ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রনি

উর্দু সাহিত্যের বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৫ আগস্ট ২০১৬

উর্দু সাহিত্যের বাতিঘর

উর্দু কথাসাহিত্যে প্রেমচন্দের পরে সবচেয়ে আলোচিত ও শক্তিমান গল্পকার হিসেবে যার নামটি উচ্চারিত হয় তিনি হচ্ছেন সাদত হাসান মান্টো। মান্টোর সময়কালের অন্যতম প্রধান কথাকার কৃষ্ণ চন্দর তাঁকে তো প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ গল্পকার আখ্যায়িত করেইÑ উর্দু ছোটগল্পের ইমাম ঘোষণা করেছেন! অথচ আশ্চর্যের বিষয়, ছাত্রজীবনে মান্টো কিনা উর্দু বিষয়েই ফেল মারলেন! একাধিকবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অবশেষে তৃতীয় দফায়, তৃতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার সুযোগ পেলেন। ছোটগল্পের বিস্ময়-পুরুষ, আপোসহীন- এই কথাশিল্পী প্রথমদিকে প্রখ্যাত ফরাসী সাহিত্যিক মোপাসাঁর চিন্তা ও দর্শন দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হওয়ায় কেউ কেউ তাঁকে উর্দু কথাসাহিত্যের মোপাসাঁ হিসেবেও অভিহিত করেন। কিংবদন্তি মান্টোর জন্ম ভারত ভাগেরও অনেক আগে অর্থাৎ ১১ মে, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে; ভারতের পাঞ্জাব অংশে, লুধিয়ানা জেলার সোমরালা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাই সঙ্গত কারণেই তাঁর লেখায় দেশ বিভাগের দুর্বল বিষয়-আশয়গুলো খুব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। মান্টো বেঁচে ছিলেন ৪৩ বছর। দুই যুগেরও অনধিক ছিল তার সাহিত্যসাধনার সময়কাল। মাত্র ২১ বছরের সাহিত্যিক জীবনে অন্তত ১০ বছর ধরে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমার বোঝা কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন তিনি। যার ফলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নির্বিরাম মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মান্টো। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগÑ তিনি অশ্লীল লেখক, সেইসঙ্গে নারীবিদ্বেষী এবং সমাজদ্রোহী মানুষও বটে। তাছাড়া তার লেখা ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থীÑ এমন আজগুবি সব অভিযোগের অস্তিত্বও কম ছিল না। সমস্ত অভিযোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁকে নাজেহাল করার জন্যই মূলত উত্থিত হয়ে শেষতক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাতেও দমে থাকেনি মান্টো। আপন বিশ্বাস এবং মতাদর্শ নিয়ে বরং গর্ববোধ করতেন তিনি। কতটা আত্মবিশ্বাসী হলে স্র্রষ্টার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে কেউ দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করতে পারেÑ কে বড় গল্পকার, মান্টো নাকি ঈশ্বর? মৃত্যুর পূর্বে মান্টোর লিখে যাওয়া এফিটাফের দিকে তাকালেই মুগ্ধতার শুমার থাকে না, বিস্ময়ে চোখ যেন কানে ঢুকে যেতে চায়। মান্টো সেখানে লিখেছেনÑ Buried under mounds of earth, even now he is contemplating whether he is a great story writer or God. মান্টো ভিক্টোর হুগোর উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট ভে’জ অব এ কনডেমভ ম্যান’ অনুবাদের মধ্য দিয়ে সাহিত্য জগতে চূড়ান্তভাবে প্রবশ করেছেন বটে কিন্তু তাঁর মৌলিক প্রথম লেখা হচ্ছে ‘তামাশ’ গল্প। জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকা-ের ওপরে লেখা এই অসামান্য রচনাটি অনেক গুণীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে প্রথমদিককার লেখালেখি নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি না চললেও তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিÑ‘কালো সালোয়ার’, ‘উপর নিচে আউর দারমিয়ান’, ‘ঠা-া গোস্ত’, ‘বু’, ‘ধোঁয়া’ ও ‘খুলদো’ প্রভৃতি গল্পের জন্য মান্টোর বিরুদ্ধে লাহোর কোর্টে একাধিক মামলা রুজু হয় এবং দায়েরকৃত প্রত্যেকটি মামলাতেই আইনী প্রক্রিয়ায় লড়েছেন তিনি, দু-একবার কোর্টে সরাসরি জেরায়ও অংশ নিয়েছেন লেখক। একে একে ছয় ছয়টি মামলা তাঁকে কিছুটা স্তম্ভিত করলেও দিকভ্রান্ত করতে পারেনি কখনও। মান্টোর বিরুদ্ধে যত মামলা ঢোকানো হয়েছে, বেশিরভাগ মামলাতেই নিম্ন আদালত অর্থদ-ের আদেশ দিয়ে জরিমানার টাকা দ্রুত পরিশোধের নির্দেশ প্রদান করেছে। কোন কোন মামলায় কারাভোগের রুলও জারি হয়েছে। মান্টো মোটেই ঘাবড়াননি, হালও ছাড়েননি তিল পরিমাণ। ফলে উচ্চ আদালতে আপীল করে নিজের জামিনসহ জরিমানার টাকা একাধিকবার ফেরত আনার নজির সৃষ্টি করেছেন তিনি। এতেই স্পষ্ট হয়Ñ মান্টো কতটা আত্মবিশ্বাসী এবং একরোখা ধাঁচের মানুষ ছিলেন। তিনি যে অশ্লীল ছিলেন না, তাঁর লেখাজোখা যে মোটেই অযৗক্তিক ছিল নাÑসেটাও পরিষ্কার হয়ে যায় উচ্চ আদালতের রায়ের ভেতর দিয়ে। ‘নারী-পুরুষের সম্পর্ক কখনও অশ্লীল হতে পারে না’ মান্টোর এই বক্তব্যটিও সঠিক প্রমাণিত হয়। অপ্রিয় হলেও তিনি সমাজ-অন্তরালের গোপন অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেছেন গল্পের অবয়ববে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের ইতিহাসবিদ ও দ্বি-মাসিক ‘মান্টো সেন্টিনারি ভলিয়ম’Ñএর সম্পাদক ড. আয়শা জালালের মন্তব্যটাই প্রণিধানযোগ্য। তিনি মান্টোর গল্পের শরীরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালিয়ে চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেনÑ ‘যে সমাজ এমনিতেই নগ্ন, তার আবার ব্লাউজ খোলে কেমন করে?’ বর্তমানে মান্টোকে কেউ কেউ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে স্¦ীকার করে নিলেও তদানীন্তন রক্ষণশীল সমাজ ও রাষ্ট্র; বিশেষত পাকিস্তান সরকার একজন মান্টোর মর্যাদা বুঝে উঠতে পারেনি। কীভাবে বুঝবে? ভ-দের মুখোশ উন্মোচন করে মান্টোর মতো কি কেউ এত সাহস নিয়ে বলতে পেরেছেন?Ñ ‘গণিকালয় আর পীরের মাজার এই দু’জায়গাতেই আমি আত্মার শান্তি লাভ করি। সেখানে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু ধোঁকা আর শঠতায় পরিপূর্ণ। আর যে মানুষ নিজেকে ঠকাতে-ধোঁকা দিতে চায়, তার কাছে এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কি হতে পারে। কারণ সবাই জানে বাইজির কুটিরে পিতামাতা তার মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে পেশাদার বাইজিতে পরিণত করে আর মাজারে ও পীরের আস্তানায় মানুষ ব্যবসা করে খোদাকে নিয়ে।’ মান্টোর গল্পের নায়িকারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, আত্মনির্ভর হয়ে বাঁচতে চায়; বোঝা না হয়ে সমাজে অবদান রাখতে চায়। রক্ষণশীল সমাজ তা হতে দেয় না। উল্টো বিপথের দিকে ঠেলে দেয়। তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘লাইসেন্স’ গল্পের দিকে তাকালে সে চিত্র চোখ ঝসলিয়ে দেয়। গল্পে, নায়িকার একমাত্র উপার্জনক্ষম টাঙ্গাচালক স্বামী মারা গেলে পরিবারের অভাব ঘোছাতে সে স্বামীর রেখে যাওয়া টাঙ্গাটি শহরে চালানো শুরু করে এবং সংসারের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যৌবনবতী এই নারীর মানবেতর জীবন-যন্ত্রণা কাউকে কষ্ট না দিলেও তার টাঙ্গা চালানোর স্পর্ধা নগরবাসীর আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে । পুরো শহরে হৈ-হুল্লোড়, ছি ছি রব পড়ে যায় এবং নালিশ যায় পৌরসভায়। পৌর কর্তৃপক্ষ মেয়েটির কাজের লাইসেন্স না দিয়ে উল্টো