ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাইদুর রহমান প্যাটেল

আমার বন্ধু কামাল

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৫ আগস্ট ২০১৬

আমার বন্ধু কামাল

কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন, চারদিকে তার বাঁধন কেন?, ভাঙরে হৃদয়, ভাঙরে বাঁধন, সাধরে আজিকে প্রাণের সাধন’ কবিগুরুর কবিতার মতোই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শেখ কামাল- হে প্রিয় বন্ধু আমার, শুভ জন্মদিন তোমায়। শেখ কামালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৬৬ সালে আমি তখন গে-ারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং স্কুল শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি। স্কুল পর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটির কথা শুনে অনেকেই হয়ত অবাক হবেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্কুলের ছাত্ররাও পাকিস্তানী শাসকদের নির্যাতনের কারণে রাজনীতির ময়দানে নামতে বাধ্য হয়েছিল। সম্ভবত, স্কুল পর্যায়ে ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি গঠিত হয়েছিল গে-ারিয়া স্কুলেই। ওই কমিটি গঠিত হয়েছিল জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ভিপি রাজু ভাই, ছাত্রলীগ নেতা আলী রোজ ভাই, সাইফুদ্দীন ভাই প্রমুখের উদ্যোগে। সে সময় আমি, শিরু, নজরুলসহ কয়েকজন নিয়মিত জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। তাদের নির্দেশ মতো এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতাম। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা অষ্টম নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে মিছিল বের করি। পোস্তগোলার হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরি পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে যত ইংরেজী সাইনবোর্ড ছিল সব নামিয়ে ফেলি। প্রত্যেক গাড়ির ইংরেজী নামফলক কালো রং দিয়ে মুছে দেই। ফেরার পথে আরসিন কোম্পানির গেটের সামনে সূত্রাপর থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং ওসি আমাকে মারধর করে। আমি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে জগন্নাথ কলেজে যাই। রাজু ভাইরা সব শুনে সূত্রাপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ‘গে-ারিয়া স্কুলের ছাত্রদের ওপর সূত্রাপুর থানার ওসির আক্রমণ’ শিরোনামে তা ফলাও করে ছাপা হয়। আমাদের এই রাজনৈতিক তৎপরতা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই থেকে তিনি নিয়মিত আমাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ এবং খোঁজ-খবর রাখতেন। এই রাজনৈতিক কর্মকা-ের সুবাদে ওই বছরই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। প্রথম সাক্ষাতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ও আমার সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল’। ধানম-ি ৩২ নম্বরে যাতায়াতের সূত্র ধরেই বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পর্যায়ক্রমে আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। আমরা দু’জনেই সমবয়সী বিধায় ক্রমান্বয়ে সেই যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বন্ধুতে রূপ নেয়। আমি যতই তার কাছে যাই, তার আচার আচরণে মুগ্ধ হই। বঙ্গবন্ধুর সন্তান ছাড়াও যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলেও বলতে হবে, ব্যক্তি কামালের মতো সৎ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৎকালীন সময়ে খুব দুর্লভ ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন শেখ কামাল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান এমএজি ওসমানীর এডিসি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমি একক উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করি। আমাদের দ্বিতীয় খেলা ছিল মোহন বাগানের সঙ্গে। সেই সময় মাঠে উপস্থিত ছিলেন শেখ কামাল। শেখ কামাল যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের উন্নয়নে সাংগঠনিক কাজে আমৃত্যু দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে শেখ কামালের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি একজন ভাল ফুটবলার ও জনপ্রিয় বাস্কেটবল খেলোয়াড়ই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ ক্রীড়া সংগঠকও। তার নেতৃত্বে এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। আবাহনী ক্লাব প্রতিষ্ঠার পেছনে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ফুটবলে আধুনিক ধারা প্রবর্তনে তিনি আয়ারল্যান্ড থেকে প্রথিতযশা কোচ মি. হার্টকে নিয়ে আসেন। তার কোচিংয়ে দেশের ফুটবল এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু যেমন একজন দেশপ্রেমিক ও ক্রীড়ানুরাগী ছিলেন, শেখ কামালও বাবার সেই গুণকে ধারণ করতেন মনে-প্রাণে। খেলার বাইরে তিনি খুব ভাল অভিনয় করতেন। নাটকের প্রতি খুব অনুরাগী ছিলেন তিনি। তিনি স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন। ছাত্র হিসাবেও তিনি ছিলেন বেশ তুখোড়। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন শেখ কামাল। সব সময় তার মাথায় ছিল তিনি কার ছেলে? এমন কিছু কখনও করতেন না যাতে বাবার নামে এতটুকু অমর্যাদা হয়। যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানেন, কতটা আদর্শ জীবন যাপন করতেন শেখ কামাল। বড় বেশি প্রাণোচ্ছ্বল ছিলেন শেখ কামাল। তাঁর কথা একদিনে লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আরও অনেক আগেই সমৃদ্ধশালী হতো। এই আগস্টেই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন, আর সেই আগস্টেই ঘাতরের নির্মম বুলেটে সপরিবারে তাঁকে চলে যেতে হলো। এ দুঃখ ভোলার নয়। কামাল বাংলাদেশের মানুষ তোমায় ভুলবে না কোনদিন। লেখক : শেখ কামালের বন্ধু
×