ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আয়তি নাহার

নারী ও শিশুপাচার

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৫ আগস্ট ২০১৬

নারী ও শিশুপাচার

দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে তার আসন মজবুত করলেও অনেক ধরনের সমস্যার বেড়াজাল থেকে আজ অবধি দেশটি মুক্ত হতে পারেনি। অর্থনীতির চাকা নিরন্তর সামনের দিকে এগুলোও নানা সঙ্কট আজও বিদ্যমান। গ্রামে-গঞ্জে অর্থনৈতিক দৈন্য, প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ, সমাজ কর্তৃক আরোপিত বহুবিধ শৃঙ্খল অসহায় মানুষদের চারপাশে যে সঙ্কটের আবর্ত তৈরি করেছে সেখানে নারী-পুরুষ সবার অবস্থাই সঙ্গীন। সমাজের অর্ধাংশে নারী জাতির সিংহভাগকেই মেনে নিতে হয় মানবেতরজীবন। দুর্বল অংশ হিসেবে নারীর যে অসহায়ত্ব, বিপর্যস্ততা, বিপন্নপ্রায় অবস্থা সেখান থেকে কিছু অংশ বেরিয়ে আসলেও বাকিরা সবাই সমাজ-নিষ্পেশনের শিকার। গ্রাম-বাংলা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ মেয়েদের জীবন যে কত সমস্যাসঙ্কুল তা বিভিন্ন আলোচনা, পর্যালোচনা এবং গবেষণায় প্রতীয়মান হয়। সেই মধ্যযুগীয় কায়দায় নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের যে চিত্র বেরিয়ে আসে তা যেমন অমানবিক, তেমনি বিবেকবর্জিত। নিজের দেশের গ্যাঁড়াকলে নির্মমতার শিকার হতে হয় নারীকে নানামাত্রিকে। বাল্যবিয়ে, অকাল বৈধব্য, স্বামী পরিত্যক্তা সর্বোপরি সম্পত্তি থেকে অধিকার হরপের মধ্য দিয়ে। তার উপর নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হয়। বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার মতো নির্মম ঘটনা। বিশ্বজুড়ে নারী পাচারের এক ভয়ঙ্কর অবস্থার বিপাকে বাংলাদেশের নারীরাও। পথপ্রথার নিষ্ঠুর হিসাব-নিকাশে অসহায় মেয়েদের বলি হওয়ার নজির গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে। কন্যাদায়গ্রস্ত, পিতার করুণ আর্তনাদও নতুন কিছু নয়। এ ধরনের সামাজিক সমস্যাকে মোকাবেলা করতে যেয়ে নারীরা মুখোমুখি হয় পাচারচক্রে। চাকরি এবং বিবাহের মোহে নারীরা এই চক্রান্তের শিকার হয়। যৌতুকের দাবিতে বিয়ে না হওয়া মেয়েকে অসহায় পিতা পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়া হয় চাকরির জন্য নয়ত বা বিয়ে করে ঘর-সংসার পাতার জন্য, পিতা-মাতা এবং কন্যা যে দুর্দশার কবলে পড়ে তা থেকে বেড়িয়ে আসার কোন পথ আর সামনে খোলা থাকে না। বিয়ে কিংবা চাকরি তো কেবলমাত্র টোপ দেয়া। মূলত এসব নারীদের নিয়ে যাওয়া হয় দেহ ব্যবসায়, শ্রমঘন কোন কলকারখানায় কিংবা কোথাও কোন গৃহপরিচারিকার কাজে। এসব কাজে একবার নিজেকে সমর্পণ করার পর পেছনে ফিরে তাকানোর আর কোন সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশের এই পাচারকৃত নারীরা মূলত ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, বার্মা এসব দেশে চলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশেও বাঙালী মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়। সীমান্ত এলাকা এবং আকাশপথে এদেশের নারীরা অন্যদেশে চালান হয়ে যায়। কলকাতা, বোম্বে, করাচী, দুবাই, সৌদি আরব, আবুধাবিসহ আরও অন্যান্য দেশে বাঙালী নারীদের নিয়ে যাওয়া হয়। অপেক্ষাকৃত বেশি সুন্দরী মেয়েদের অবস্থান একটু ভাল হলেও তারা নিদেনপক্ষে রক্ষিতার জায়গাটুকু নিতে পারে। কোন সামাজিক সম্মান নয়, ধর্মীয় মর্যাদা, আইনগত কোন বিধিবহির্ভূত অবস্থায় তাদের অন্ধকার জীবনের নির্মম অধ্যায়ের পালাবদল হতে থাকে। এই মানবেতর, বিবেক বর্জিত, দীনহীন, বীভৎস জীবন থেকে তাদের মুক্তি আর কখনই মেলে না। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপট নারীদের এই অসম্মানের, কলঙ্কজনক অধ্যায়ের যে অশুভ ধারা শুরু হয় তার দায়ভাগ কি শুধুই নারীর কিংবা তার পরিবারের? সামাজিক দায়বদ্ধতা কি একেবারেই নেই? যেমনি পৃথিবীব্যাপী তেমনি দেশের ভেতরেই এসব সক্রিয় পাচারচক্র বিরাট অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের ঘৃণ্য, ন্যক্কারজনক, অমানবিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। যদিও প্রচলিত আইন অনুযায়ী এসব অপরাধের বিধান আছে। দেশের আইন, বিচার ব্যববস্থাকে তোয়াক্কা না করে এসব হীন চক্রান্তকারী দল বিশ্বব্যাপী তাদের এসব নারী ব্যবসা চালিয়ে যায়। ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে তারা বেড়িয়ে আসে। অপরাধী চক্রের বিচার না হলে অপরাধ প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে যায় এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধুমাত্র নারীপাচার নয়, শিশুশ্রম ও পাচারকারীর অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। মরু অঞ্চলে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের রশি টেনে উটকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আজ সবার সামনে উন্মোচিত। বাংলাদেশের অবোধ, দুস্থ, নির্বিত্ত শিশু-কিশোররাও এ চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পড়ে। সস্তা শ্রমের বিনিময়ে এসব শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন শ্রমঘন কলকারখানায় অমানবিকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের পাচার করে যে পরিমাণ অর্থ পাচারকারীরা পায় তার সিকিভাগ টাকাও পায় না এসব অসহায়, দুস্থ শিশু-কিশোররা তাদের মূলবান শ্রম বিনিয়োগ করে। শিশু-কিশোর অপহরণকারী চক্ররা অনেকবার ধরা পড়লেও সেখান থেকে বের হয়ে এসে একই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। আইনী বাঁধায় শিশুশ্রম অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। তারপরেও নির্দ্বিধায়, দাপটের সঙ্গে পাচারচক্র শিশু-কিশোর শ্রমকে নিয়ে অর্থে নেশায় মেতে ওঠে। নিষ্ঠুর, অমানবিক পর্যায়ে এসব শিশু-কিশোরদের ওপর শ্রমের কষাঘাত পড়ে। এসব রিক্ত, নিঃস্ব, শ্রমাঘাতে কাতর অসহায় শিশু-কিশোররা আর কতদিন এমন দুর্ভোগের শিকার হবে? নারী ও শিশু-কিশোর পাচার চক্রের দুর্ভেদ্য, অতল গহবর থেকে মুক্তি পাবার পথ কি তারা কখনও খুঁজে পাবে?
×