ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ত্র মামলার আসামির কারাগারে বসেও ইয়াবা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৬ আগস্ট ২০১৬

অস্ত্র মামলার আসামির কারাগারে বসেও ইয়াবা বাণিজ্য

মশিউর রহমান খান ॥ গায়ের রং শ্যামলা। শান্তশিষ্ট। বয়স প্রায় ৩০। কথাও কম বলে। কিছুটা নীরবে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। নাম তার আব্দুর রহিম ওরফে রনি। পুলিশের কাছে অস্ত্রসহ ধরা পড়া বিচারাধীন মামলার এই আসামির নামে রাজধানীর শ্যামপুর ও সূত্রাপুর থানায় রয়েছে তিনটি মামলা। বর্তমানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ আটক রয়েছে। ফলে নিয়মিতই তাকে আদালতে আসা-যাওয়া করতে হয়। দেখে বোঝার কোন উপায় নেই এই আসামির পেটে শত শত পিস ইয়াবা রয়েছে। বৃহস্পতিবার মামলার হাজিরা শেষে আদালত থেকে কারাগারে এলেও কারা কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় বিশেষ কায়দায় শুক্রবার সকালে তার কাছ থেকে ৪শ’ ৩০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। তবে কারা কর্তৃপক্ষের ইয়াবা উদ্ধারের পদ্ধতিটি একটু ভিন্ন। এসব ইয়াবা সে তার পেটের ভেতরে করে দুটি আলাদা আলাদা পলিথিনের মাধ্যমে মুড়িয়ে বহন করে নিয়ে এসেছে, যা মলদ্বার দিয়ে বের করা হয়। আদালতে হাজিরা শেষে এসব ইয়াবা সে পলিথিনে মুড়িয়ে কয়েক ঘণ্টায় গলাধঃকরণ করে। পরে সময়-সুযোগ মতো টয়লেটে গিয়ে তা বের করে আনে। আদালতে হাজিরা শেষে কোন বন্দীর বিভিন্ন প্রকারের মাদক বহনের চেষ্টা নতুন ঘটনা হলেও পেটের ভেতরে করে ইয়াবা বহন! তাও আবার ৪শ’ ৩০ পিস, যা কারা ইতিহাসে প্রথম। জানা গেছে, এর আগে এত বিপুল পরিমাণ ইয়াবা দেশের কোন কারাগারে কোন আসামির কাছ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন। তার মতে, কারাবন্দীরা বিশেষ পদ্ধতিতে পেটের ভেতরে করে ইয়াবা বহন করে নিয়ে আসবে, এটা আমরা কোনভাবেই কল্পনা করিনি। এজন্যই আমরা বিমানবন্দরের মতো সকল বন্দীর দেহ তল্লাশির কাজে বডি লাগেজ স্ক্যানার কেনার পরিকল্পনা করছি। যার মাধ্যমে যে কোন বন্দীর সঙ্গে এমনকি শরীরের ভেতরে কী আছে, তা স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। এর মাধ্যমে কারাভ্যন্তরে বন্দীরা কোনভাবেই মাদক বা অবৈধ কিছু নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। জানা গেছে, কারাভ্যন্তরে নিয়মিত নেশা করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু অতি ধূর্ত এই বন্দী এতদিন কারারক্ষী ও কারা গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিতই ইয়াবা সেবন করে আসছিল। তবে এবারই প্রথম কারাভ্যন্তরে দায়িত্বরত কারা গোয়েন্দাদের হাতে ৪শ’ ৩০ পিস ইয়াবাসহ ধরা পড়ল। তবে এসব ইয়াবা কারারক্ষীরা এত সহজেই খুঁজে পাননি। অবশ্য না পাওয়াই স্বাভাবিক। কারা সূত্রে জানা গেছে, কারা গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আসে যে, আসামি আব্দুর রহিম রনি মাদক বহন করে নিয়ে এসেছে। কারা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক তল্লাশি শেষে তার কাছে কোন মাদক খুঁজে পায়নি। ফলে কারা কর্তৃপক্ষ সন্দেহজনকভাবে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজিরা শেষে তাকে তার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে