ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাকার ছেলে হুম্মাম লাপাত্তা, রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলার রায় ১৪ আগস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ আগস্ট ২০১৬

সাকার ছেলে হুম্মাম লাপাত্তা, রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলার রায় ১৪ আগস্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আবারও আলোচনার জন্ম হয়েছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নিয়ে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় ফাঁসের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আদালতে আইনজীবীর এমন দাবির প্রেক্ষিতে আদালত হুম্মাম কাদের চৌধুরীর জামিন বহাল রেখেছে। পরবর্তী তারিখে হুম্মামকে আদালতে হাজির করতে আইনজীবীকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলার রায় আগামী ১৪ আগস্ট নির্ধারণ করেছে আদালত। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল জামিনে থাকা আসামি সাকার আইনজীবী ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল হাসান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী ফারুক আহমেদ ও নয়ন আলীর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের পক্ষের আইনজীবী চৌধুরী মোঃ গালীব রাগীবের দাবি, বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটার দিকে আদালত এলাকা থেকে গাড়ির গতিরোধ করে হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আইনজীবীর দাবি, সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে বৃহস্পতিবার তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যান। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পরপরই ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের নিচ থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রসঙ্গত, হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরী, হুম্মাম কাদের চৌধুরী নামেই বেশি পরিচিত। হুম্মামকে তুলে নেয়ার সময় ডিবি পুলিশ পরিচয়দানকারীরা সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরীকে কোন প্রকার কথাবার্তা না বলতে এবং বাধা না দিতে বলেন। পুলিশকে তাদের কাজ করতে সহযোগিতা করার কথা বলেন ডিবি পরিচয়দানকারীরা। পরে ফারহাত কাদের চৌধুরী ওই মামলায় হাজিরা দেন। বৃহস্পতিবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের রায় ফাঁসের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দ্বিতীয় দিন ধার্য ছিল। আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আমিনুল গনি টিটো জানান, হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে তুলে নেয়ার ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। হুম্মামের ব্যক্তিগত সচিব মিনহাজ উদ্দিন চৌধুরী শিবলী জানান, সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজিরার সময় হুম্মাম কাদের ও তার মা ফারহাত কাদের চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তারা নিয়মিত হাজিরা দিতেই সেখানে গিয়েছিলেন। এ সময় ডিবি পরিচয় দিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকেই হুম্মামকে আটক করে। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলার রায় দেয়া হবে আগামী ১৪ আগস্ট। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ায় বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ধার্য করেন বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক কে এম শামসুল আলম। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল জামিনে থাকা আসামি সাকার আইনজীবী ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম, সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল হাসান এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী ফারুক আহমেদ ও নয়ন আলীর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পিপি নজরুল ইসলাম শামীম জানিয়েছেন, সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ছাড়া বাকি আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। নারী ও বয়স্ক বিবেচনায় আদালত ফারহাত চৌধুরীর জামিন বহাল রাখা হয়। সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী আদালতে আসার সময় ডিবির হাতে আটক হয়েছেন, তার আইনজীবীর এমন দাবির প্রেক্ষিতে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর জামিন বহাল রাখা হয়। তবে রায় ঘোষণার দিন তাকে আদালতে হাজির করতে আইনজীবীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলেকে আটক বা গ্রেফতারের বিষয়টি তিনি অবগত নন। প্রসঙ্গত, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার আগেই রায়ের প্রায় পুরোটাই ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ১৭২ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে ১৬৫ পৃষ্ঠাই ফাঁস হয়ে যায়। এমন ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তে বেরিয়ে আসে রায় ফাঁসের সঙ্গে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ও ছোট ছেলে ছাড়াও সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, তার সহকারী আইনজীবী মেহেদী হাসান, ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নয়ন আলী, ফারুক হোসেন ও সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল আহসানের জড়িত থাকার বিষয়টি। এ ব্যাপারে তথ্য প্রযুক্তি আইনে একটি মামলা দায়ের করে প্রসিকিউশন বিভাগ। সেই মামলায় পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় অভিযানে মামলার এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে অনেকেই গ্রেফতার হন। পরে জামিনে ছাড়াও পান। ওই সময় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নয়ন আলী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে রায় ফাঁসের জন্য নতুন সিমকার্ডসহ মোবাইল ফোন, মোটা অঙ্কের নগদ টাকা প্রদান করা হয় বলে স্বীকার করেন নয়ন। আর পেনড্রাইভের মাধ্যমে রায় কপি করে তা ফাঁস করা হয় বলেও নয়নের জবানবন্দীতে উঠে আসে। পরবর্তীতে নয়ন জামিনে মুক্ত হন। পুুলিশ জানায়, ২০০৮ সালে গুলশান থানায় একটি মারামারির মামলা হয়। সেই হামলায় ইমাম কাদের চৌধুরী নামে একজনকে গ্রেফতার করতে ঢাকার সিএমএম আদালত পরোয়ানা জারি করে। পরবর্তীতে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ইমাম কাদের চৌধুরীই সাকা চৌধুরীর ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর হুসাম উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। গ্রেফতারের সময়ও হুম্মাম কাদের চৌধুরী পুলিশকে গালিগালাজসহ নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছিল। গ্রেফতারের পর গুলশান থানায় ২০০৮ সালের জুলাইতে দায়েরকৃত ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীতে হুম্মাম কাদের চৌধুরী জামিনে ছাড়া পান। শুধু হুম্মাম কাদের চৌধুরী নয়, তার পিতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করার সময়ও নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছিলেন সাকা চৌধুরী ও তার পরিবারের লোকজন। ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসায় অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় ধানম-ি থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ। অভিযানকালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক হাঙ্গামা ও মারামারি হয়। তল্লাশিকালে হাতাহাতিতে ৯ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালায়। কিন্তু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। ওই সময় তার পরিবারের তরফ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযানকালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ির দামী মালামাল তছনছ ও লুটপাট করার অভিযোগ আনা হয়েছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর রাতে গুলশানের একটি বাড়ি থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তীতে তাকে ডিবি পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদকালেও নানা নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছিল সাকা চৌধুরী। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাকা চৌধুরীর বড় ছেলে ফজলুল কাদের চৌধুরী ওরফে ফায়াজ তার পিতার অপকর্ম, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কুখ্যাতি এবং নানা ধরনের অশালীন মন্তব্য করে বিতর্কিত হওয়ার কারণে ১১ বার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পিতার হিংস্র মানসিকতার কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। নতুবা ছেলের জীবনও বিপন্ন হতে পারত। সাকা চৌধুরীর মতো স্বভাব তার ছোট ছেলে হ্ম্মুাম কাদের চৌধুরীর। সাকা চৌধুরী গ্রেফতারের পর হুম্মাম কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে বসে দেশে বড় ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির নীলনকশা তৈরি করছিল। এজন্য সাকা চৌধুরীর ফাঁসিতে মৃত্যুর পরেও তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর ওপর সর্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে।
×