ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

সেরা বন্ধু

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৬ আগস্ট ২০১৬

সেরা বন্ধু

নাতাশা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে বার বার চোখ মুছছে। সকালে খুব রোদ ছিল। এমন বৃষ্টি নামবে সে ভাবতেও পারেনি। স্কুলে আসার সময় একটা ছাতাও সে আনেনি। ঠোঁট কামড়ে ক্লাসরুমের সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে নাতাশা। ছুটি হয়েছে আরও এক ঘণ্টা আগে। ছুটির পর সে কখনও এত সময় স্কুলে থাকেনি। আব্বু-আম্মু কেউ নিতে আসেনি তাকে। সুমাইয়ার বাবার ফোন থেকে বাসায় ফোন করেছিল নাতাশা। আম্মু বলেছে, বৃষ্টির কারণে পুরো শহরে পানি জমে গেছে। প্রচণ্ড জ্যাম। গাড়ি নড়তে পারছে না। আসতে অনেকটা সময় লাগবে। নাতাশাদের বাসা স্কুল থেকে অনেক দূরে। জ্যাম না থাকলেও ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। তার মানে আজকে দুই-আড়াই ঘণ্টা লাগলেও কিছু করার নেই। সবাই চলে গেছে। বৃষ্টিতে যারা আটকা পড়ে ছিল, তারাও একে একে চলে গেছে। নাতাশা একাই বসে আছে। আরেকজন অবশ্য আছে। সারা। সে নাতাশার ক্লাসেই পড়ে। কিন্তু নাতাশা তাকে একটুও পছন্দ করে না। নাতাশা বৃষ্টিভেজা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় দিয়ে একজন মানুষ মাঠ পেরিয়ে ভেতরে এলেন। নাতাশা তাকিয়ে দেখল, সারার বাবা। এবার তার সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও সারাকে সে একটুও পছন্দ করে না, কিন্তু সারা চলে গেলে সে একদম একা হয়ে যাবে। সারা গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াল বাবার কাছে। আস্তে আস্তে কী কী যেন বলল। কথা শেষে তার বাবা এগিয়ে এলেন নাতাশার কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে নিতে আসেনি মা? নাতাশা ছোট্ট করে বলল, না আঙ্কেল। আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে? কখন আসবেন? নাতাশা বলল, জ্বি। কথা হয়েছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। আসতে দেরি হবে বলেছে। কত দেরি জানি না। আঙ্কেল তার ফোনটা বের করে নাতাশার হাতে দিয়ে বললেন, নাও। তুমি আবার ফোন কর। নাতাশা আম্মুকে ফোন করল। আম্মু জানাল, এখনও আরও এক ঘণ্টা লাগবে আসতে। ফোন রেখে নাতাশা মাথা নিচু করে ফেলল। তার খুব বেশি কান্না পাচ্ছে। আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল আম্মু? নাতাশা মাথা না তুলেই বলল, বলেছে আরও এক ঘণ্টা লাগবে। সারা বলল, বাবা, আমরা চলে গেলে নাতাশা একা হয়ে যাবে। আন্টি না আসা পর্যন্ত আমরা থাকি? তার বাবা বললেন, হ্যাঁ মা, আমরা থাকব। নাতাশাকে একা রেখে কীভাবে যাই? তারপর বললেন, দুপুর তো হয়ে গেছে, তোমরা কিছু খাওনি। তোমরা দুজনে বোসো, আমি খাবার নিয়ে আসি। নাতাশা বা সারাÑ কেউ কিছু বলার আগেই আঙ্কেল ছাতা মাথায় দিয়ে মাঠে নেমে গেলেন। নাতাশা চুপ করে বসে রইল। সারার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। কী বলা উচিত সে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। সারা লেখাপড়ায় খুব একটা ভাল না। আর ওর গায়ের রঙ চাপা। শুধু এই কারণে নাতাশা কখনও ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেনি। সারা অনেকবার নিজে নিজে কথা বলতে এসেছে, নাতাশা কথা না বলে এড়িয়ে গেছে। সে সবসময় ফার্স্ট হয় ক্লাসে। আর তার গায়ের রঙ দুধের মতো। লেখাপড়ায় ভাল না, আবার গায়ের রঙ চাপা- এমন একটা মেয়ে কীভাবে তার বান্ধবী হয়? একদিন সারা নাতাশার কাছে এসেছিল একটা অংক বুঝতে। নাতাশা বলেছিল, আমি খারাপ স্টুডেন্টদের অংক বোঝাই না। তাতে করে আমি নিজেই অংক ভুলে যাব। আরেকবার নাতাশা তার জন্মদিনে ক্লাসসুদ্ধ সবাইকে কেক খাইয়েছে। সারাকে খাওয়ায়নি। কিন্তু আজকে তার বান্ধবীরা কেউ তার জন্য অপেক্ষা করেনি। সবাই চলে গেছে। অথচ সারা শুধু তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। নাতাশার আবার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এবার আম্মু না আসার জন্য না, সারার সঙ্গে তার ব্যবহারের কথা মনে করে। নাতাশার ভাবনা ভাঙল আংকেল ফিরে আসায়। আংকেল একটা বার্গারের প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বললেন, আর কিছু পেলাম না কাছেপিঠে। এটাই খেয়ে নাও মা। নাতাশা ভেজা চোখে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ আংকেল। সারার দিকে তাকাল সে। সারা চুপচাপ বার্গার খাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে নাতাশার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, সাহস পাচ্ছে না। নাতাশাও কিছু বলতে পারল না। এতদিন যার সঙ্গে কোন কথাই সে বলেনি, তার সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করা উচিত সে বুঝতে পারছে না। আম্মু এল এক ঘণ্টারও পরে। আম্মুর শাড়ি ভেজা। বলল, রাস্তায় পানি জমে গেছে। পানিতে শাড়ি ভিজে গেল। চলো নাতাশা। তারপর সারা আর তার বাবার দিকে তাকিয়ে নাতাশাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কে নাতাশা? নাতাশা বলল, ওর নাম সারা আম্মু। আমার সঙ্গেই পড়ে। এতক্ষণ ধরে ও আর আংকেল অপেক্ষা করছে তোমার আসার জন্য। আমি একা থাকব বলে চলে যায়নি। আম্মু কৃতজ্ঞতাভরা চোখে সারা আর তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। আপনারা না থাকলে নাতাশাকে একদম একা থাকতে হতো। অনেক কষ্ট করলেন ওর জন্য। আংকেল হাত নেড়ে বললেন, না না ভাবি। এটা কোন ব্যাপার না। নাতাশাও তো আমার মেয়ে। আম্মু নাতাশাকে জিজ্ঞেস করলেন, সারা তোমার ক্লাসে পড়ে? কই, ওর কথা কখনও বলেছ বলে তো মনে পড়ছে না। ও কি নতুন ভর্তি হয়েছে? নাতাশা একটু সরে সারার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার হাত ধরে বলল, না আম্মু। আমরা প্রথম থেকেই একসঙ্গে পড়ি। তোমাকে বলিনি সারার কথা? তাহলে হয়ত ভুলে গেছি। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কথাটা বলে সে সারার দিকে তাকাল। সারার চোখে বিস্ময়, আর নাতাশার চোখে পানি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ১০ম শ্রেণী (ইংরেজী ভার্সন) অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×