ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমরা তোমায় ছাড়ব না

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৬ আগস্ট ২০১৬

যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমরা তোমায় ছাড়ব না

রবীন্দ্রনাথের সৌভাগ্য একাত্তরে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। মাড়োয়ারী সংস্কৃতির চাপে ঠাকুরের নাভিশ্বাস ওই বাংলায়। এই ফেব্রুয়ারিতে আমি কলকাতা থেকে আসার আগের দিন জোড়াসাঁকো গিয়েছিলাম। এর চেয়ে বড় তীর্থ আমার জন্য অন্তত নেই। যে ট্যাক্সিওয়ালা নিয়ে গিয়েছিল পাঁড় ঘটি, বাঙালী হলেও কথা বলে চ চ উচ্চারণে। পথে তাকে ট্রাফিকের জরিমানা গুনতে হয়েছিল। টাকার অঙ্কটা আমাদের পুরোদিনের ভ্রমণভাতার কাছাকাছি হলেও তার কোন দুশ্চিন্তা দেখিনি। বলেন : ও আমার বাবু দেবেন। আমি তো ড্রাইভার গো। বেচারা বাঙালীর এই দুর্দশার মূল কারণ কিন্তু ঠাকুরবাড়ী না চেনা। আমি খুব অবাক হয়েছি মধ্যবয়সী এই ভদ্রলোক জন্মসূত্রে কলকাতার আদি বাসিন্দা হওয়ার পরও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী চেনেন না। করেন কিন্তু পর্যটকদের দেখভাল। তাদের গাড়ি করে কলকাতা চষিয়ে বেড়ানো তিনি ঠাকুরবাড়ী কোথায় কতদূরে এসব প্রশ্ন করে এগোতে এগোতে ভুল টার্ন নিয়েই জরিমানা গুনেছিলেন। ঠাকুরবাড়ীতে আগত অতিথি বা দর্শনার্থীর সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। ছুটির দিনে কলকাতার মানুষ ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু হয় তাদের সবাই জোড়াসাঁকোর এই বাড়িটি দেখে ফেলেছেন, নয় তো আগ্রহী নন। মজার ব্যাপার মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ আর প্রিন্স দ্বারকানাথের এই চমৎকার ভবনের আশপাশে এখন বাংলায় কথা বলা লোকের সংখ্যাও হাতেগোনা। যাকেই বলি হাত উঁচিয়ে বা মুখ ঘুরিয়ে বলেন, মুঝে পাতা নাহি হ্যায়। সেদিক থেকে আমাদের শিলাইদহ অন্তত কয়েকদিনের জন্য হলেও ঝলমলে। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের যে সম্মান ও শ্রদ্ধাজড়িত জায়গা সেটি এখনও অম্লান। বলাবাহুল্য, এর পেছনে আছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। তিনি এদেশ স্বাধীন করার আগেই বলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ হবেন জাতীয় সঙ্গীতের জনক। দেশের পরিচয় বদলালেও মাটি তো বদলায় না। সে একই মাটিতে নিষিদ্ধও হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পেছনে তাকিয়ে দেখুন যারা নিষিদ্ধ করেছিল তারা বাংলা জানত না। বাংলায় কথাও বলত না। তাদের এই আপত্তির কারণ ধর্মীয় পরিচয়। হিন্দু না হওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখনও হয়ে থাকেন। সে আমলে তাঁকে যারা আইনীভাবে নিষিদ্ধ করেছিল তারা যতটা না দায়ী তার চেয়ে অধিক দায়ী আমাদের ভেতরের মানুষরা। যারা বাঙালী, যারা বাংলায় কথা বলেন, যাদের ভাষা সাহিত্যচর্চা এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ঠাকুরের প্রভাব অপরিসীম, যারা কথায় কথায় আপদে বিপদে সঙ্কটে সম্ভাবনায় তাঁর গান কবিতা লেখা ছাড়া চলতেন না সেসব মানুষ তাঁকে নিষিদ্ধ করার পেছনে কাজ করেছিল। কী এক সীমাহীন বৈপরীত্য। এদের জ্বালায় সংস্কৃতি প্রায় পঙ্গু ও বিকৃত হওয়ার কালে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার সচেতন সমাজ। বুদ্ধিবৃত্তির এক বিরাট অংশ আর সাধারণের কারণেই রাজনীতি তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল স্বমহিমায়। সেটাই কিন্তু বাংলাদেশ। কিন্তু আজ? আজ কি আমরা সে জায়গায় আছি? সর্বাধিক প্রচারিত বলে বুক ফোলানো দৈনিকের সাহিত্য পুরস্কারের নাম জীবনানন্দ পুরস্কার। যাকে দেয়া হয়েছে তার কবিতা পাঠ করলে জীবনানন্দকে ট্রামের তলায় পড়ে প্রাণ দিতে হতো না। তিনি এমনিতেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের মা বাবা চৌদ্দগুষ্টি তুলে গালাগাল আর অশ্রাব্য অশালীন ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করার লোকটিকে কেন বেছে নিয়েছিল তারা? তারা কি না জেনে না পড়ে এই পুরস্কার দিয়েছিল? আসলে এর আসল নাম বদলে যাও বদলে দাও। বদলে দেয়ার বাংলাদেশে এখন রবীন্দ্রনাথকে কেউ নিষিদ্ধ করবে না হয়ত; কিন্তু তাঁর অসম্মান করতেও দ্বিধা করবে না। আমার তো ধারণা এবার যদি তাঁর ওপর কোন খড়্গ নেমে আসেও তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ার মানুষও পাব না আমরা। