ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পালিয়েছে তিন জঙ্গী কমান্ডার, হদিস নেই ২ মাস্টারমাইন্ডের

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৭ আগস্ট ২০১৬

পালিয়েছে তিন জঙ্গী  কমান্ডার, হদিস নেই ২ মাস্টারমাইন্ডের

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর গুলশান, কল্যাণপুর ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া- এ তিন হামলার ও জঙ্গী আস্তানা থেকে তিন জঙ্গী কমান্ডার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার কমান্ডার ছিল রাজীব, কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানার কমান্ডার ছিল ইকবাল ও কিশোরগঞ্জের জঙ্গী হামলার কমান্ডার ছিল করিম। জঙ্গী হামলা ও জঙ্গী আস্তানার নেতৃত্বে ছিল তিন কমান্ডারই। এই তিন কমান্ডার তো পালিয়েছেই, চল্লিশ লাখ টাকার মাথার দাম পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হক জিয়া ও কানাডাপ্রবাসী তামিম আহমেদ চৌধুরীরও হদিস নেই। জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড ও কমান্ডারদের নেতৃত্বে আবারও জঙ্গী হামলার আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর থান্ডারবোল্ট অভিযানে যে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়েছে তাদের নেতৃত্বে ছিল রাজীব। রাজীবের নেতৃত্বেই এই পাঁচ জঙ্গী গুলশানে এসে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা চালিয়েছে। রাজীব ঘটনার দিন আশপাশে থেকেই জঙ্গী হামলার তদারকি করেছে। সিরাজগঞ্জের রাজীব নিহত পাঁচ জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বগুড়ায়। প্রশিক্ষণের পর্যায়ে পাঁচ জঙ্গীর হাতে তুলে দেয়া হয় চারটি পিস্তল, একে-৪৭ ও পয়েন্ট-২২ বোর রাইফেল, ম্যাগজিন, বুলেট ও ছুরি। এসব তুলে দেয় গুলশান জঙ্গী হামলার কমান্ডার রাজীব। রাজীব নামটি তার ছদ্মনাম বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এ ধরনের তথ্য বের হয়ে এসেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় স্টর্ম-২৬ অভিযানের সময়ে জাহাজ ভবনে নিহত হয়েছে ৯ জঙ্গী। জাহাজ ভবনের পাঁচতলায় মেস হিসেবে ভাড়া নিয়ে আস্তানা গেড়েছিল এগারো জঙ্গী। এর মধ্যে ৯ জঙ্গী নিহত হওয়ার সময় দুই জঙ্গী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান ধরা পড়ে ও এক জঙ্গী ইকবাল পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ইকবাল ছিল খুবই দুর্ধর্ষ ও জঙ্গী আস্তানার কমান্ডার। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে ছিল একটি ব্যাগ। এই ব্যাগে ছিল অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড। ইকবাল নামটি হচ্ছে তার ছদ্মনাম। ছদ্মনাম হওয়ার কারণে তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটন কঠিন হয়ে পড়েছে। ইকবাল কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানার কমান্ডার ছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে ধরা পড়া জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ঈদের জামাতের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় যে জঙ্গী হামলা হয়েছে তার নেতৃত্বে ছিল করিম। করিমের নেতৃত্বেই জঙ্গী হামলার দিন নিহত আবির রহমান ও দুই দিন আগে বন্দুকযুদ্ধে নিহত শফিউল শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় অংশ নেয়। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য পাওয়া গেছে অডিও ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। অডিও ভিডিও রেকর্ডিংয়ে যে তথ্য এসেছে তাতে তাদের সঙ্গে আক্তার, পারভেজ, জাহিদ নামের আরও তিন জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে। এই তিন জঙ্গীর নামও ছদ্মনাম। শোলাকিয়া জঙ্গী হামলার জঙ্গী কমান্ডার করিম নামটিও ছদ্মনাম। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, রাজধানীর গুলশান, কল্যাণপুর ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার জঙ্গী হামলা ও আস্তানার মাস্টারমাইন্ড পুরস্কার ঘোষিত তামিম আহমেদ চৌধুরী ও চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হকের মাথার দাম চল্লিশ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে পুলিশ। তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে চল্লিশ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার পরও আজ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। তারা ধরা না পড়ার কারণে আবারও জঙ্গী হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২১ জুন ব্লগার ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যা চেষ্টার মামলায় সুমন হোসেন পাটোয়ারী নামে এক আনসারুল্লাহ সদস্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ওই জবানবন্দীতে সুমন জানায়, ‘উত্তরায় আমাদের আস্তানায় এক ‘বড়ভাই’ নিয়মিত আসতেন। ওই ‘বড়ভাই’ আমাদের সবার নেতা। ‘বড়ভাই’ আমাদের বলতেন, ‘আল্লাহর জন্য কাজ করতে হবে এবং নাস্তিকদের কতল করতে হবে।’ তিনি আমাদের জানান, তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন এবং জিহাদের জন্য চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাদের নেতা বড়ভাইয়ের নাম ইশতিয়াক (ছদ্মনাম) বলে শুনেছি। অপরদিকে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পর কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তামিম চৌধুরীর নাম জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড বলে জানতে পারেন তদন্তকারীরা। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও মেজর জিয়া দেশেই আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি এই দুজন বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের হোতা ও মাস্টারমাইন্ড। তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য বের করা হচ্ছে। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। গত সপ্তাহে এই দুজনকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ করে মোট ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, আশা করছি গোয়েন্দা জালে একে একে ধরা পড়বে জঙ্গীরা। যারা জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িয়েছে তাদের ধরতে গোয়েন্দা জাল তৈরি করা হয়েছে। এদের কোথায় আস্তানা আছে, সে বিষয়ে গোয়েন্দারা কাজ করে যাচ্ছেন। কানাডায় দেখা হয়েছিল ॥ রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার সময় সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে জঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যাওয়া জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম ও কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে রিমান্ডে নেয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা অব্যাহত আছে। বিশ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরীর সঙ্গে রিমান্ডে থাকা কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ আহমেদের দেখা হয়েছিল। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে এ ধরনের তথ্যের কথা জানান তাহমিদ আহমেদ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা ও সিসি ক্যামেরায় দেখা যাওয়া তথ্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×