ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

পরিবেশ সচেতন রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৫ আগস্ট ২০১৬

পরিবেশ সচেতন রবীন্দ্রনাথ

আমরা খুব বিস্ময়ের সঙ্গে উপলদ্ধি করি রবীন্দ্র যুগে প্রকৃতি নিয়ে এখনকার মতো এমন সচেতন, বিপরীত ও অগ্রগামী ধারণা না থাকলেও রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা, গল্প, নাটক, আর প্রবন্ধে আধুনিক পরিবেশ সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে। পরিবেশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই সচেতন উপলব্ধি রবীন্দ্র সাহিত্যকে করে তুলেছে অনেক বেশি সমসাময়িক আর বর্তমানকালের জন্য যুগোপযোগী ও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের মতন আরেক প্রকৃতি প্রেমী কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কে তার “‘টিনটার্ন এবে’ কবিতায় দেখা যায়- ওয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে এর মর্মর ধ্বনি নয় বরং কান্নার ধ্বনি শুনতে পান; শিল্প বিপ্লবের যে বিষাক্ত পরিণাম ওয়ে নদী বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাই যেন বিষাদময়তায় শুনেন। কীটস, শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হুহটম্যান, রবার্ট ফ্রস্ট ও রীবন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় সচেতন বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতি সহমর্মিতাবোধ এসেছে। রীবন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকে আধুনিক যন্ত্র দানবের কথা পরিষ্কারভাবে এসেছে এবং মানুষ কিভাবে বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির জল ধারাকে বাগে এনে প্রকৃতির উপর অবিচার করে এতে তার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তার ডাক- ‘ফিরে চল মাটির টানে’ বা ‘এসো নীপবনে ছায়া বীথি তলে, করো ¯œান নব বারি ধারা জলে’ এ রকম আরো অনেক গানে ও কবিতায় পরিবেশের প্রতি কবির গভীর সচেতন মনোভাব ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্র কাব্যে জগতের সকল সৃষ্টির প্রতি সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রকৃতি এসেছে বহু-মাত্রিকতায়। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি-চিন্তাকে শুধু তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণ করেননি বরং তিনি একনিষ্ঠ ভক্তি নিয়ে প্রকৃতি রক্ষায় নিবেদিত হয়েছিলেন। শুধু প্রকৃতি প্রেমে নিমগ্ন নয়, আবার দূষণমুক্ত পরিবেশ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন তার সময় থেকে কালোত্তীর্ণভাবে অগ্রগামী। পরিবেশ ভাবনা সাম্প্রতিক হলেও পরিবেশ সচেতনতা কিন্তু মোটেও সাম্প্রতিক নয়। মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিনিয়ত তা জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম পরিবেশ বিষয়ে নাড়া খান জাপান যাবার পথে ১৯১৪ সালে একটি জাহাজের থেকে তেল চ্্ুঁইয়ে পড়তে দেখে। আধুনিক মানুষের এই উদাসীন মনোভাব প্রকৃতিপ্রেমী রবীকে তীব্র নাড়া দেয়। এর ফলে, রবীন্দ্রনাথের অজস্র লেখায় পরিবেশ সচেতনতা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও তার প্রবন্ধ -‘পল্লী প্রকৃতি’, শহর ও নগর’, ‘বিলাশের ফাঁস’, ‘অরণ্য দেবতা’, ‘হলকর্ষণ’, ‘উপেক্ষিতা পল্লি’ , তার কবিতা ‘দুই পাখি’, ‘বসুন্ধরা,’ ‘প্রশ্ন’ ও গীত নাট্য ‘রক্ত করবী’ ও ‘মুক্ত ধারা’য় ও তার চিঠিপত্র ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে তার গভীর পরিবেশ সচেতনতা তার পরিবেশ ভাবনাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করবার তাগিদ যোগায়। তাই“‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় কবি উদাত্তভাবে শহুরে জীবন ত্যাগ করতে আহ্বান জানান : “দাও ফিরে সে অরণ্য , লও এ নগর। লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর” পরিবেশ ভাবনা ও সচেতনতা রবীন্দ্রনাথের রচনায় শুধু নয় তা দেখা যায় তার বিভিন্ন পদক্ষেপে। একজন একনিষ্ঠ প্রকৃতি-কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। কৃষি ব্যাংক স্থাপন, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও ধর্মগোলা স্থাপন এর উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথ তার ছেলে ও তার ভাইয়ের ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় আধুনিক কৃষিবিদ্যা শিক্ষালাভ করতে ব্যারিস্টারি পড়তে নয়। তারা বিদেশ থেকে ফিরে কবির নির্দেশনায় শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, সার, বীজ, সেচ ইত্যাদির ব্যবহার সংবলিত কৃষিকাজ। এছাড়াও কুটির শিল্প স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথকে গ্রামীণ মানুষকে কৃষিজ-শিল্পে উৎসাহিত করতে দেখা যায়; এটিও তার পরিবেশ সচেতনতার অংশ। পরিবেশকে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হতে দেখে কবি বিচলিত হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে নয়। ‘তপোবন’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, পৃথিবীর এ প্রান্তে কিভাবে মানুষ আর প্রতিবেশ এক অপরের সঙ্গে মিলেমিশে ছিল এক সময় যা এখন আর নেই। রবীন্দ্রনাথের লেখনীর আর কর্মনিষ্ঠার আলোকে বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন পরিবেশবাদী। তাই কবি প্রকৃতির প্রতি সচেতন হয়ে ‘বৃক্ষরোপণ’ নামে গাছ লাগানোর একটি উৎসবের সূচনা করেছিলেন। ‘হলকর্ষণ’ নামে রচনা করেছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। ১৯২৫ সালের পঁচিশে বৈশাখ কবির জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে। বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গান গাওয়া হয়। যা রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ সচেতনতা প্রকাশ করে দারুণভাবে : ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’ তার বেশ কিছু অনবদ্য প্রবন্ধে গ্রামের প্রতি অনুরাগ আর তা রক্ষার তাগিদ ফুটে উঠেছে। এইসব প্রবন্ধে তার পরিবেশ সচেতনতা তাকে নিঃসন্দেহে পরিবেশবাদীরূপে তুলে ধরেছে। তার গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবাদী প্রবন্ধগুলো হলো : ‘পল্লী-প্রকৃতি’ “‘ভূমিলক্ষী’ ‘দেশের কাজ’“‘শ্রীনিকেতন’ “‘পল্লী সেবা’ ও“‘উপেক্ষিতা পল্লী’ ইত্যাদি। শিল্পায়ন, নগরায়নের নামে ফসলি জমির যে ক্ষতি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বিচলিত ছিলেন। এইসব বিষয়গুলো এখন আরো বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ইকো-পয়েটদের সর্তকতাও প্রকাশ পাচ্ছে এর বিরুদ্ধে। (১৭ পৃষ্ঠার পর) আমরা দেখি হাল আমলের ইকো-পয়েট যেমন গ্যারি ¯œাইডার (১৯৩০-) বা ওয়েনডেল ব্যারি (১৯৩৪-) প্রকৃতি সংরক্ষণে সতর্কবার্তা দেন। রবীন্দ্রনাথও তেমনিভাবে সতর্কবাণী দিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শত বছর আগেই পরিবেশের ক্ষীয়মাণ রুগ্ন দশা দেখে তা রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিলেন তার লেখনীর মাধ্যমে। ‘পল্লী প্রকৃতিতে’ তিনি বিষাদের সুরে-হারিয়ে যাওয়া গ্রাম্য সৌন্দর্য আর শহর ও শিল্পের উত্থানে ব্যথিত হন। কারণ তিনি তখনি বুঝতে পারছিলেন যে এই নগরায়ন আর প্রকৃতির বিনাশ আমাদের সঙ্গে পরিবেশের যে ভারসাম্য তা একসময় আমাদের হুমকির মুখে ফেলবে। আজ থেকে শতবর্ষ আগেই তিনি যন্ত্রের ব্যবহার যাতে মঙ্গলময় হয় তা বলে গেছেন ‘পল্লী প্রকৃতিতে’: মানুষ যেমন একদিন হাল লাঙ্গলকে, চরকা তাঁতকে, তীর ধনুককে, চক্রবান যানবাহনকে গ্রহণ ক’রে তাকে নিজের জীবনযাত্রার অনুগত করেছিল, আধুনিক যন্ত্রকেও সেইরকম করতে হবে।’ কিন্তু এতদিন পরে এসে আমরা যা দেখছি প্রাকৃতিক শক্তির প্রাধান্য নয় বরং যান্ত্রিক শক্তির প্রাবল্যে প্রকৃতি আজ সত্যিই অসহায়। ‘অরণ্য দেবতা’ নামক প্রসিদ্ধ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হলো। তিনি বলেন যে মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদ রক্ষা করাই সর্বত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধাতা পাঠিয়েছিলেন প্রাণকে, চারদিক তারই আয়োজন করে রেখেছিলেন। মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ যুগিয়েছে। বিধাতার অভিপ্রায় লঙ্ঘন করেই মানুষের সমাজ আজ এত অভিসম্পাত। তিনি দেখিয়েছেন উন্নয়নের নামে, ভোগের বশবর্তী হয়ে মানুষ বন কেটে উজাড় করে দিচ্ছে। গাছ কাটছে নির্বিচারে। কিন্তু এতে করে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, বিপর্যস্ত হচ্ছে মানবতা এবং মানুষ ও তার সভ্যতা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই রবীন্দ্রনাথ ‘তপোবন’ প্রবন্ধে বেদনার সঙ্গে বলেন, একসময় এই ভূখ-ে মানুষ আর গাছপালা একে অপরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকতো তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিসর্গের যে সৌন্দর্য নান্দনিকভাবে এঁকে গিয়েছিলেন তা অতুলনীয়। এখানে উচ্ছ্বাস আছে, প্রেম আছে, আধ্যাত্মবাদ আছে, উপনেষেদিক চিন্তা আছে, অজানাকে পাবার আকুতি আছে, আছে প্যান্থেয়িজম। কিন্তু প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের ভিতরেই যে উইলিয়াম ব্লেকের “‘সিক রোজ’ এর মতো কদর্য রূপ আছে তাও তিনি বলে গেছেন। আর প্রকৃতির এই মৃতপ্রায় অবস্থার জন্যে যে দায়ী আমরা সচেতন মানুষেরা তা বুঝতে কষ্ট হয় না। কারণ মানুষ কখনোই প্রকৃতির সঙ্গে নৈতিক আচরণ করেনি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেন ইকো-পয়েটদের মতো: আমি যেভাবে প্রকৃতিকে এঁকেছি তা তার বাইরের রূপ মাত্র। এখন বাকি ভাবনাটা আপনাদের ওপর- প্রকৃতির যে কি করুণ আর বিপর্যস্ত অবস্থা! বনবাণীর ‘বৃক্ষবন্দনা’ পরিবেশবাদী চিন্তাবিদদের কাছে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা; কারণ গাছ রক্ষা বর্তমান পরিবেশবাদীদের কাছে অন্যতম প্রধান বিষয়। একদিকে গাছ আমরা নির্বিচারে নিধন করছি; আবার বলছি এই গাছকে রক্ষা করতে হবে আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আশ্রয় নেন গাছের কাছে তার সংগীতময় উৎসবে: বাণীশূন্য ছিল একদিন জলস্থল শূন্যতল, ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয়, কবি ছুটে যান বৃক্ষের তলদেশে কারণ বৃক্ষ শান্তির বাণী ধরে রাখে যুগ যুগ ধরে : তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে, শুনিতে মৌনের মহাবাণী; কবিতাটি আমাদের বর্তমান কালের কবি চার্লটে মিউয়ের কবিতা ‘দ্য ট্রিজ আর ডাউন’ এর কথা মনে করিয়ে দেয় কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো গাছের নিচে শুধু সান্ত¡না পান না বেদনাহত মনে দেখেন গাছেদের করুণ অন্তর্ধান। এই বেদনার মাঝেই তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো বৃক্ষপ্রেম রেখে যান; চার্লটের চাওয়া এই গাছ নিধন বন্ধ হোক। “‘রক্তকরবী’ নাটকটি মানুষের অপরিসীম লোভ আর প্রতীকীভাবে পুঁজিবাদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কতোটা অমানবিক আর দুর্বল হয়ে পড়ে রাজা মকররাজ তার উদাহরণ। রাজা মকররাজ তার ‘যক্ষপুরী’ কারাগারে মাটির তল খুঁড়ে একদল ক্রীতদাস দিয়ে সোনা আহরণে মগ্ন। রাজার এই সোনা আহরণের নেশায় প্রকৃতি হতে থাকে ক্ষতবিক্ষত। চলে প্রকৃতির প্রতি অন্যায় অবিচার। রাজার নাগপাশে বন্দী একদল লোক। খুবই লোভী রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরছে তার নিযুক্ত সোনার খনির শ্রমিকরা। পুঁজিবাদী সমাজের অসহায় প্রতিনিধি তারাই রাজার স্বর্ণলাভের একমাত্র মাধ্যম। পুঁজিবাদের কালো থাবা যেভাবে