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির দেউলিয়াপনা এতটাই তারা এখন তারুণ্যের জঙ্গীবাদী মনোভাবকেও জায়েজ করতে ব্যস্ত। যেসব মানুষ এককালে বাম ডান মধ্যপন্থার রাজনীতি করলেও ভেতরে সংস্কৃতি লালন করতেন তাদের সামনে এখন অন্ধত্বের হাতছানি। তারা অন্তর থেকে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে পারছেন না। গণভোট বা জনগণের অজ্ঞানতার ফাঁকে তিনি ও তাঁর জাতীয় সঙ্গীত কোনদিন যে বিপদে পড়বে না তার কি আসলেই কোন গ্যারান্টি আছে? এছাড়াও তিনি এখন আর চর্চায় উজ্জ্বল নন। পশ্চিমবঙ্গের যত নিন্দাই করি না কেন তারাই জন্ম দিচ্ছে শ্রীকান্ত বা শ্রাবণী সেনের। সেখানে পাচ্ছি জয়তীকে। আমরা বন্যা বা শাদীর পর আর এগোতে পারিনি। এটা কিন্তু পর্যালোচনার বিষয়। যে পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে সেক্যুলার ছিল, তার রাজনীতি ও সমাজ ছিল প্রগতিশীল, ততদিন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের চর্চাও ছিল মুক্ত। ঘেরাটোপে ফেলে তাদের হীনবল করার পাশাপাশি আজ আমরা নিজেদের সর্বনাশও ডেকে এনেছি। রবীন্দ্রনাথ থাকলে জঙ্গীবাদ আসতে পারে না। তাঁকে শোনা বা জানার জায়গাটুকুও আমরা কূটতর্কে ভাসিয়ে দিয়েছি। দূর প্রবাসে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বাঙালীর প্রশ্নে আমি থ বনে গিয়েছিলাম। তার এক কথা রবি ঠাকুর কেন হামদ নাত লেখেননি? সে আলোচনা সভায় ছিলেন বিলেত প্রবাসী অগ্রজ লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি ভালই উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে, বাংলা হামদ নাত কাকে বলে জানতে হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ভেবে দেখুন কি বিপদে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর জন্মভূমিতে না তিনি সর্বজনের, না বাঙালীর। ভারতীয়রা তো জনগণ মন অধিনায়ক গানটিকে এমনভাবে গায় শুনে মনে হবে হিন্দীতে লেখা। কিছু বললে বলে হিন্দী একসেন্ট। বটে, ইংরেজী গান গাইবারকালে কেন একসেন্ট বা উচ্চারণ বদলান না আপনারা? তার জবাব তারা দেবেন তাদের দেশ বুঝবে। আমার ব্যক্তিগত মতে ইনি যদি অন্য কোন সভ্য বা একক জাতিতে জন্মাতেন আজ তাঁর খ্যাতি আরও ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী হতো। তারপরও তিনি আছেন, থাকবেন। বাংলাদেশের মাটি আকাশ হাওয়ার সঙ্গে কী অপূর্ব যোগাযোগ তাঁর। আজও আমাদের মন খারাপে তিনি আশ্রয়। মন ভালতে উজ্জ্বল উদ্ধার। আমার মতো অযুত বাঙালীর ঈশ্বরতুল্য। বাঙালী ললনার মনে মনে আরাধ্য এক প্রেমিক তিনি আজ যখন রক্ত অশ্রু আর কান্নার স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার এমন অশান্ত অকল্যাণ রূপ দেখে আমরা তাঁর ভাষায় বলি : বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। এই মানুষটি তাঁর গদ্যে এক অমোঘ বাণী দিয়ে গেছেন আমাদের। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সে পাপ করব না বলেই এখনও মনে করি রবীন্দ্রনাথই আমাদের বাঁচাবেন। শ্রাবণের অঝোর ধারায় বাংলাদেশ বাঙালীকে কাঁদিয়ে যাওয়া কবি চেয়েছিলেন জ্ঞান হবে মুক্ত। চিত্ত হবে ভয়হীন। উচ্চ হবে শির। আজ এই মহাসঙ্কটের মহাক্রান্তিকালে তাঁকে ধারণ করলে কোন যুবক কাউকে হত্যা দূরে থাক গায়ে চিমটিও কাটতে পারবে না। তাঁকে কি আর একবার নিজেদের করে নেব আমরা?
×