ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহাশ্বেতা দেবী

হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ৫ আগস্ট ২০১৬

হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস  আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন বাংলা সাহিত্যে নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর মহাশ্বেতা দেবী। তিনি কেবল একজন কালজয়ী কথাসাহিত্যিকই নন, ছিলেন ভারতের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত দলিতজনের বড় সহায়, সহমর্মী বান্ধব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা ও ছত্রিশগড়ের বঞ্চিত আদিবাসী মানুষের সুখদুঃখের সাথী হয়েছিলেন তিনি। তাদের জীবন তাৎপর্যপূর্ণভাবে উঠে এসেছে মহাশে^তার বহু রচনায়। ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’ মহাশ্বেতা দেবীর আলোচিত উপন্যাসের কয়েকটি। কুড়ি বছর আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত উৎসব উপলক্ষে যে ক’জন ভারতীয় সাহিত্যিক বাংলাদেশ সফরে আসেন মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন তাঁদের ভেতর একমাত্র বাঙালী লেখক। তাঁর জন্মও বাংলাদেশে, ঢাকারই জিন্দাবাহারে। ঢাকায় স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি খুবই ব্যস্ত সময় কাটান। এরই মধ্যে এই মহান কথাশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মারুফ রায়হান আপনার জীবনের একটা সময় কেটেছে এই ঢাকা শহরে। পরিচিত শহরে দীর্ঘকাল পরে এলেন, কেমন লাগছে? ‘প্রমা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আমি আত্মজীবনী লিখছি। সেখানে ঢাকার কথা এসেছে। আমার পিতৃকুল মাতৃকুল দুটোই পাবনার নতুন ভরেঙ্গা গ্রামে। আমার ঠাকুরদা আর বাবা দু’জনই সরকারী কাজ করতেন বলে অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়াতে পেরেছিলেন। কলকাতায় পোস্টেড হতেন, আবার একইভাবে বগুড়া, পাবনা ও রংপুরÑ বিভিন্ন জায়গায় কর্মের সুবাদে থাকতে হতো। রাজশাহীতে ঠাকুরদা একটা বাড়িও করেছিলেন। আমার দাদামশাই ঢাকায় থাকতেন। তখন যেমন নিয়ম ছিল সন্তান হবার কালে মেয়েরা বাপের বাড়ি আসত-সেভাবেই আসা-যাওয়া ছিল পনেরো নম্বর জিন্দাবাহার লেনে। সেই বাড়িটা আমি কালকেও দেখেছি পরশুও দেখেছি। বর্তমানে সেটা নয়া সড়ক ফাঁড়ি এবং একেবার একইরকম আছে। সাতচল্লিশ সালের পর এই প্রথম এদেশে এলাম, ঢাকাতে এলাম। পুরনো ঢাকার সামান্যই জানতাম। ৩৬-৩৭ এর পর এসেছি কিনা মনে পড়ে না। বয়স তখন খুবই কম ছিল। হয়ত একবার তেতাল্লিশে এসেছিলাম। আমরা বাড়িতেই থাকতাম, মাঝে মধ্যে একটু বেরিয়ে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া, আরমানিটোলা পিকচার হাউসে যাওয়াÑ এটুকুই ছিল গতিবিধি। কিন্তু এখানে এসে যেটা আমার অসম্ভব রকম ভাল লাগছে সেটা হলো নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, নতুন মানুষÑ সবকিছুই নতুন লাগছে। ঢাকা শহর আমার চোখে খুবই সুন্দর লেগেছে। আমি কিন্তু একটুও নস্টালজিয়ায় ভুগছি না। এই শহরে এত গাছ সত্যি মন ভরে যায়। যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। সাভারে স্মৃতিসৌধে গেছি, এখানে শহীদ মিনারে গেছিÑ একুশে ফেব্রুয়ারির কথা কে ভুলতে পারে বলুন! সিলেটে কমলা বলে একটি মেয়ে ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিল। আমার বাবা তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। ঢাকার ব্যাকগ্রাউন্ডে অনেক কবিতা আছে তাঁর। