ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্র

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৫ আগস্ট ২০১৬

অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্র

আপ্রথমঅন্তিমা কাব্যসুষমায় জারিত প্রবন্ধগ্রন্থ গাউসুর রহমান বিলিখিত ‘অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্র’। গ্রন্থকুটির প্রকাশনা থেকে অক্টোবর-২০১৫ তে প্রকাশমুখ দেখে গ্রন্থটি। প্রায় পাঁচশতপৃষ্ঠার দেহসৌষ্ঠব ও শিল্পসৌকর্যম-িত প্রচ্ছদপত্র গ্রন্থটিকে দিয়েছে অনবদ্য এক দর্শনমুগ্ধতা। সর্বমোট ১১টি মূল অধ্যায়ে বিন্যস্ত প্রবন্ধগ্রন্থটি। এছাড়া সূত্রলতা-১ তে ‘জীবনপঞ্জি’ ও সূত্রলতা-২ তে ‘গ্রন্থপঞ্জি’ শিরোনামে আরও দুটি উপাধ্যায় বিদ্যমান। অধ্যায়গুলোর ক্রমশিরোনাম নিম্নরূপÑ ‘অনীক মাহমুদের কবিতাযাপন : সূত্রলোক সন্ধান’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় জীবন-জিজ্ঞাসা’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় প্রেম ও রোমান্টিকতার সন্নিধান’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জাতীয় চৈতন্য ও সমাজভাবনা’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় রূপের অভিসার : রঙের খেলা’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় ভূগোল, ইতিহাসের স্বাক্ষর ও ঐতিহ্যের বিনির্মাণ’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণ : জীবনের নবায়ন’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় শব্দকল্প : নন্দনতত্ত্বের শাসন’, ‘অনীক মাহমুদের কবিতায় প্রকরণ-প্রসাধন : আঙ্গিককুশলতার প্রেক্ষিত’। কাব্যিক শব্দবন্ধের মাধ্যমে বাক্যগঠনের এক মায়াশৈল্পিক কৌশলে প্রাবন্ধিক যে উচ্চমাত্রায় সিদ্ধহস্ত তা গ্রন্থপাঠমাত্রই প্রমাণিত। আঁটোসাঁটো সুসংবদ্ধ শোভাময় বাঁধাই, ঝকঝকে ছাপা, অনিন্দ্যসুন্দর গেটআপ সেটআপ ও আউটলুক এবং প্রায় নির্ভুল বানানশিল্প গ্রন্থটিকে সচরাচরতা থেকে ভিন্নরূপ দিয়েছে। নন্দিত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ কৃত মনোরম প্রচ্ছদ গ্রন্থটিকে দিয়েছে অন্য অথচ অনন্য আরেক মাত্রা। সুবিশাল এই গ্রন্থটির বিনিময়মূল্য রাখা হয়েছে পাঁচশত আশি টাকা। উৎসর্গের সম্মাননায় আছেন কথাশিল্পী মঈনুদ্দীন কাজল এবং কবি- কথাশিল্পী আবু সাইদ কামাল। ধ্রুপদী দৃষ্টির কাব্যকার অনীক মাহমুদ (জন্ম, ১৯৫৮, বাগমারা, রাজশাহী) সদ্য গত হওয়া শতাব্দীর মধ্যসত্তর থেকে বালা কাব্যাঙ্গনে সক্রিয়। এবং স্বয়ংক্রিয়। কাব্যশিল্পী হবার পাশাপাশি সমমাত্রায় কাব্যবোদ্ধা ও প-িতজন তিনি। সৃজনশীলতা আর মননশীলতার এক সফল সংমিশ্রণ অদ্যাবধি তাঁর অতিবাহিত সাহিত্যজীবনে প্রমাণিত। কিন্তু কবি পরিচয়েই তাঁর অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও ততোধিক শিল্পবিস্তার। কাব্যের নিত্যনতুন প্রকরণ, কাব্যভাষার ক্রমউত্তরণ, কাব্যভাবের দিগন্তবিস্তরণ, ছন্দশিল্পের প্রাখর্য ব্যবহার এবং শব্দগন্ধী কবিমানুষ হিসেবে নিরলসভাবে গতিশীল অনীক মাহমুদের কাব্যধ্যান। অমোঘ আনন্দে বিজারিত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত অন্তঃসলিলার মতোই তিনি করে চলেছেন বিপুলবিস্তৃত সব কাব্যসম্ভার। আর তাঁর সৃষ্টিশীল এই জীবনযাপনের সূত্র ধরবার সার্থক প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন গাউসুর রহমান। লিখেছেন বিশালায়তনের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্র’। অনবরত নিরীক্ষাপ্রবণ কবি অনীক মাহমুদের সর্বমোট ২২টি কাব্যগ্রন্থের আলোচনা সম্বলিত প্রবন্ধগ্রন্থ এটি। অনীক মাহমুদের কবিতার সামাজিক-রাজনৈতিক-রোমান্টিক-পারিবারিক-অর্থনৈতিক-ঐতিহ্যিক-ব্যক্তিক-দৈশিক-বৈশ্বিক-আঞ্চলিক-নন্দনতাত্ত্বিক-ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-জাতিক-আন্তর্জাতিক-জৈবনিক-প্রাকরণিক কোন বিষয়ই অনুপস্থাপিত থাকেনি গাউসুর রহমানের ‘অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্র’ গ্রন্থটিতে। বিশেষ করে, ‘অনীক মাহমুদের কবিতাযাপন : সূত্রলোক সন্ধান’ নামাঙ্কিত প্রথম অধ্যায়ে শতপৃষ্ঠার পরিসরব্যাপী গাউসুর রহমান কবি অনীক মাহমুদের কাব্যবিশ্বের আবহ ও আঙ্গিক অনুধ্যানের যে পরিচয় পরিস্ফুট করেছেন তা অনবদ্য এবং প্রখর গবেষণালব্ধই বলতে হবে। অনীক মাহমুদের ভাববিশ্ব ও ভাষাবিশ্বের যে পূর্ণাঙ্গ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিপ্রেক্ষিত এই অধ্যায়ে ব্যাখ্যাত হয়েছে তা মননশীলতার যে কোন মানদ-েই শিল্পিত ও সুগভীর। প্রবন্ধকার গাউসুর রহমানকে উদ্ধৃত করছিÑ ‘বিষাদদীর্ণ এক অস্থির পৃথিবীর অধিবাসী অনীক মাহমুদ। তাঁর কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে ব্যক্তি-মানুষের অন্তস্তলের রক্তিম চেতনা, মর্মমূলের অপ্রতিরোধ্য অন্তর্ঘাত, বিরহ, নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতার গাঢ়বোধ বেদনার রক্তোদ্বেল সংরাগ, হৃদয়ের অনেক অন্তঃশীল প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ; পাওয়া না পাওয়া যোগসূত্রের প্রাণময় উম্মোচন।’ উক্ত উদ্ধৃতিকে সমর্থন করে এমন এক সৃজনাংশ অনীক মাহমুদ থেকে তুলে ধরছিÑ আমার চোখে ক্ষুধার শহর, বুকের গৃহের ভাঙা প্রণয় জংধরা এক শরীর নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে কাঁপাচ্ছে বোকা থ্রোবিং মটর হয়ত পায়ের মিশ্র আঙুলে লেপ্টে আছে দুঃখের কাদা নাকে ঝোলে ব্যথার নোলক, মুখে ফোটে শোকের শোলক কিম্বা, কলার চেপে ঘুষি মারে নিত্যদিনের ক্ষিপ্ত অভাব। [‘বৈষ্ণবী তোর দোহাই লাগে’: আসন্নবিরহ বিষণœবিদায়] সর্বোপরি অনীক মাহমুদের কবিতাযাপনের সূত্রলোক সন্ধানের প্রথম এই অধ্যায়ের সচেতনপাঠেই অনুমিত যে, সমগ্র প্রবন্ধটি কি অবারিত শব্দসুষমা ও সমালোচনা সুন্দরতায় সজ্জিত। দ্বিতীয় থেকে একাদশ অধ্যায় ব্যাপী অনীক মাহমুদের কবিতাবিশ্বের দার্শনিক দৃষ্টান্তকে উল্লেখ করা হয়েছে অখ--অনবদ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বলতে দ্বিধা নেই, যে বিষয়টি সমগ্র প্রবন্ধগ্রন্থব্যাপিই পরিদৃশ্যমান তা হলো, বর্ণনা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি অত্যধিক পরিসংখ্যায় অনীক মাহমুদের কবিতার উদ্ধৃতি যা আপাতদৃষ্টিতে দৃষ্টিকটু ও গবেষণার গভীরতাকে নেতিবাচকতার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু এ বিষয়টিও যে সুচিন্তিতভাবেই প্রবন্ধকার সন্নিবিষ্ট করেছেন তা ভূমিকাংশেই নিশ্চিত হওয়া যায়। গাউসুর রহমান বলছেনÑ ‘আলোচনা যুক্তিগ্রাহ্য সহজলভ্য করার মানসে পর্যাপ্ত পরিমাণে অনীক মাহমুদের কবিতার দৃষ্টান্ত ব্যবহার করা হয়েছে। কারও কারও কাছে এরূপ দৃষ্টান্তের আধিক্য বাহুল্য মনে হতে পারে। কিন্তু বক্তব্যের প্রামাণিকতা ও সূত্রনির্দেশের তাগিদের কথা ভেবেই সমকালীন প্রতিক্রিয়ার বাতাবরণে আমরা এ পন্থা অবলম্বন করেছি।’ বস্তুত কবিতার আলোচনায় প্রাবন্ধিকের এই স্বীকারোক্তিকে যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক মানতেই হবে। প্রাবন্ধিকের মন্তব্য উল্লেখের পাশাপাশি কবির কাব্যোদ্ধৃতির সন্নিবেশন সমগ্র গ্রন্থটিকেও দিয়েছে এক স্বচ্ছন্দগতি। বলতেই হবে, এটি গাউসুর রহমানের নতুন ধরন, ভিন্ন আঙ্গিক ও ব্যতিক্রমী দিক। সূত্রলতা-১ তে ‘কবি অনীক মাহমুদ : জীবনপঞ্জি’ অংশে কবির জন্ম ও বংশবীক্ষা, পাঠগ্রহণ ও শিক্ষালোক, কর্মলোক ও জীবিকাবৃত্তি, পারিবারিক পরিলেখ, সাহিত্যসাধনা ও গ্রন্থরাজি, গবেষণা পরিচালনা, সম্পাদনাকর্ম, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রণিধান-সংশ্লিষ্টতা, পুরস্কার ও সম্মাননা, অনীক মাহমুদ প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। এরপর সূত্রলতা-২ তে মূললেখক অনীক মাহমুদের সৃষ্টিসম্ভারসূচি এবং প্রবন্ধকারের সহায়ক গ্রন্থের সমৃদ্ধ তালিকা প্রবন্ধগ্রন্থটিকে পূর্ণতর রূপ দান করেছে।
×