ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

শান্ত, স্নিগ্ধ কুমু রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৫ আগস্ট ২০১৬

শান্ত, স্নিগ্ধ কুমু রবীন্দ্রনাথের এক অনন্য সৃষ্টি

গোটা উনিশ শতক জুড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের গর্ভে বণিকতন্ত্রের যে বীজ উপ্ত হয়, মূলত তা পাশ্চাত্যের ধারায় হয়নি। ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাস এবং সংমিশ্রণ উপাদানে গঠিত বাংলা তথা ভারতবর্ষে যে নতুন সমাজ কাঠামো তৈরি হতে থাকে তার সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অনিবার্যভাবেই চলে আসে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম। আধুনিক কৃতী পুরুষ এবং স্মরণীয় শিল্পোদ্যোক্তা প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় কোন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। এমনকি তাঁর পুত্র মহর্ষির কাছেও নয়। আর প্রতিভাবান পৌত্র রবীন্দ্রনাথ তো জীবনভরই নীরব থেকেছেন ঠাকুর দাদা সম্পর্কে। ফলে উঠতি বণিক শ্রেণীর প্রতি ক্ষোভ এবং অনীহা ঠাকুরবাড়ির মধ্যেই অঙ্কুরিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ শুধু সৃষ্টিশীলই নন, উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারও। ফলে তাঁর শ্রেণী চেতনা তাঁর সৃজনসৌধের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই কারণে জমিদার ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষণ এবং আগ্রহ তাঁকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস সেই সম্ভাবনারই দিকনির্দেশনা। একদিকে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বিপ্রদাস এবং অন্যদিকে উঠতি বণিক মধূসুদনের শুধুমাত্র চারিত্রিক বৈপরীত্যই নয়, আছে দুই আর্থ-সামাজিক কাঠামোর সংঘর্ষ এবং বিবাদ। আর কেন্দ্রীয় চরিত্র কুমুদিনী সেই সমকালেরই উত্তরাধিকার। জমিদারতন্ত্রের সংস্কার জালে আবদ্ধ কুমু আধুনিক ভাব সম্পদেও সমৃদ্ধ। কোন বিপ্লব নয়, সুউচ্চ কণ্ঠে কোন বিদ্রোহও নয়, নিঃশব্দে, ঠা-া মাথায় কুমুর যে লড়াই তা যেন রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিচ্ছায়া। কুমুকে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেন তাঁর আদর্শিক চেতনা এবং আবেগ-অনুভূতির স্পর্শকাতর কোমল আন্তরিক নিবেদনে। ঐশ্বর্য সমৃদ্ধ জমিদারির পড়ন্ত বেলায় বিপ্রদাস তাঁর কনিষ্ঠ বোন কুমুদিনীকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বিপ্রদাসের আদর্শে গড়া কুমু আঠারো বছরে পা দিলে দাদা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন পাত্রস্থ করার জন্য। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও কুমু নবজাগরণের ছোঁয়াটিও পায় না। বই পড়ে, সংস্কৃতি চর্চা করে এবং পূজা-পার্বণে নিজেকে নিবেদিত করে কুমুর দিন কাটে। উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদনের সঙ্গে কুমুর বিয়ের প্রস্তাব যখন ঘটক নিয়ে আসে প্রথমে দাদার প্রচ- আপত্তি ছিল। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক আদর্শে গড়া কুমু অদৃশ্য দৈব শক্তির সঙ্কেতে বিয়েতে নিজেও রাজি হয় এবং দাদার সম্মতিও আদায় করে। এরপর বিয়ে থেকে আরম্ভ করে স্বামীগৃহে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি সে নিতে থাকে। জমিদারতন্ত্রের ভাবাদর্শে গড়া কুমুর দৃঢ় ব্যক্তিত্বে কোথায় যেন নবজাগৃতির কিরণও ঝিলমিল করছে। আধুনিক চেতনা, স্বাধীন মনোবৃত্তি, ইচ্ছে-অনিচ্ছার আকাক্সক্ষা ও বিরোধ থেকে আরম্ভ করে নব-ধারার অনেক মনন কুমুর মধ্যে সব সময়ই প্রত্যক্ষ করা যায়। ভালবাসা ও নিজেকে সমর্পণ করা একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতি এবং ইচ্ছার ব্যাপার এর অন্যথা এবং জবরদখলমূলক মনোবৃত্তি কুমুকে তার ইচ্ছের বিপরীত নিয়ে যায়। স্বামী তার দেবতা কিন্তু প্রভু নয়। এই বোধকে সামনে রেখে কুমু কখনও কোন অন্যায় জবরদস্তিকে মেনে নিতে পারেনি। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যেও সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়। লজ্জায় আর বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে শুভদৃষ্টির সময় সেভাবে স্বামীদর্শনও হয়নি। বিয়ের পর পরই কুমুর আশা ভঙ্গ এবং স্বপ্নচ্যুতির বেদনা তাকে সত্যিই এক বিপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। তার পরেও স্বামীর কোন অকারণ আবদার এবং অবিচারকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। তবে তার কোন সরব উচ্চারণ কিংবা উঁচু গলায় আপত্তির কোন নিশানাও সেভাবে দেখা যায়নি। এক অদ্ভুত ধাঁচে গড়া এবং অনমনীয় দৃঢ় চিত্তের ধারক কুমু সত্যিই রবীন্দ্র সৃষ্ট অন্যান্য নায়িকা থেকে একেবারেই আলাদা। মঙ্গল আর মাধুরীর মিলিত শৌর্যে কুমু যেন কবির এক অনবদ্য সম্ভার যে দুই আর্থ-সামাজিক শুদ্ধ ভাবধারায় নিজেকে পূর্ণ করেছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মাঙ্গলিক চেতনায় পরিপুষ্ট কুমু নবজাগরণেরও এক সচেতন পথিক। যা আমরা কুমুর স্রষ্টার মধ্যে সব সময়ই প্রত্যক্ষ করি। কুমুর এই অনমনীয় শক্ত ব্যক্তিত্বের এক সময় ছন্দ পতনও ঘটে। সেটাও নারীর সবচেয়ে অলঙ্কৃত রূপ মাতৃমহিমায়। যে মধুসূদন কিংবা তার সংসার কুমুকে কখনও বাঁধতে পারেনি সেই আলগা এবং অনিচ্ছুক বন্ধন কুমুকে তাড়িত করে অনাগত সন্তানের যথার্থ জন্ম পরিচয় দিতে। কুমু কখনও ভাবতে পারেনি সন্তান তার একার এবং সে মায়ের পরিচয়েই গড়ে উঠবে। এমনকি বিপ্রদাসও না। আর তাই আধুনিক বোধসম্পন্ন কবির সযতœ স্পর্শে গড়া তার আরাধ্য নায়িকা সমাজ-সংস্কার এবং সংসারের ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি। বিপ্রদাসের কাছে ফিরে গিয়েও কুমু তাঁর স্বামীর সংসারে চলে এলো ভাবী উত্তরাধিকারের বংশপরিচয় দিতে। আশা-আকাক্সক্ষা, ইচ্ছে-অনিচ্ছার এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বের টানাপো
×