ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এ তথ্য পুলিশের হিউম্যান ট্রাফিকিং মনিটরিং সেলের

গত চার বছরে ৬ হাজার মানবপাচার, কঠিন আইনেও ঠেকছে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ আগস্ট ২০১৬

গত চার বছরে ৬ হাজার মানবপাচার, কঠিন আইনেও ঠেকছে না

ফিরোজ মান্না ॥ কঠোর আইন করেও মানব পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের হিউম্যান ট্রাফিকিং মনিটরিং সেলের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত চার বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৫ হাজার ৯শ’ ৯২ নারী, শিশু ও পুরুষ পাচারের শিকার হয়েছেন। তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও মানব পাচারবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, এই হিসাব আরও অনেক বেশি। বহু মানুষ সাগরপথে পাচার হওয়ার সময় মারা গেছেন। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বহু গণকবর থেকে পাচার হওয়া মানুষের শত শত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর এটা ঘটেছে ২০১২ থেকে ১৫ সালের মধ্যেই। সূত্র জানায়, মালয়েশিয়া, থ্যাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। মালয়েশিয়াতেও ট্রলারযোগে সাগরপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে অনেকে আবার থ্যাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। যারা আটক হয়েছে তারা কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পাচারকারীদের হাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের রয়েছে নিবিড় সখ্য। এ কারণেই পাচারকারীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে । পুলিশ হেড কোয়ার্টারের তথ্য অনুযায়ী, পাচার হওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৫০ জন। নারী ও শিশু পাচার হয়েছে এক হাজার ৫৪২ । ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাচার হওয়াদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বলছে, ২০১২ সালে মানব পাচার বিষয়ক কঠোর আইন হওয়ার পর গত চার বছরে (২০১৫ সাল পর্যন্ত) ২ হাজার ৪শ’ ২৯ জন পাচার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৩৪২, ২০১৩ সালে ৩৭৭, ২০১৪ সালে ৬৮২ ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ২৮ জন। মানব পাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। একশ্রেণীর দালালের মাধমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছেন। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখান থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব-সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বেন। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ খুব একটা হচ্ছে না। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালেশিয়ায় অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিসহ। পাচারকারীরা দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। রামরুর এক কর্মকর্তা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চিয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসঙ্গতি মানব পাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নানামুখী পদক্ষেপে মানব পাচার অনেকটা কমে গেছে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি মহিলা পাচারের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৫৪৪ এর মধ্যে ৫৪২ জনকে তাদের পরিবারের কাছে এবং দু’জনকে একটি এনজিও ও একটি সরকারী সেফ হোমে রাখা হয়েছে। পাচারের এসব ঘটনায় ৪৮৯ মামলায় এক হাজার ৫১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৭৮৮ জনকে। একই সময়ে ৫৮১ শিশু পাচারের শিকার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ৪৫৫ । এর মধ্যে ৪৫৪ জনকে তাদের পরিবারের কাছে এবং একজনকে সরকারী সেফ হোমে রাখা হয়েছে। পাচারের এসব ঘটনায় ৩০১ মামলায় ১০০১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই হিসাব পুলিশের। বাস্তবে এই সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ পাচার হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মানব পাচার বন্ধে কঠোর আইন করা হয়েছে। একই সঙ্গে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটিও রয়েছে। কমিটির সদস্যরা মানব পাচার কেন হচ্ছে এবং পাচার বন্ধের জন্য কি করণীয় চিহ্নিত করে মানব পাচার বন্ধের জন্য কাজ করা হচ্ছে। মানব পাচারকারীদের ধরতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তালিকা তৈরি করেছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজিবির সমন্বয়ে এই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
×