ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এমাজউদ্দীনের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত ॥ ফখরুল

বিএনপির জাতীয় ঐক্য জামায়াতের চাপে ভেস্তে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৪ আগস্ট ২০১৬

বিএনপির জাতীয় ঐক্য জামায়াতের চাপে ভেস্তে যাচ্ছে

শরীফুল ইসলাম ॥ জামায়াত ছাড়া দূরে থাক উল্টো এ দলটির চাপই সামাল দিতে পারছে না বিএনপি। গুলশানে জঙ্গী হামলার পর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের পরামর্শে জামায়াতকে আপাতত সাইড লাইনে রেখে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা আদায়ের কৌশল নেন খালেদা জিয়া। এ জন্য দলীয় বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে জামায়াতকে ছাড়াই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী ঐক্য গড়ার কথা প্রচার করে ১৪ দলীয় জোটের বাইরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ক’টি রাজনৈতিক দলকে কাছে টানার সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে দলীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদের জামায়াত বিরোধী বক্তব্যের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের চাপে ভেস্তে যাচ্ছে বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়া। এদিকে জামায়াতের চাপ সামাল দিতে বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বিএনপির জামায়াতকে ছাড়া প্রসঙ্গে এমাজউদ্দীনের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এটা বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামীকে আর না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদা জিয়া মর্মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বিএনপির সমর্থন নেই। অপরদিকে এমাজউদ্দীনের বক্তব্যের পর বিএনপির প্রতি জামায়াতের চাপ এবং জামায়াত না ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করার পর ১৪ দলীয় জোটের বাইরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে ক’টি দল বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হতে চেয়েছিল সেসব দল বিএনপির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী থাকায় কোন কোন দল খালেদা জিয়ার সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নিলেও জামায়াতের কারণে তাদের সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেবেন। জানা যায়, আজ বৃহস্পতিবার রাতে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের একটি প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করার কথা রয়েছে। তবে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের দলীয় অনুষ্ঠানেই কাদের সিদ্দিকী জানিয়ে দিয়েছেন জামায়াতের সঙ্গে তিনি স্বর্গেও যেতে চান না। গুলশানের চাঞ্চল্যকর জঙ্গী হামলার পর বিএনপির পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকায় খালেদা জিয়ার এ ঐক্যের আহ্বানের প্রতি আপত্তি উত্থাপন করে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল থেকেও ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে কৌশলে জামায়াতকে এড়িয়ে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলেন। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরীসহ ক’জন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রচার করতে থাকেন জামায়াতকে ছাড়াই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করেছেন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের এক মতবিনিময় সভায় প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দল বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ২০ দলের মধ্যে জামায়াতকে আর ওইভাবে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, ওই দলটিকে রাখলে যে লায়াবিলিটি আসে সেটা তিনি বহন করতে চান না। সুতরাং এই দিক থেকে দেখলে জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রফেসর এমাজউদ্দীনের ওই বক্তব্যের পর ফুঁসে ওঠে জামায়াত। সঙ্গে সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে লম্বা বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রফেসর এমাজউদ্দীনের ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে জামায়াত নেতারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেন প্রফেসর এমাজউদ্দীন এমন বক্তব্য দিলেন তার ব্যাখ্যা দিতে জামায়াত নেতারা বিএনপি হাইকমান্ডকে চাপ সৃষ্টি করেন। তাদের এ চাপের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান পরিবর্তন করে বিএনপি। মঙ্গলবারই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রফেসর এমাজউদ্দীন বিএনপির কেউ নন। তাই ২০ দলে জামায়াতকে রাখার প্রয়োজন নেই এমন কথা তিনি কেন বলেছেন তা তিনিই বলতে পারবেন। বুধবার দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। জামায়াতকে শান্ত করতে দলের অন্যান্য নেতারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, প্রফেসর এমাজউদ্দীনের বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০০ সালে চারদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এ জোট বর্তমান ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। যে সময়ে ২০ দলের ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করা প্রয়োজন, যখন জাতির প্রতিটি বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হারে হারে উপলব্ধি করছেন ঠিক এ সময়ে এমাজউদ্দীন সাহেবরা কোন উদ্দেশে কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন তা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা এমাজউদ্দীন সাহেবের সম্মানের দিকে লক্ষ্য রেখে স্পষ্টভাষায় বলতে চাই যে, ২০ দলীয় জোট এমাজউদ্দীন সাহেবকে জোটের কোন মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয়নি। ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে কোন কথা বলার অধিকার তার নেই। তিনি সম্পূর্ণ এখতিয়ারবহির্ভূত ও অযাচিত আচরণ করছেন। এর জন্য অবশ্যই তাকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় জনগণ ধরে নিতে বাধ্য হবে তিনি বিশেষ গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য আলো ও অন্ধকারের খেলায় লিপ্ত রয়েছেন। জানা যায়, ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই জাসদ (রব), কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ (খালেকুজ্জামান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও বিকল্প ধারাসহ কিছু দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে ওইসব দল থেকে আগেই জানানো হয়েছে জামায়াত থাকলে তারা ঐক্যে শামিল হবেন না। আর ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতসহ আরও ক’টি ইসলামী দল থেকে বিএনপিকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ছাড়া ঐক্য হলে পরবর্তীতে ভোটের রাজনীতিতে তারা বিএনপিকে বর্জন করবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে ক’টি দল বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হতে চায় তাদের তেমন ভোট ব্যাংক নেই। আর এ বিষয়টি আমলে নিয়েই এমাজউদ্দীনের বক্তব্যের পর বিএনপি জামায়াত না ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাই বিএনপির ডাকে যে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য হচ্ছে না তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে জামায়াত ছাড়া জাতীয় ঐক্য গড়ার কাজে বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে দেখে দলের কিছু নেতাকর্মী আশাবাদী হয়ে উঠলেও প্রফেসর এমাজউদ্দীনের বক্তব্যের পর আবার প্রকাশ্যে জামায়াত তোষণ নীতি চালু করায় হতাশ হয়েছে। জামায়াতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করায় দলের রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়েও কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে দলীয় হাইকমান্ডের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।
×