ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৪ আগস্ট ২০১৬

দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

সময়টা ১৯৭১। পাক বাহিনী শুরু করে ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। নির্মম নির্দয় পৈশাচিক সেই গণহত্যা। নারকীয় সেই হত্যাকা সেই সময় যারা দেখেছে শুধু তারাই কেবল বর্ণনা করতে পারবে। আমরা যারা নুতনপ্রজন্ম বা জন্ম যাদের ’৭১ এর পর, আমরা কেবল ভিডিও ফুটেজ আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রচিত বই পড়ে জানতে পারি সেসব দিনগুলোর কথা। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বিশ্ব বিবেক কেঁপে ওঠে। অনেকে কেঁদেছে আমাদের সেই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ দেখে। তেমনি একজন ভারতের বিখ্যাত ‘প-িত রবিশঙ্কর।’ প-িত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের ‘শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে; নিয়ে এক অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। যার নাম ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই অবিস্মরণীয় কনসার্টটি, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। গত এক আগস্ট ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তার ৪৫ বছর পূর্ণ করল। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমেই মূলত বিশ্বপরিসরে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট পৌঁছে যায়। এ কনসার্টের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ পি ত রবিশঙ্কর। তাঁর জন্ম ভারতের পশ্চিম বাংলায়। তিনি তখন বসবাস করতেন ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে। ভারতে বিপুলসংখ্যক মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে আসার খবর শুনে তিনি বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠেন। উদ্বাস্তুদের মধ্যে তাঁর অনেক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়-পরিজনও ছিল। তিনি তাদের, বিশেষ করে শিশুদের সাহায্য করতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। রবিশঙ্কর বাংলায় ‘জয় বাংলা’ সহ বেশকিছু গান বাঁধেন। এমনকি তিনি এ্যাপেল রেকর্ড থেকে একটি গানের এ্যালবামও বের করেন। কিন্তু সঙ্কটের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে এই রেকর্ড বিক্রি থেকে যে যৎসামান্য লাভ হয়, তা ছিল নিতান্তই নগণ্য। ১৯৭১ সালের মে মাসে তিনি অনুধাবন করেন, বড় একটা কিছু করা দরকার। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে তিনি একটি চ্যারিটি কনসার্টের পরিকল্পনার কথা জানান। এর পর ১৯৭১ সালের আগস্ট রবিবার অপরাহ্ণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৪০ হাজার দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে উপস্থিত হন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিংগো স্টার, বিলি প্রেস্টন, রিওন রাসেল, সারোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং প-িত রবিশংকর তো আছেনই। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লারাখা খান আর তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই রবিশংকর বাংলাদেশের অবস্থার কথা সংক্ষেপে সবার কাছে তুলে ধরেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে। হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা বিস্ময়াভিভূত হয়ে শুনছিলেন রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনের কথা। জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের বর্বরতার কথা ব্যক্ত করার সময় একসময় আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেনÑ তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে এবং সেই মুহূর্তে উপস্থিত হলভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কনসার্টে বেশিরভাগ গানই অর্থাৎ ৪টি গানই পরিবেশন করেন জর্জ হ্যারিসন। তাঁর বিখ্যাত গানগুলো গাওয়ার পরই সবশেষে তাঁর নিজের লেখা ও সুরে গেয়ে শোনান সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ গানটি। গানটি দর্শক-শ্রোতাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পায় এবং ৪০ হাজারেরও বেশি দর্শক দীর্ঘস্থায়ী তুমুল করতালির মাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানীদের ধিক্কার জানিয়ে বাংলাদেশকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিয়ে জর্জ হ্যারিসনকে বিপুলভাবে অভিনন্দন জানান। ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান আকর্ষণ ছিল এর নতুনত্ব ও স্বতঃস্ফূর্ততা। এই স্মরণীয় কনসার্ট জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গীত জীবনে একটি মাইলফলক হয়ে আছে। এই বেনিফিট সঙ্গীত অনুষ্ঠান ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল ইউএস ডলার ২, ৪৩, ৪১৮.৫০ (দুই লাখ তেতাল্লিশ হাজার চারশত আঠারো দশমিক পঞ্চাশ ডলার)- যার পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য এবং ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের জন্য দেয়া হয়েছিল। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হলো দুনিয়া ভর। কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ৪৫ বছর আগের দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সুদৃশ্য সেট এখনও পাওয়া যায়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অলিভার হ্যারিসন। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটি সিডিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাতকার, যাতে কনসার্টটি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। আরও আছে মহড়ার কিছু চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই নতুন ডিভিডির ভূমিকায় প-িত রবিশংকর বলেছেন, ৭৫ বছরের সঙ্গীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটি। নতুন ডিভিডিতে সাক্ষাতকারে এরিক ক্ল্যাপটন বলেছেন, এ অনুষ্ঠান সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সঙ্গীতশিল্পী হওয়াটা যে গর্বের একটা বিষয়, তা সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম। রিঙ্গো স্টার বলেন, অনুষ্ঠানটি যেন অনন্য সাজে সেজেছিল। দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল বিশাল।
×