ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী মাল দরিয়ায় ঢালার নয়, অপচয় রোধে আন্তরিক হোন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ আগস্ট ২০১৬

সরকারী মাল দরিয়ায় ঢালার নয়, অপচয় রোধে আন্তরিক হোন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ক্ষমতা কোন ভোগের বস্তু নয়, জাতির প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের। দেশের শাসনকার্য পরিচলনা করা গুরুদায়িত্ব। তবে কারও কাছে ক্ষমতা ভোগের বস্তু হলেও আমাদের চিন্তা হচ্ছে দেশ, জাতি ও জনগণের প্রতি কর্তব্য পালন করা। মানুষ যে আমাকে একটা ভোট দিল, তার বদলে সে কি পেল- এটাই আমাদের জন্য বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে গেলেই যেন বিপদ বেশি হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেজন্যই প্রাণ দিতে হয়েছিল। আর পঁচাত্তরের পর থেকেই দেশে শুরু হয় হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও কার্যালয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, জীবনমানের উন্নতি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যুতসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, বাজেট বৃদ্ধি, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের কাতারে পৌঁছানোসহ দেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে বলেন, এই এগিয়ে চলাটা যেন কোনমতেই থেমে না যায়। সেটাই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কার্যক্রম নিচ্ছি। কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় রোধে সবাইকে আন্তরিক হবার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এখন বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ৯০ ভাগ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি। সেই সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। এতে আমাদের নিজেদেরও কাজের একটা স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ অর্থটা আমাদের, এটার যেন অপচয় না হয়। তিনি বলেন, প্রকল্প প্রণয়নটা শুধু অর্থ ব্যয়ের চিন্তা থেকেই যেন না হয়। সেখান থেকে কতটুকু দেশের উন্নতি হবে আর এর সুফল মানুষ কতটুকু পাবে সে হিসাবটাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছর নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিস্বাক্ষর হলো। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সিনিয়র সচিব এবং সচিবগণ নিজ নিজ মন্ত্রণালয়, দফতর ও বিভাগের পক্ষে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন দফতর ও সংস্থাগুলোর সঙ্গেও এই চুক্তি হয়। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ আবুল কালাম আজাদ, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় এবং সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী জাতি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ভিক্ষুকের জাতির কোন ইজ্জত থাকে না- সুতরাং আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হই। পাঁচ বছরে আমরা জনগণকে কতটা সেবা দিতে পারব। আর সেটা অর্জন করাই আমাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া কোন দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। আমাদের সৌভাগ্য আমরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে পেরেছিলাম। ফলে গত পাঁচ বছরে যে কাজগুলো শুরু করেছিলাম, তা সম্পন্ন করতে পারছি। এক সময়ের প্রচলিত চিন্তা-ভাবনা ‘সরকারী মাল, দরিয়ায় মে ঢাল’ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে যে, সরকারের সম্পদ হচ্ছে জনগণের। জনগণেরই কল্যাণে কাজ হবে, ব্যয় হবে। এটা দরিয়াতে ঢালার জন্য নয়। প্রধানমন্ত্রী মানুষকে সুন্দর আগামীর জন্য স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণের জীবনমান উন্নয়নের যে চেতনা তা জনগণের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে পারলেই দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। মানুষকে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে হবে যে, তার জীবনটাও উন্নত হবে, হাহাকার থাকবে না, জীবনমান উন্নত হবে। সবসময় তাদের ভেতরে একটা চেতনা জাগরুক রাখতে হবে, তবেই উন্নয়নের কাজটা ত্বরান্বিত হবে। তিনি বলেন, আমরা দেশকে উন্নত করতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই কিন্তু আমাদের রাজনীতি। আমরা নানা ধরনের রাজনীতি অতীতে দেখেছি। কিন্তু যে দলটা একবারে তৃণমূল থেকে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে গঠিত হয় এবং মানুষের জন্য কাজ করতে পারে, ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, তাদের মানুষের জন্য চিন্তা-ভাবনাটা অন্যরকম থাকে। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসলে তাদের চিন্তাটা অন্যরকম। শেখ হাসিনা বলেন, ভোটের অধিকারটাও কিন্তু আমাদের অর্জন করতে হয়েছে- অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে। সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কাজেই আমরা সেই চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাজ করছি বলেই আজকে যেমন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, মানুষের জীবনমান কিছুটা হলেও উন্নত করতে পেরেছি। আমরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করেছিলাম- স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব মধ্য আয়ের দেশে বাংলাদেশকে উন্নীত করে আর ২০৪১ সালনাগাদ বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ। তিনি বলেন, মানুষকে আমাদের সকল কাজ এবং উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিতে হবে। মানুষকে এটা উপলব্ধি করাতে হবে দেশটা আমাদের, আমাদের এর উন্নয়ন করতে হবে এবং সরকার যাই করছে আগামী প্রজš§ যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সেই চিন্তা থেকে করা হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন হলে জনগণের উন্নয়ন হবে। জনগণের মাঝে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ মেয়াদী কর্মসূচী ছাড়া কখনও দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতির পিতা আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। আমরা ’৯৬ সালে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করি এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করি। এরমধ্যে কোন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয়নি। এখন আমরা ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছি। তিনি বলেন, যদি আপনারা অতিরিক্ত শ্রম দিতে পারেন, তবে আমাদের লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পারব। তিনি বলেন, ২০০৭ সালে আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি সেখানে বসেও ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে কখন কিভাবে কাজ করা যেতে পারে, কিভাবে দেশকে একটি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, তা নিয়ে ভেবেছি। ছোট ছোট কাগজে আমার ভাবনাগুলো লিখে রেখেছিলাম। আর পরবর্তীতে সেগুলোর ভিত্তিতেই একটি সার্বিক পরিকল্পনার আকারে তৈরি হয় রূপকল্প-২১। তিনি বলেন, দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত করার নীতিমালা নিয়েই আমরা সরকার গঠন করি। আমাদের লক্ষ্য একটাই গণতান্ত্রিক সুশাসনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। জাতিসংঘের এমডিজি এবং এসডিজি প্রণয়নে সময় তার জাতিসংঘে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল- উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রস্তাবই তখন জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকা- এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের অর্জনকে সকলেই সাধুবাদ দিয়েছে এবং গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই দেশের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। এর আগে যখন দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল তখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন কাজের ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে তার বাস্তবায়ন করা হলে তা খুব একটা কঠিন হয় না। আমরা ক্ষমতায় আসার পর দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব, কত সালের মধ্যে কী-কী করব তা ঠিক করি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, নিরাপত্তা, গ্যাস ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে আমরা গুরুত্ব দিই। তিনি বলেন, পাঁচ বছর ক্ষমতার মেয়াদে কতটুকু কাজ করতে পারব সেটা সুনির্দিষ্ট করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়ানো। শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যে সংবিধান দিয়ে গেছেন। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বাজেট বৃদ্ধি করেছি। এতো বিশাল আকারে বাজেট বাংলাদেশে আর কেউ দেয়নি। গত অর্থবছরে সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কাজে আরও গতিশীলতা আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা এবং আমাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার আলোকে সরকারী কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির একটি কাঠামো অনুসৃত হয়ে আসছে। এই পদ্ধতির আওতায় প্রতিবছর প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এটি মূলত, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গেই চুক্তি করা হয়ে থাকে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মহলকে আন্তরিক হওয়ার পাশাপাশি এটি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
×