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’Ñ এরকম বেশকিছু রচনায় আপনি আদিবাসীদের সংগ্রাম ও জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। আদিবাসীদের নিয়ে আপনার লেখার চিন্তা কিভাবে এলো? লেখার চিন্তা থেকে লেখাগুলো লিখিনি। আদিবাসীদের সংগ্রাম, বাঁচার লড়াই, তাদের অস্তিত্ব অর্থাৎ তাদের সমগ্র জীবনধারার সঙ্গে আমি বহুকাল থেকে বহুভাবে জড়িত। এর অনেক পরে লিখতে শুরু করেছি আদিবাসীদের নিয়ে। এখনও আমি আদিবাসীদের জীবন নিয়েই আছি। কলকাতার মূলধারার জীবনস্রোতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ খুবই কম। আদিবাসীদের নিয়ে নতুন কিছু লেখার পরিকল্পনা কি আছে? আদিবাসীদের জন্য যে সংগঠন আছে আমাদের, সেটা বিদেশী টাকা নেয় না। সেভাবেই রেজিস্ট্রেশন নেয়া আছে। স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের জন্য ভারতের রাজ্য সরকারের যা বরাদ্দ আছে সেটা নিয়েই এই সংগঠনের কাজ করা হয়। কাজেই সে সবের জন্য প্রচুর লেখালেখি ও দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এ কাজের বিশদ পরিচয় এত অল্প সময়ে দেয়া সম্ভব নয়। এটাই আমার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিগত পনেরো বছর ধরে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পড়ার সুযোগ কি আপনার হয়? বাংলাদেশ বলে কথা নয়, আমি বহুদিন যাবতই পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য পড়ে উঠতে পারি না। কেননা আমার অত পড়া হয় না। যখন যেটুকু সুযোগ হয় পড়ি। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাদের দেশে অভ্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। ওদের লেখা পড়েছি। চিঠি লিখি ইলিয়াসকে। তবে আমি সব সময় যে ধরনের লেখা পড়ি তা হচ্ছে জরিপ, সরকারী আইন, পরিসংখ্যান ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে কাজ করতে আমি বেশি ভালবাসি। এগুলো নিয়েই অধিকাংশ সময় চলে যায়। দুই বাংলার কথাসাহিত্যের একটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করবেন? সব দেশেই তো জনপ্রিয় ও সিরিয়াসÑ সাহিত্যের দুটি ধারা থাকে। এ বাংলার কথাসাহিত্যের কথা আমি তেমন কিছুই বলতে পারব না, ওই বাংলারও সকলের সথাসাহিত্য সম্পর্কে বলতে পারব না, তবে আমি বলব, আমার যত মেজর লেখা, যেমন অরণ্যের অধিকার হোক বা হাজার চুরাশির মা হোক, চোট্টি মু-া ও তার তীর সবগুলোই বড় কাগজে বা কমার্শিয়াল কাগজে এ জন্য বেরিয়েছে যে, প্রথম থেকে লেখাই আমার জীবিকাÑআমি আর কিছু করিনি। একটা কলেজে কিছুকাল পড়িয়েছি, মাইনে খুব কম ছিল, তারপর ছেড়ে দিয়েছি। তবে বড় কাগজে শুধু নয়, আমি লিটন ম্যাগেও লিখেছি। বর্তিকা নামে আপনি একটি কাগজ বের করতেন... সেটা অবশ্য সাহিত্যের কাগজ নয়, অনুসন্ধানধর্মী লেখা থাকে ওতে, মাটির মানুষের কথা থাকে। একজন চাষী, একজন শিক্ষক, একজন গ্রামীণ লোক তার নিজের কথা নিজেই বলতোÑ সেটাই বর্তিকায় বেরুত। কাগদীপ আন্দোলন নিয়ে সংখ্যা করেছি। ইট-ভাটার মজদুরদের নিয়ে সংখ্যা করেছি, বন্ধ কলকারখানা নিয়ে সংখ্যা করেছি, আবার আলাদা আলাদাভাবে আদিবাসীদের নিয়ে সংখ্যা করেছি যেমন সাঁওতাল বা মুন্ডাদের নিয়ে সংখ্যা করেছি। মুসলিম সমাজ ভাবনা নিয়ে একটা সংখ্যা করেছিলাম, বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। নারীমুক্তি আন্দোলন নিয়ে কিছু বলবেন? আমি ভাবি দারিদ্র্যসীমার নিচে যাদের অবস্থান সেইসব মানুষের মুক্তির কথা। সেখানে একা নারীটির মুক্তি হতে পারে না। সমস্ত শ্রেণীটাকে যদি দারিদ্র্যসীমার ওপরে আনা যায় তাহলে কিছু একটা হতে পারে। কাজেই বিষয়টা আমি শ্রেণীগতভাবে দেখি। ইউরোপের নারী সমাজ অনেক দূর এগিয়েছে...। শুনুন, আমি অতসব জানি না, মাটি থেকে আহরিত জিনিস ছাড়া আমি বেশি কিছু জানি না। ইউরোপের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত যা তার বাইরে কোন কিছুকে আমি জানা বলি না। কাগজে পড়াটাকে আমি জানা বলি না। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে বাঙালী নারীর আজকের যে অবস্থানÑ সে সম্পর্কে কিছু বলবেন? বাঙালী নারী অনেক দিক থেকে অনেক দূর এগিয়েছে, বহু কাজ করা এখনও বাকি আছে। শুধু নারীর কথা কেন বলি পুরুষদেরও অনেক কিছু করা বাকি আছে। শুনুন, বেদে পড়া যায়, সুকুমারী লিখেছেন, বাড়ির কাজকর্ম করার জন্য পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে রেখে দেয়া হতো, তাকে বলা হতো জরদকুমারী। তাহলে নারীর অবস্থান কোথায় এটা সহজেই বোঝা যায়। পুঁজিবাদী সমাজ নারীদের পণ্যে পরিণত করে...। দেখুন, আমি অত শিক্ষিত কথাবার্তা বলতে পারি না, ডোন্ট আস্ক মি সাচ থিংস। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টেলিভিশনে মেয়েদের যেভাবে দেখাচ্ছে তার কথা সবাই জানে, কিন্তু পুরুষদেরও বা কিভাবে দেখাচ্ছে? তারাও কি পণ্যে পরিণত হচ্ছে না। এসটি ইউডি স্টাড বললে যা বোঝা যায় সেইভাবে দেখাচ্ছে, তাতে পুরুষদের অসম্মান হচ্ছে না? পুরুষদের নানারকম জিন পরিয়ে প্রায় অর্ধনগ্ন দেখানো হচ্ছে। তাতে সমগ্র মানুষকেই অপমান করা হচ্ছে। তবে মেয়েদের বেশি, পুরুষদের কম। আপনার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন। আমার জীবন আমার সাহিত্যকর্ম, পত্রিকা সম্পাদনা, আমার সৃষ্টিধর্মী রচনা সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমি সংগঠনমূলক যে কাজ করি, যে সাহিত্য রচনা করি, আমি যে জীবন যাপন করি তার সবই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যারা আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন তারা জানেন, আমার বাড়িতে কোন টিভি নেই, কোন দামী জিনিস পাবেন না আমার বাড়িতে, আমার বাড়িতে আদিবাসী আসে, থাকে, ভাত চড়ে ভাত খায়Ñ এভাবেই আমার জীবন চলে। আমার লেখালেখি এই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আপনি সেদিন শ্রুতিবাণীর কথা বলছিলেন...। আসলে আমি ঠিক শ্রুতিবাণীর কথা বলিনি, বলেছি ওরাল ট্রাডিশনকে যথেষ্ট মূল্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয় না। শ্রুতিবাণী বলুন আর ওরাল ট্রাডিশন বলুন আপনি লেখার ভেতরে সেটা আনার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ওরাল ট্রাডিশন যে ফর্মে আছে সে ফর্মেই কি সাহিত্যে আনার কথা বলছেন? নাকি আধুনিক আঙ্গিকে আসবে? যে যেভাবে আনতে চান সেভাবে আনবেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামাতে এই ওরাল ট্রাডিশন এনেছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যে আগ্রাসন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এই ওরাল ট্রাডিশন কি বিকল্প শক্তি হতে পারে? না আমি বিকল্প কিছুর কথা বলছি না। ওরাল ট্রাডিশন রক্ষা করা প্রয়োজন আমাদের জীবনের স্বার্থেই মাটি ও বনের স্বার্থেই। আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি...। হ্যাঁ করেছেন, আপনি শিক্ষিত শ্রেণীর কথা হয়ত বলছেন। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে চাষী, মজুরদের মুখে সেই একাত্তরের যুদ্ধই গান হয়ে, গাথা হয়ে বেঁচে আছে। সেগুলো তো সংগ্রহ করা উচিত। গ্রামের সেই সাধারণ মানুষটি যুদ্ধকে কিভাবে দেখেছিল, কি ভেবেছিল, সেটা কি জানা দরকার নেই। ছাত্র আর বুদ্ধিজীবীরা কি ভেবেছিল সেটাই একমাত্র জানার বিষয়? ‘কী হলো রে জান, পলাশীর ময়দানে মাদান, নবাব হারালো যে প্রাণ’ Ñএই গানের মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে পলাশী যুদ্ধের কথা বেঁচে আছে। যারা লিখতে জানত না, পড়তে পারত না তারা ওরাল ট্রাডিশন বা শ্রুতি পরম্পরায় এইসব জিনিস বাঁচিয়ে রাখত। একাত্তরের যুদ্ধের কথাতেই আবার ফিরে আসি। নানাভাবে যুদ্ধ হয়েছেÑ সেইসব কথাসাহিত্যে এসেছে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে যারা প্রাণ দিয়েছিল, যত অজানা জায়গায় গণকবর আছে সেইসব জায়গায় মাঝিদের মুখের চাষীদের মুখের গানে-গল্পে গাথায় তারা একাত্তরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেইসব সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। এখনও সুযোগ আছে এগুলো ধরে রাখার। কারণ একাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই খুব বেশি বছর নয়।
×