ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিময় শৈশব

ছেলেবেলার সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে ‘কংক্রিটের বনে’!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৬ আগস্ট ২০১৬

ছেলেবেলার সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে ‘কংক্রিটের বনে’!

সমুদ্র হক ॥ ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো এখন কত দূরে আর আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে...’ ছেলেবেলার দিনগুলোর মতো মধুমাখা দিন কি আর আছে! বাড়ির আঙিনা, স্কুলের মাঠে কত না খেলা, কতই না দুষ্টুমি! ইচ্ছে হলে ধুলোয় লুটোপুটি। কানামাছি ভোঁভোঁ খেলে কেটেছে কতই না সময়। কখনও গাছের শাখায় দড়ি ঝুলিয়ে দোলনা বানিয়ে ‘দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি বর আসবে এখনই নিয়ে যাবে তখনই’ ছন্দের কবিতায় দোল খাওয়া। ছেলেবেলার খেলার মধ্যে ছিল কবিতার ছন্দ! কাগজ ছিড়ে নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দেয়া। আরও কত কি! আজ যারা মধ্যবয়সী তারা স্মৃতিতে অতীতকে ফিরে পাওয়ার নিঃশব্দে নস্টালজিক হয়ে যেতে পারেন। সেদিনের শিশুবেলার সঙ্গে আজকের শিশুবেলার কত পরিবর্তন! শহরে জীবনে কংক্রিটের বনে আঙিনা নেই। স্কুলে খেলার মাঠ নেই। যা আছে তাও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ জীবনের আঙিনায় শিশু- কিশোরদের খেলার সেই দিনগুলোও বুঝি হারিয়ে গেল। প্রযুক্তির যুগে যন্ত্র এনে দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ। ছেলেবেলার ভাবনাগুলো কখনও মুছে যায় না। বড় হয়েও সেই ভাবনা রয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে আছে “খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি মনের গভীরে...”। সেই খেলাঘরও বুঝি হারিয়ে যেতে বসেছে। আজকের শিশু জন্মগ্রহণ করে বেড়ে ওঠে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাও ঘরের আঙিনা, মেঠো পথ, নদীর তীর ও ঢেউ, গাছগাছালি ঝাউবন, নীল আকাশে মেঘের ভেলা, ভরা চাঁদের পূর্ণিমা, শুকতারা, দূরের আলোকছটার কোন গ্রহ দেখে। কিছুটা হলেও প্রকৃতির সান্নিধ্য পায়। শহরের ছেলেমেয়েরা বেড়েই ওঠে হাইরাইজ ভবনে। যেখানে বিকালের সোনামাখা রোদ তো দূরে থাকা লুকোচুরিও খেলে না। অথচ অরূপের অন্ধকার থেকে মর্ত্যে আগমনের সঙ্গে এই শিশুদের ওপর আলোর বিন্দু এসে ঝরে পড়ে রূপের জগতে। কৈশোর থেকে যৌবনের সময়টির দাপট এতটাই যে সব অসম্ভবই সম্ভব, সব অগম্য গম্য। এমনই ধারায় বেড়ে ওঠা শিশুরা নিজেদের আঙিনায়, গ্রামের স্কুল ঘরের মাঠে, সদ্য ধান কাটা জমির নাড়ার ওপর আপন মনের খেয়ালে ছুটোছুটি দৌড়ঝাঁপ করে এগিয়ে যায় তারুণ্যের দিকে। তারুণ্যের বেলায় যে জেন্ডার রিলেশন্স নিয়ে সর্বকালেই ভাবা হয় শিশু বেলায় তা প্রকৃতির মধ্যেই গড়ে ওঠে। ছেলেমেয়ে একসঙ্গেই খেলে। হারজিত নির্ণয় হয় একই ভাবে। যেখান থেকে মানুষ নিজেকে ভাবতে শেখে। যেমন মেয়ে শিশু খেলনাপাতি হাঁড়ি পাতিল পুতুল ইত্যাদি নিজের সম্পদ বলে মনে করে। যতœ করে। আগলে রাখে। পুতুল খেলা নিজেকে চিনতে শেখায়। কতই না খেলা ছিল। শিশু মনের গভীরে থাকা ভাবনাগুলো প্রকাশ পেত কাগজ দিয়ে কিছু বানানোর মধ্যে। উড়োজাহাজ বানিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মজাই ছিল আলাদা। মনে হতো সুদূর নীলিমায় উড়ে যাওয়া। কেউ কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিত বৃষ্টির পানিতে। সেই নৌকা এগিয়ে গেলে সে কি আনন্দ। বৌচি, লুকোচুরি খেলা ছিল কিশোর মনের রোমান্টিকতার অন্যরকম অবকাশ। মুখোমুখি বসে পায়ের ওপর পা তুলে তারও পর হাতের কয়েক আঙ্গুল উঁচিয়ে ঝাঁপ দেয়ার ইচিং বিচিং খেলা ভুলেই গেছে অনেকে। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা খেলেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ওপেনটি বায়োস্কোপ খেলা ছিল দুষ্টুমির। কোমরে হাত দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুরÑ দম রেলগাড়ি খেলার সেই ছড়া কি ভোলা যায়। আঙিনায় কাঠি দিয়ে ঘর কেটে বাঘবকরি খেলা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। বাটুল খেলা। চেঙু পানটি খেলা (যা অনেকটা ক্রিকেটের মতো তবে বলের বদলে কাঠি) ছিল দুরন্তপনা। মেয়ে শিশুরা আঙিনায় মইয়ের মতো ঘর এঁকে মাটির হাড়ির ভাঙা টুকরো ফেলে ‘কুতকুত’ শব্দ বলে এক পা ধরে এগিয়ে যাওয়ার খেলা ছিল আনন্দের। গ্রামের প্রায় প্রত্যেক ঘরের মেয়েশিশুর বালিশের নিচে থাকতো দড়ি খেলার উপকরণ। দাড়িয়াবান্ধা খেলা না খেললে শিশু জীবনই যেন বৃথা। ককফাইট খেলার কথা মনে হলে এখনও হাসি পায় অনেকের। এক হাত দিয়ে এক পা টেনে তুলে আরেক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করে তোলা যে কি আনন্দের। হাডুডু (বর্তমান নাম কাবাডি) গ্রামীণ জীবনের অনুষঙ্গের খেলা থেকে বর্তমানে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে স্থান পেয়েছে। গ্রামের মাঠে বড় জাম্বুরা দিয়ে অথবা পুরনো কাপড়ের পোটলা আাঁটেসাঁটো করে বেঁধে ফুটবল খেলা যতটা ছিল প্রতিযোগিতার তারচেয়ে বেশি ছিল আনন্দে দৌড়ে বেড়ানো। ছেলেবেলার সেই দিনগুলোতে মার্বেল খেলা ছিল নেশার মতো। পকেটে দুইটা মার্বেল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যে অনেকগুলো মার্বেল নিয়ে ফিরত তার দেমাগ দেখে কে! খেলা চলাকালে নট আউটকে বলা হতো নটপটকে। মার্বেল খেলত বাড়িতে পিটুনি খায়নি এমন কাউকে পাওয়া যাবে কি! ছোট চিরকুট কাগজে চোর ডাকাত পুলিশ লিখে খেলার কথা কী সহজে ভোলে কেউ। সেদিনের ছেলেবেলার এইসব আনন্দের খেলা নিয়েই বেড়ে ওঠে একেকজন শিশু। সেই শিশু বড় হয়ে উৎসব পার্বণে বা দেশ-বিদেশের কোথাও একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে কি-ই না মধুময় হয়ে ওঠে সেই ক্ষণটি। তখন মনে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের অনুভূতি সেই ছোট্ট বেলার খেলাগুলো। ছেলেবেলার সে-ই খেলাগুলো বুঝি হারিয়েই গেল....। দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে ঘুমিয়ে ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলোও আজ আর নেই।
×