ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সব সুপারিশও বাস্তবায়ন হচ্ছে

বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ আগস্ট ২০১৬

বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। নিñিদ্র নিরাপত্তার লক্ষ্যে বিদেশীদের দেয়া সকল সুপারিশও ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলা হলেও সেসব দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিদেশী চাপ না থাকলেও বাংলাদেশে একই ইস্যুতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের দ্বিমুখী আচরণও পরিলক্ষিত হচ্ছে। সূত্র জানায়, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোন দেশে অবস্থান করা কূটনীতিক ও বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্ব স্ব দেশের। সে হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশীদের দায়িত্বও বাংলাদেশ সরকারের। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার পরে বিদেশীদের নিরাপত্তায় সচেষ্ট বাংলাদেশ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে কূটনৈতিক জোনে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে সরকার। এছাড়া গোয়েন্দা তৎপরতাও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আরও বাড়ানো হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কাছে ইতোমধ্যেই ছয়টি সুপারিশ করেছেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, কূটনৈতিক জোনে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিদেশী ক্লাবে নিরাপত্তা প্রদান, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিসে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অফিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিমানবন্দরে চেক আউট ও চেক ইনের সময় বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান ও ঢাকার বাইরে থাকা সকল বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব সুপারিশ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে সরকার। তবে বিদেশীদের সকল প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ ও বুলেট প্রুফ গাড়ি ব্যবহারেরও অনুমতির বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জঙ্গী হামলাকে এখন বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বের যে কোন দেশেই জঙ্গী হামলা হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশে জঙ্গী হামলা ঘটেছে। ফ্রান্স একাধিকবার জঙ্গী হামলার ঘটনায় তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে এসব দেশে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটলেও সেখানে বিদেশী কূটনীতিকরা নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কোন চাপ দিচ্ছেন না। এছাড়া সেসব দেশ ত্যাগও করছেন না বিদেশী কূটনীতিকরা। তবে ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। রাজধানী গুলশানে জঙ্গী হামলার পরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ঢাকা মিশনের কর্মকর্তারা ছুটি নিয়ে বাইরে গেছেন। তারা আর ঢাকায় ফিরবেন কি-না সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া ব্রিটিশ কাউন্সিল। ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যু গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের বেশ কিছু সহকর্মী ইতোমধ্যেই তাদের পরিবারের সদস্যদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকিরা এখনও অপেক্ষা করছে কী সিদ্ধান্ত আসে, সেটা দেখার জন্য। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর থেকে একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ঢাকায় এসেছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই তিনি নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন কার্যক্রম শেষ করবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা মূল্যায়ন কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে তাদের মিশনগুলো পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গী হামলা হলেও সেসব দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশী কোন চাপ তৈরি হয়নি। তবে ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে বিদেশী কূটনীতিকরা যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, সেটা অন্য দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। বিদেশী কূটনীতিকরা এখানে দ্বিমুখী আচরণ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাঞ্জাবের পাঠানকোটেও কিছুদিন আগে জঙ্গী হামলা হয়েছে। সেখানে নিহত হন ৮জন। তবে এই জঙ্গী হামলার পরে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি সেখানকার বিদেশী কূটনীতিকরা। একইভাবে ফ্রান্সে দুই দফা হামলার পরেও সেখানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেননি তারা। তবে ব্যতিক্রম ঘটছে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে রীতিমতো সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। এছাড়া রাজধানীর গুলশানে হামলার পরেই তড়িঘড়ি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের ঢাকা সফরও নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট জানিয়েছেন, নিরাপত্তা ইস্যু কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দখলের কোন ইচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তারা শুধু বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চাইছেন। ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে নিরাপত্তায় নিয়োজিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মীদের অস্ত্রবহন ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের অনুমতির বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। এর আগে কখনও এ বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএইড) কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান নির্মমভাবে খুন হওয়ার প্রেক্ষিতে নিজ দেশের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা জোরদারের একটি বেসরকারী নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের অস্ত্র বহনের অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্কিন দূতাবাসের ওই অনুরোধে সাড়া দেয়নি সরকার। এখন গুলশানে হামলার পর আবারও বেসরকারী নিরাপত্তা প্রহরীদের অস্ত্রবহন ও বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহারের অনুমতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এদিকে রাজধানীর গুলশানে জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার অভিমত, জঙ্গী হামলা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সে কারণে একক কোন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এদিকে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জাতীয় টাস্কাফোর্স কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বৈঠক শেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যুর সঙ্গেও আলোচনা করেন টাস্কফোর্স সদস্যরা। এ সময় পিয়েরে মায়াদ্যুকে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন পদেক্ষপ অবহিত করা হয়। বৈঠকে বিদেশীদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিদেশী কূটনীতিকদের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন তারা। নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে তথ্য-আদান প্রদানের লক্ষ্যে বিদেশী কূটনীতিকদের সাথে আরও নিবিড় যোগাযোগ কিভাবে করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা। উল্লেখ্য, গত পহেলা জুলাই রাতে গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা চালায় একদল অস্ত্রধারী জঙ্গী। দেশী-বিদেশী অন্তত ৩৩ জন সেখানে জিম্মি হন। হামলাকারীদের ঠেকাতে গিয়ে বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ২০ জনের লাশ পাওয়া যায় জবাই করা অবস্থায়। সে ঘটনার পর থেকেই বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বিদেশীদের নিরাপত্তায় জাতীয় টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। এদিকে জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদেশী কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা টহল জোরদারের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স।
×