্মময় জীবনের এক বিশেষ পর্বে আলো ফেলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনতথ্য উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি তার সময়ের ধারাক্রম অনুধাবন সম্ভব হবে। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আহমদ রফিকের রবীন্দ্রজীবন (তৃতীয় খ-) বইটি বাংলা একাডেমির একটি অসাধারণ প্রকাশনা। এই বই এমন এক কবি ও চলিষ্ণু কর্মীমানুষ সম্পর্কে প্রণীত হয়েছে যিনি তার ব্যক্তিত্ব ও সৃষ্টিপ্রতিভার অসাধারণত্বের মধ্য দিয়ে, শ্রমশীলতার প্রকাশে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রজীবন বইটি আমাদের ইতিহাসচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকবে। স্বাগত বক্তব্যে শামসুজ্জামান খান বলেন, কয়েক বছর আগে বাংলা একাডেমি বাংলাদেশ থেকে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রণয়ন ও প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পিত পাঁচ খ-ের প্রথম দুটি খ- রচনার পর জীবনীকার আবদুশ শাকুর প্রয়াত হওয়ায় প্রখ্যাত রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিককে বাকি তিনটি খ- রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রজীবন (তৃতীয় খ-) রচনা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রচর্চায় যেমন নতুন মাত্রা যুক্ত হবে তেমনি আমাদের তরুণ প্রজন্ম রবীন্দ্রজীবন ও সৃষ্টির মধ্য থেকে ইতিবাচক ভবিষ্যত গড়ার প্রেরণা খুঁজে পাবে। আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি জীবনী প্রচলিত থাকার পর বাংলা একাডেমি নতুন করে রবীন্দ্রজীবনী প্রণয়ন ও প্রকাশের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসাযোগ্য। আহমদ রফিক রচিত রবীন্দ্রজীবনের এই তৃতীয় খ-ে বিশ্বসাহিত্যের এই মহান কবি ও কর্মীর জীবনের এক বিশেষ সময়কালীন পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিক আলোচনাসহ উপস্থাপিত হয়েছে। তারা বলেন, যে রবীন্দ্রনাথের জীবনই তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিÑ তাকে কোন কাঠামোবদ্ধ জীবনীতে তুলে ধরা অসম্ভব কাজ। তবে আহমদ রফিক যে বিপুল তথ্য-সমাবেশে, মননশীল বিশ্লেষণে এবং আন্তর্জাতিকতার বৃহত্তর পরিসরে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবনের প্রয়াস চালিয়েছেনÑ তার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রজীবনী-চর্চায় এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি হবে। আজ রবিবার বিকেল চারটায় অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং রবীন্দ্রপুরস্কার-২০১৬ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রবীন্দ্রবিষয়ক একক বক্তৃতা দেবেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অধ্যাপক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এ বছর রবীন্দ্রপুরস্কার প্রদান করা হবে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন ও শিল্পী তপন মাহমুদকে। সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন ॥ বিশ্বকবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে কবিকে স্মরণের এ আয়োজন হয়। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার কামাল ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক সোহরাব উদ্দিন।
×