না পাঠিয়ে আলাদা কক্ষে আদালতে হাজিরা দেয়া কয়েকজন আসামির সঙ্গে রাখেন। নজরদারিতে রাখা হয় তার রাতের সার্বিক কার্যক্রম। এরপর রহিম সকালে টয়লেটে যাবে বলে শরীর মুচড়ানো শুরু করলে কারা কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। এমতাবস্থায় তাকে মাদক বহন করেছে কি-না, তা কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হলে একপর্যায়ে সে পেটের ভেতর ৪শ’ ৩০ পিস ইয়াবা নিয়ে এসেছে বলে স্বীকার করে। পরে তাকে টয়লেটে পাঠিয়ে দুটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ইয়াবাগুলো উদ্ধার করা হয়, যা মলদ্বার দিয়ে বের করা হয়। কারা সূত্র জানায়, সব আসামির মতো এই আসামিকেও নিয়মিত মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে আনা-নেয়া করা হয়। কিন্তু রনির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অন্যান্য সময় হাজিরা শেষে আদালত থেকে এলেই তার পেট অনেকটা ফুলে থাকতে দেখে অন্য কারাবন্দীরা; কিন্তু কেন ফুলে রয়েছেÑ এ বিষয়ে কারও সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না। তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে হাজিরা দেয়া অন্য বন্দীরা জানায়, কারাগারে পৌঁছার পর থেকেই তার অস্থিরতা শুরু হয়। তবে এ অস্থিরতা বেশিক্ষণ থাকে না। এজন্য তাকে আদালতের হাজিরা শেষেই টয়লেটে যেতে হয়। এরপরই অস্থিরতা কেটে যায়। আবার শান্তশিষ্ট হয়ে যায় সে। মূলত দেখে বোঝার কোন উপায় নেই এই লোকটির দ্বারা অনেক অসাধ্য কাজও সাধন করা সম্ভবÑ সেটা কারাগার, আদালত কিংবা কারাগারের বাইরের কোথাও। আদালত থেকে এলেই স্বাভাবিক খাবারের বাইরে কী কী খাবার পছন্দÑ সঙ্গী কোন আসামি জানতে চাইলে কোন চাহিদার কথা কাউকে বলে না। শুধু পানি খায় তাও আবার খুব কম পরিমাণে। কারাভ্যন্তরে অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কতার সঙ্গে এসব ইয়াবা নিজেও খায় অন্যদেরও খাওয়ায়। এর বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে অর্থও নেয়। আসামি রনি গত বছরের মার্চ থেকেই কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছে। এর আগে সে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এর জেলার মোঃ নাসির উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, অস্ত্র মামলায় বিচারাধীন আসামি আব্দুর রহিম আদালত থেকে ফেরার পথে মাদক বহন করেছেÑ কারা গোয়েন্দাদের পূর্বের দেয়া এমন তথ্য অনুযায়ী আদালত থেকে আসার পরপরই তাকে কঠোর তল্লাশি করা হয়। কিন্তু তার কাছে কোন মাদক পাওয়া যায়নি। তবে সন্দেহজনকভাবে তাকে তার থাকার নির্দিষ্ট কক্ষে না রেখে আলাদা কক্ষে রাখা হয়। পরে শুক্রবার সকালে তাকে মাদক বিষয়ে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু হলে একপর্যায়ে সে আদালত থেকে ফেরার পথে বিশেষ পদ্ধতিতে পেটের ভেতরে করে ইয়াবা বহনের কথা স্বীকার করে। এরপর তাকে টয়লেট করানোর মাধ্যমে মলদ্বার দিয়ে বের হওয়া দুটি পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ৪শ’ ৩০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। কারা ইতিহাসে বিশেষ পদ্ধতিতে এত বিপুল পরিমাণে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা এটাই প্রথম।
×