ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে দুর্গত এলাকায় হাহাকার

বন্যার্তদের চাল লোপাট

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৪ আগস্ট ২০১৬

বন্যার্তদের চাল লোপাট

রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম ॥ প্রায় দু’সপ্তাহ হতে চলছে জেলার বন্যাকবলিত সাড়ে ৬ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। সরকারী পর্যায়ে যেভাবে ত্রাণের কথা বলা হচ্ছে বাস্তব অবস্থায় তেমন নয়। তবে বেসরকারী পর্যায়ে মানুষজন, বিভিন্ন সংগঠন ছুটছে ত্রাণ নিয়ে। এখনও বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। দুর্গত গ্রামগুলোতে টানা কয়েকদিন ঘুরে তাই মনে হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতেও জেলার কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি ত্রাণের চাল পকেটে ভরছে। এরা সরকারের নির্দেশনা না মেনে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের ২০৫ টন চাল আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রশাসনে শুরু হয় তোলপাড়। ধামাচাপা দিতে প্রভাবশালী মহল উঠে পড়ে লেগেছে। কুড়িগ্রামে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য জিআর (জেনারেল রিলিফ/খয়রাতি চাল) ২০৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়। যার পুরোটাই লোপাট করার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে সরকারের গেছে ৬৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ এ চাল লোপাটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে চিলমারী, উলিপুর, ফুলবাড়ী, রাজারহাট ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও ১০ ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে এ খবর ফাঁস হওয়ায় প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। চলছে প্রভাবশালীদের দিয়ে ম্যানেজ প্রক্রিয়া। অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা প্রশাসক খান মোঃ নুরুল আমিন স্বাক্ষরিত ২৩/০৬/১৬ তারিখের বরাদ্দপত্রে চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউপিতে ১৫ টন, চিলমারী সদর ইউপিতে ১ টন, উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউপিতে ২ টন, ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ও নাওডাঙ্গা ইউপিতে ১০ টন করে ২০ টন এবং রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট সদর ইউনিয়নে ১০ টন জিআরের চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। একইভাবে ২৯ জুন অপর এক বরাদ্দপত্রে ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ও নাওডাঙ্গা ইউপিতে ১৫ টন করে ৩০ টন, উলিপুরের হাতিয়ায় ২ টন, চিলমারীর নয়ারহাটে ২ টন ও রানীগঞ্জে ১ টন এবং ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাইকেরছড়া ও পাথরডুবী ইউপিতে ২ টন করে ৪০ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। ঈদ-উল-ফিতরের আগে সরকার বিপুল পরিমাণ ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে জনপ্রতি ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করে। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইউপি চেয়ারম্যান ও পিআইওরা এ বিপুল পরিমাণ রিলিফের চাল আত্মসাৎ করে। কাগজে-কলমে দেখানো হয় বিতরণ। অথচ রিলিফ বিতরণে সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসার, ইউপি সচিব, ইউপি মেম্বার এবং উপকারভোগী কেউ জানে না জিআরের চাল বিতরণের ঘটনা। চিলমারী উপজেলার তিন ইউনিয়নে বন্যায় প্লাবিত নিম্নাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত, অসচ্ছল গরিব, দুস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে বিতরণের জন্য জিআরের ৬ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। রানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম প্রথমে তার ইউনিয়নে দু’দফায় ৩০ টন জিআর বরাদ্দ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। সুনির্দিষ্টভাবে বরাদ্দপত্রের কথা উল্লেখ করা হলে বলেন, ভিজিএফ চালের সঙ্গে এসব বিতরণ করা হয়েছে। ট্যাগ অফিসার সহকারী শিক্ষা অফিসার আব্দুল হামিদ ও ইউপি সচিব আবু বকর সিদ্দিক এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। চিলমারী সদর ইউনিয়নে বরাদ্দ ১৫ টন সম্পর্কে কোন তথ্যই জানেন না ট্যাগ অফিসার জাহিদ হোসেন আনছারী। নয়ারহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান দাবি করেন, ভিজিএফের ৪ টন চালের সঙ্গে জিআর ২০ টন চাল তিনি বিতরণ করেছেন। তার এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ট্যাগ অফিসার সাখোয়াত হোসেন ও ইউপি সচিব মফিদুর রহমান। তারা এ ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন। চিলমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সিরাজ উদ্দৌলা জানান, জিআর বিতরণের মাস্টার রোল তার হাতে আছে। এর বাইরে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। ফুলবাড়ীর নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসেন আলী অভিযোগে জানান, এ ইউনিয়নে দু’দফায় বরাদ্দ ২৫ টন জিআরের চাল পুরোটাই লোপাট করা হয়েছে। রিলিফের এক ছটাক চালও দরিদ্র মানুষের হাতে পৌঁছেনি। একই অভিযোগ শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম সোহেলের বিরুদ্ধে। এখানেও ২ টন চাল আত্মসাৎ করা হয়েছে। নাওডাঙ্গা ইউপির ট্যাগ অফিসার আব্দুস ছাত্তার ও শিমুলবাড়ী ইউপির ট্যাগ অফিসার একরামুল হক জানান, তারা ঐ ৫০ টন জিআরের চাল বিতরণ সম্পর্কে কোন তথ্য জানেন না। এই জাতীয় বিতরণ সিটে স্বাক্ষরও করেননি। পিআইও সবুজ কুমার গুপ্ত দাবি করেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় জিআরের চাল বিতরণ করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত মাস্টাররোল এখন তার হাতে। কিন্তু ট্যাগ অফিসার ও ইউপি সচিবকে অবহিত না করে কেন বিতরণ দেখানো হলো তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক আব্দুল আউয়াল বলেন, দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ২৬ ও ৩০ জুন স্বাক্ষর করে ৫০ টন জিআরের চাল গোডাউন থেকে উত্তোলন করেন। প্রতিটন চালের সরকারী মূল্য ৩২ হাজার টাকা। উলিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সাজিনুর রহমান জানান, ৪০ টন জিআরের চাল ঈদের আগে ভিজিএফের চালের সঙ্গে বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের সচিব মাহামুদুল হাসান রানু দাবি করেন জিআরে ২০ টন চাল বিতরণ করা হয়নি। এ সংক্রান্ত কোন তথ্য ইউনিয়ন পরিষদে নেই। স্থানীয় ইউপি সদস্যরাও একই অভিযোগ করেন। ভুরুঙ্গামারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রবিউল ইসলাম জানান, যখন যেটা বরাদ্দ আসে তা সঙ্গে সঙ্গে বিতরণ করা হয়। জিআরের ৪০ টন চালও বিতরণ করা হয়েছে মর্মে চেয়ারম্যানরা কাগজপত্র দাখিল করেছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে গিয়ে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। ট্যাগ অফিসার ও ইউপি সচিবরা এ বিষয়ে অবগত নন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব মোল্লা জানান, জেলা প্রশাসক জিআর বরাদ্দে ৫টি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। এক, মানবিক সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন নির্দেশিকা ২০১২-১৩ অনুসরণপূর্বক ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। দুই, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াকে অবহিত করতে হবে। তিন, বরাদ্দপ্রাপ্ত ইউএনও নিজ নিজ ওয়েবসাইটে বরাদ্দপত্র আপলোড করবেন। চার, উপ-বরাদ্দকৃত জিআর চাল শুধু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৩ কেজি হারে ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে অবশ্যই বিতরণ করতে হবে। পাঁচ, নিরীক্ষার জন্য যাবতীয় কাগজপত্র নিজ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
×