খনি খুঁড়ে, শিল্পায়ন আর শহরায়নের নামে প্রকৃতিকে বিদীর্ণ করছে আধুনিক ইকো-পয়েটরাও তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ একটি গীতিনাটক। ‘মুক্তধারা’ নাটকে আধুনিক যন্ত্র দানবের কথা পরিষ্কারভাবে এসেছে এবং মানুষ কীভাবে বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির জল ধারাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে প্রকৃতির উপর অবিচার করে এতে তার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। নাটকটিতে প্রতীকীভাবে একচ্ছত্র শাসকদের অপশাসন আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে চরম উদাসীনতা প্রকাশ পেয়েছে গভীরভাবে। মুক্তধারায় রবীন্দ্রনাথ গানের মাধ্যমে যন্ত্রের বিকটতা তুলে ধরেন- যন্ত্রকে বলেন, ‘ধ্বংসবিকট দন্ত’: ‘নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত, তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট দন্ত।’ সেই যন্ত্রই আজ পৃথিবীর এ প্রান্ত্র থেকে ও প্রান্ত, ভূ-গর্ভ থেকে নদী-নালা, খাল-বিল, বন-জঙ্গল ধ্বংস করে চলছে। আর পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। রবীন্দ্রনাথ যে সতর্কতার কথা বলে গিয়েছিলেন আগেই। ইকো-পয়েটদের মাঝেও আমরা এই সকল বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। বর্তমান ইকো-পয়েট ড.ঝ.গবৎরিহ, ঊষরুধনবঃয ইরংযড়ঢ় ও উবহরংব খবাবৎঃড়া, এদের কবিতায় আমরা রবীন্দ্রনাথের মতো প্রকৃতির উপর মানুষের ধ্বংস যজ্ঞের চিহ্ন দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত ‘দুই পাখি’ কবিতায়, দুটি পাখি- একটি বনের একটি খাঁচার পাখির দারুণ কথোপকথনের মাধ্যমে সভ্যতা ও প্রকৃতির মাঝে যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব তা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। দুই পাখির খাঁচার পাখি হচ্ছে সংস্কৃতি যাকে মানুষ বন্দী করে রাখে আর নিজের মতো চালনা করে; আর এক পাখি বনের পাখি হচ্ছে মুক্ত প্রকৃতির প্রতীক; দুই পাখি একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু দুই দ্বান্দ্বিক জীবন তাদের মিলনের প্রতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এখানে মানুষের দুটো বিছিন্ন রূপ কবি মনোবৈজ্ঞানিকভাবে রূপায়িত করেন। দুই পাখির দ্বন্দ্বভরা কথোপকথনে বেরিয়ে আসে খাঁচার পাখির চরম অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা। যেমনভাবে বর্তমান বৈজ্ঞানিক জীবন অভ্যস্ততা প্রকৃতিকে বন্দী দাসে পরিণত করে আমাদের অস্তিত্বকে নির্জীব আর দুর্বল করে দেয় তেমনিভাবে খাঁচার পাখি বনের পাখির আকুতি ভরা আহ্বান গ্রহণ করতে পারে না। প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা যে মানুষকে কতটা কৃত্রিম করে তোলে তার প্রমাণ মেলে প্রতীকীভাবে খাঁচার পাখির কৃত্রিমতায় রূপকভাবে। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প “‘বলাই’ পরিবেশ সচেতনতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। গাছপালা আর প্রকৃতির প্রতি বলাইএর আকর্ষণবোধ আর ভালোবাসা পরিবেশ সচেতনতার একটি অনন্য সাহিত্য কর্ম। বলাই এর পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ দেখে বলা যায়, বলাই পরিবেশ সচেতন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য চরিত্র। একটি শিমুল গাছের প্রতি বলাই এর অনুরক্ততা, রবীন্দ্রনাথ যে পরিবেশ সচেতনতার খুব প্রথম সারির দার্শনিক ছিলেন তাই প্রমাণ করে। ঘাস, লতাপাতা, গুল্মের প্রতি বলাইয়ের ভালোলাগা কারো কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে কিন্তু বলাই এর কাছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক প্লান্ট বায়োলোজস্টিদের কাছে ও একবিংশ শতকের পরিবেশবাদী কবিদের কাছে। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষ যে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে পৃথিবীকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে রবীন্দ্রনাথ সে কথাও বলে গিয়েছিলেন, অথচ এ ভারসাম্যের ব্যাঘাতের জন্যই আজ বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, এই জলবায়ু পরিবর্তন আজ বিশ্ব-সমস্যা। জলবায়ুর এই অসম পরিবর্তন ও বিশ-উষ্ণতা যদি না ঠেকানো যায় তবে হয়ত: আর অল্প কিছু কালের মাঝেই এ ধরিত্রী বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। রবীন্দ্রনাথের এই পরিবেশ ভাবনা, এটিকে শুধু নান্দনিকভাবে ব্যাখ্যা করলে তার সচেতন চিন্তাকে অবহেলা করা হবে। রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মে গাছ, পাখি, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় যে অগ্রগণ্য চিন্তার খোরাক রেখে গেছেন তা বর্তমান সময়ের আধুনিক লেখকরা আরো সোচ্চার হয়ে লিখবার তাগিদ অনুভব করছেন। এর ফলশ্রুতিতে রোমান্টিক কবিতার আধুনিক রূপ ইকো-কবিতার উদ্ভব। ইকো-কবিতা প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে একে রক্ষার ব্যাপারে তৎপরতা দেখায়, গাছ নির্মূল, পশু নিধন, বায়ু দূষণ, অতি নগরায়ন এবং নির্মল প্রকৃতিতে এর দুর্যোগপূর্ণ প্রভাবের কথা বলে; মানুষ ও প্রকৃতি যে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও নির্ভরশীল সেই কথা বলে। এ দিক থেকে চিন্তা করলে আমরা রবীন্দ্রনাথকে উত্তর-আধুনিক চিন্তাবিদ বলতে পারি কারণ ইকো-পয়েট্রি (ঊপড়ঢ়ড়বঃৎু) নামের নতুন যে পরিবেশ সচেতন কবিতার উদ্ভব হয়েছে তা একটি উত্তর- আধুনিক কাব্য ধারা যা প্রকৃতিকে রক্ষার কথা বলে সরাসরি; আর রূপকভাবে বা সরাসরি এই কথাগুলো রবীন্দ্র সাহিত্যে গভীরভাবে প্রতিফলিত। এমনিভাবে আজ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এতদিন পরেও রবীন্দ্র সাহিত্য আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ চাননি মানুষ প্রভু হয়ে পরিবেশকে দাস করে নিয়ন্ত্রণ করুক। রবীন্দ্রনাথ ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতি তথা মানুষের সঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যপূর্ণ সহ-অবস্থানের কথা বলে গেছেন; যা আধুনিক যান্ত্রিক যুগে খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে। কারণ এখন সেই আকুল শ্রাবণ নেই, বৈষ্ণিক তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে, শীতকালে হচ্ছে অকাল বৃষ্টি, শরতের সেই মনোহর রূপ আজ উধাও হতে যাচ্ছে। মানুষের অপরিসীম লোভ প্রকৃতিকে করে তুলেছে ভারসাম্যহীন। নির্বিচারে বন উজাড়, গাছ কাটা, ব্যাপকহারে নগরায়ন ও শিল্পায়ন ও এর উদ্ভূত বিরূপ উপজাত- বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন পরিবেশের জন্যে মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথ তার কাব্যে, গানে, প্রবন্ধে খুব সচেতন হয়ে এই কথাটি বলে গেছেন; আজ তা বুঝবার দিন এসেছে তাই বহুমুখী রবীন্দ্র-সাহিত্য এখন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে ভালোবেসেছিলেন গভীরভাবে তার সঙ্গে যেন প্রকৃতির একটা আত্মিক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রাণরূপী-প্রকৃতি কবির মন প্রাণকে এবং জীবনকে করেছিল অর্থবহ তার সাহিত্য চর্চাকে করেছিল পরিপূর্ণ। কিন্তু যে প্রকৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত তা আজ চরম দুর্দশাগ্রস্থ। প্রকৃতির উপর মানুষের লোভী আক্রমণ আর ধ্বংসযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করে গভীর বেদনায়। তিনি জানতেন মানুষের প্রকৃতির উপর এই অপরিসীম লোভ আর ক্ষুধা কখনো শেষ হবে না। তাই “‘প্রশ্ন’ কবিতায় কবি সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচারের ভার রেখে যান এইভাবে : ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছ ভালো?’
×