তার টাঙ্গা চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়। ফলে পেটের দায়ে মেয়েটি যখন বাধ্য হয়ে গণিকার খাতায় নাম লেখায়, তখন আর সমাজের নামধারী ভদ্রলোকদের আত্মসম্মান একটুও ক্ষুণœ হয়নি! তাহলে কি মেয়েটির আহারহীন মুখের দিকে কারও নজর দেয়ার দায় ছিল না সমাজে? নির্লজ্জ সমাজের কাছে এ ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েই প্রগতিশীল মান্টোরা সমাজচ্যুত হন, নাস্তিকতা কিংবা অশ্লীলতার তলোয়ারে বিদ্ধ হন বারংবার। দেশ বিভাগপূর্ব সময়ের দাঙ্গা একটি মহামারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘খুল দো’ শিরোনামে মান্টো লিখেলেন দাঙ্গাবিরোধী এক বিখ্যাত গল্প। সে গল্পের জন্যও তাকে কম হেনস্থা হতে হয়নি। সেখানে মানবতার সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ‘খুল দো’ গল্পের নায়িকা সকিনাকে উদ্ধারের জন্য যারা কথা দিয়েছিল এবং খুঁজে বেরও করেছিল। উদ্ধারকার্য সম্পাদনের পর মেয়েটিকে কি তার বাবার কাছে আর ফেরত দিয়েছিল তারা? না। অথচ মেয়েটির অসহায় পিতা ‘মেয়ে যদি বেঁচে থাকে আমরা খুঁজে বের করবই’ যুবকদের এই আপ্তবাক্য বিশ্বাস করে, সরল মনে খোদার কাছে বার বার সেই বজ্জাত ছেলেদের জন্যই যখন প্রার্থনা করে, কাঁদেÑ তখন কি ধর্ষক ও মিথ্যা আশ্বস্তকারীদের প্রতি সচেতন পাঠক মহলের ঘৃণা উদ্রেক হয় না? কিন্তু বড়ই অবাক ও পরিতাপের বিষয়, কবি আল্লামা ইকবালের সুযোগ্য পুত্র জাস্টিস জাভেদ ইকবালও নাকি এই গল্পে তুমুল অশ্লীলতার গন্ধ পেয়েছেন! পুরো গল্পে একটি নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার না থাকার পরেও অবচেতন মানুষের মতোন তিনি এক মনগড়া মন্তব্য জুড়ে দিয়ে বললেনÑ ‘খুল দো গল্পটি যারা পড়বে তারাও ধর্ষণ করতে প্রলুব্ধ হবে।’ এ্ই অর্বাচীনোচিত মন্তব্যে পাঠককে ধাক্কা দেয় যখন দেখা যায় পুরো গল্পের কোথাও সরাসরি ‘ধর্ষণ’ শব্দটির অস্তিত্ব আতশ কাচ ব্যবহার করেও পাওয়া যায় না! আরো বেশি বিস্ময় ঘনীভূত হয় যখন মান্টো ‘ঠা-া গোস্ত’ গল্প লেখার পর অশ্লীলতার দায়ে নিম্ন-আদালতে সাজা ও জরিমানার হুকুম হয় এবং আপীলের পর উচ্চ আদালত তা বাতিল করে সাজা মওকুফসহ অর্থ ফের দেয়ার নির্দেশ দেয় কিন্তু ভদ্ররূপী ও বকধার্মিক পাকিস্তান সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সে আবেদনটি নাকচ করে দিয়ে অপ্সাত কারণে নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বহাল রাখা হয় অর্থাৎ নতুন রায়ে প্রখ্যাত জাস্টিস মুনীর সাহেব গল্পটিকে আইনগতভাবেই অশ্লীলতার তকমা সাঁটিয়ে দিয়ে এক কিম্ভূতকিমাকার রায় ঘোষণা করলেন। যার একাংশে তিনি উল্লেখ করেন- A story could not escape from being obscene, if the details of the story were obscene. A story is not like a book which could be good in some parts and bad in some parts উগ্র চিন্তার ধারক ও বাহক পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের আতঙ্ক-সঞ্চারি কথাকার সাদত হাসান মান্টো মনে প্রাণে অপছন্দ করতেন। চরম ক্লান্তিকালেও তিনি পাকিস্তানের শরণপ্রার্থী হননি। কিন্তু সেকালের মানবিক বিপর্যয়ের মুখেপড়া ভারতের পক্ষেও পুরোপুরি অবস্থান নেননি তিনি। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে দেশ ভাগের বিষয়টি মান্টো মানতে পারেননি। মান্টোর মাস্টারপিস গল্প ‘টোবাটেক সিং’-এর দিকে তাকালে তাঁর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। তিনি পাকিস্তান কিংবা ভারতÑ কোনটাই চাননি। চেয়েছেন আপন গল্পের ‘টোবাটেক সিং’য়ের মতোন নিরপেক্ষ একটি অঞ্চল। যেখানে স্বাধীনভাবে এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বেঁচে থাকার অধিকার পাবেন মানুষ। গল্পটিতে পাগলাপ্রলাপকে রম্যধর্মীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করালেও সেখানে স্বার্থের লোভে বিভক্ত হওয়া দুটি রাষ্ট্রের করুণচিত্র তুলে ধরেছেন মান্টো। ধর্মের ছুরিতে দেশ ভাগের ফলে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে তা একজন পাগলের প্রতীকী চিহ্নের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তিনি। নারীপ্রীতি ও দেশপ্রেমবোধ যার পুরোটা অন্তরকে দখল করে রেখেছে, টোবাটেক সিং গল্পের সেই অমর পাগল-নায়কটি আবার মান্টো নিজেই নয় তো? কারণ এই গল্পটির লিখতে গিয়েই তো তিনি চার মাস পাগলা গারদে কাটিয়েছেন এসেছিলেন, সঞ্চয় করেছেন টকÑঝল অভিজ্ঞতা। তাছাড়া ভারতের হিন্দী আগ্রাসনে উর্দুর শবযাত্রা এবং পাকিস্তানে ভ-ে আধিপত্যে মানবতার ঘোরযাত্রা দেখে মান্টো কিছুকাল পাকিস্তান অবস্থান নিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁর বন্ধুদের মিশ্রপ্রতিক্রিয়া এবং প্রশ্নবোধক অঙ্গভঙ্গিও দৃশ্যও তাঁর চোখ এড়ায়নি। ফলে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে নিজের কৈফিয়ত দিতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত শক্ত ভাষায় উল্লেখ করেছেনÑ ‘বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কেন পাকিস্তান যাাচ্ছি? আমি কি ভীতু? মুসলমান বলে নাকি? কিন্তু ওরা আমার কথা বুঝতে পারেনি। আমি পাকিস্তান যাচ্ছি কারণ সেখানে একজন মান্টো থাকবে, যিনি সেখানকার ভ-দের মুখোশ উন্মোচন করবেন। ভারতে উর্দুর ভবিষ্যত খারাপ কারণ চারদিকে হিন্দীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।’ এই মন্তব্যের মধ্যেও মান্টো তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি নিজের অবস্থানের বিষয়টি গোপন না রেখেই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন। তাই টোবাটেক সিং গল্পে নায়কের শেষ পরিণতির মতো মান্টোর হৃদয়টাও সব সময় ঝুলে ছিল দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী কাঁটাতারের ওপরে। এই কাঁটাতার যেন সম্প্রীতি ও মানবিকচেতনার বুকে নির্মমভাবে বিঁধে আছে। মান্টো মারা যান ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। যক্ষ্মারোগ আর চরম অর্থনৈতিক দীনতার কাছে হেরে যান তিনি। তাঁর জীবনপ্রবাহ, মৃত্যুরোগ এবং আর্থি দৈন্যগ্রস্তের দৃশ্যটা স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা সাহিত্যের তিন নক্ষত্র কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। এই নক্ষত্রত্রয়ের জীবনচক্রের সঙ্গে মান্টোর কি আশ্চর্য মিল! মৃত্যুর পরে মান্টো যে ব্যাপকভাবে পঠিত হবেন, বেঁচে থাকতেই সে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তিনি। তাই মরার আগে স্ত্রী সাফিয়া বেগমের কাছে বড় মুখ করে মান্টো বলেছিলেনÑ ‘আমার মৃত্যুর পর কখনও টাকা পয়সার সমস্যায় পড়বে না তোমরা।’ কিন্তু মৃত্যুর পর মান্টো ব্যাপক পঠনপাঠনে এলেও স্ত্রীকে দেয়া তাঁর কথাটি একটুও সত্যি হয়নি। হতে পারত। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা ঢাউস আকারে মান্টোসম্ভার প্রকাশ করে কেবল নিজেদের পকেটই ভারি করেছে। তাঁর সহায়-সম্ভবলহীন অসহায় পরিবারের খোঁজ কেউ রাখেনি। এমনকি আশফাক আহমাদসহ বড় বড় সাহিত্যিক-প্রকাশকদের দরজা থেকেও যখন শূন্য হাতে ফেরত গিয়ে সাফিয়া বেগম বড় আপেক্ষ ঢেলে ড. বিরজ ভ্রমীর কাছে চিঠি লিখেনÑ ‘আমার দুঃখ এই যে, তাঁর লেখা আমার কোন কাজে আসেনি।’ তখন বার বার মনে হয় মৃত্যুর পরেও একজন সাদত হাসান মান্টোকে পরাজিত করতে না পারার ঈর্ষায় তাঁকে নতুন আরেক কারাগারে নিক্ষেপ করেছে পৃথিবী!
×