ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়ার আগে মহাদেব সাহা

বাংলার আকাশ বুকপকেটে ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৪ আগস্ট ২০১৬

বাংলার আকাশ বুকপকেটে ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি

মোরসালিন মিজান ॥ প্রিয় নদী, প্রিয় ধানক্ষেত/ক্ষমা করো লাউপাতা, ভোরের শিশির/আমার মায়ের হাতে চাল-ধোয়া জলের সুগন্ধ/আমি তোমাদের কথা রাখতে পারিনি, আমি কথা/রাখতে পারিনি...। জন্মভূমিকে দেয়া কথা রাখতে পারেননি মহাদেব সাহা। সারা জীবন দেশের মাটিতে কাটানোর কথা থাকলেও, আজ বৃহস্পতিবার দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন কবি। এ যাওয়া বেড়ানোর জন্য নয়। ফিরে আসার তাগিদ নিয়ে যাওয়া নয়। যাওয়ার জন্যই যাওয়া। সস্ত্রীক কানাডায় স্থায়ী হচ্ছেন কবি। কবিতার ভাষায়- আরো ছিন্নভিন্ন করতে হবে এই গেরস্থালি, ভিতর-বাহির।/আমার তাহলে ছেড়ে ছুঁড়ে নেমে যেতে হবে সব ফেলে, বুদ্ধের মতন/চলে যেতে হবে সব ফেলে...। আজ রাতের উড়োজাহাজ কবিকে পৌঁছে দেবে বহু দূরের দেশ কানাডায়। সমকালীন বাংলা কবিতার খ্যাতিমান কবি সেখানেই স্থায়ী হবেন। কিংবা বলা যায় স্থায়ী তাকে হতে হবে। হতে হচ্ছে। কবির মন তাই বিষণ্ণ। অনেক আগে লেখা কবিতা তার হয়ে যেন কেঁদে ওঠে। বলে- বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,/ মন ভালো নেই...। অবশ্য দেশ ছেড়ে গেলেও, দেশের হয়ে থাকবেন। দেশ নিয়ে থাকবেন। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমনটিই জানান তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহাদেব সাহা বাংলা কবিতার আকাশে উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলছেন। সেই কিশোর বয়সে কবিতার প্রেমে পড়েছিলেন। পরর্তী জীবনে সাংবাদিকতাসহ একাধিক পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর কবিতাকে করেছেন শেষ আশ্রয়। নানা বিষয়ে লেখা অসংখ্য কবিতার জনক তিনি। তার কাব্য প্রয়াস যেমন প্রশংসিত, তেমনি একেবারে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। জীবনে যত পাওয়া, কবিতা থেকেই। আর তার পর কবিতার রাজ্য ছেড়ে যাচ্ছেন কবি। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল প্রস্তুতি। এরই মাঝে সব গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। গুটিয়ে নিয়েছেন। নীরবে। নিভৃতে। এক জীবনে যত বই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন সব দান করে গেছেন বাংলা একাডেমিকে। কবির ব্যবহার করা পাঁচটি আলমারি এরই মাঝে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়ে গেছে। নিজের লেখার কলম কবিতার খাতা পা-ুলিপি গেছে জাতীয় জাদুঘরে। এভাবে সব চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছেন মহাদেব সাহা। আজ রাত ১০টা নাগাদ উত্তরার বাসা থেকে বের হয়ে যাবেন কবি। মধ্য রাতে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে চড়বেন। তার সঙ্গে থাকবেন তার স্ত্রী। ছেলের বাসা কানাডার কিলিগিরিতে। সেখানেই বাকি জীবন কাটবে তাদের। এমন একটি মুহূর্ত সামনে রেখে মুখে কোন কথা আসে না। কবি কিছু বলতেও নারাজ। অনেক চেষ্টার পর কবির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। দুই দিন দুই দফায় কথা বলার জন্য সময় দেন তিনি। কথা তবু যৎসামান্য। প্রশ্ন করার তেমন সুযোগ না দিয়ে বিষণœœ কণ্ঠে কবি বলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, বুঝতেই তো পারছেন। কথা বলার মতো স্বস্তি নেই মনে। চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। এখন কি কথা বলা যায়? কিন্তু এর পর যে কথা তিনি শোনান তা বেদনা হয়ে কানে বাজে। কবি বলেন, আমি আপনাদের সবার কাছ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যাচ্ছি। যে বয়সে সভার সভাপতি প্রধান অতিথি হওয়ার কথা, সভা উদ্বোধন করার কথা, তখন আমি ছেড়ে যাচ্ছি। স্বরচিত কবিতা থেকে পাঠ করার মতো করে কবি বলে চলেন, আমি এই নদী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনজনদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। বাংলার আকাশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি। অথচ কবি নিজেই লিখেছিলেন, ‘হাজার হাজার মাইল সুদীর্ঘ পথ সহজেই/পার হওয়া যাবে,/ কিন্তু তার আগে কীভাবে পার হবো এই/সবুজ ক্ষেতের আল-/ছোট্ট বাঁশের সাকো, পার হবো/ঝরে পড়া শিউলি-বকুল!’ তাহলে কী করে আজ পারছেন চলে যেতে? উত্তরে অদ্ভুত সুন্দর করে তিনি উচ্চারণ করেন, বাংলার আকাশ আমার বুক পকেটে। আমি ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি। তেরশত নদীর কলোধ্বনি আমি বুকের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি। কবি লিখেছিলেন- আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত/শুধু হাহাকার/ শুধু শূন্যতা, শূন্যতা। কবি লিখেছিলেন- এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি/ অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক! বিদায় বেলায় কবিতারা যেন ফিরে আসছিল! কেন এমন বেদনাবিদুর চলে যাওয়া? যে বাংলার নদী জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, কবির জন্ম যেখানে, সেই স্বর্গ সুখ কেন উপভোগ করবেন না? জানতে চাইলে চুপ হয়ে যান মহাদেব সাহা। কিছু বলতে গিয়েও কেমন যেন থামেন। ছোট্ট করে পরে যা বলেন, তা থেকে খুব চেনা জানা ট্র্যাজেডি বের হয়ে আসে। কবির বয়স অনেক। শরীর দুর্বল। বার্ধক্যজনিত রোগ লেগেই আছে। অনেক টাকার ওষুধ খেতে হয় প্রতিদিন। সংসারের খরচ অনেক। এ সবের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এই বয়সে অতো টাকা তিনি কোথায় পাবেন? বড় ছেলে তীর্থ সাহা কানাডায় থাকেন। সেখান তার নিজের সংসার। ওই সংসারের খরচ বহন করতে হয়। একইসঙ্গে টাকা পাঠাতে হয় ঢাকার সংসারে। তাই দিয়ে এতদিন চলেছেন কবি। খরচ কমাতেই দুই সংসারকে এবার এক করার সিদ্ধান্ত হয়। পারিবারিক সিদ্ধান্তে সস্ত্রীক কানাডায় যাচ্ছেন। বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসাও হবে সেখানে। কবি একে নিয়তি হিসেবে দেখছেন। এই চলে যাওয়াকে নিজের পরাজয় হিসেবে বর্ণনা করছেন। তার হুবহু বলাটি এরকম- আমি মাঠে নেই। মাঠ ছেড়ে দিয়েছি। রেসে নেই। প্রতিযোগিতায় নেই। ভাগ্য মেনে নিয়েছি আমি। এখন আমি প্রায় নিয়তিবাদী। বলতে পারেন, অনেকটাই পরাজিত। অবশ্য কথাগুলো কবি আগেই লিখে রেখেছিলেন। লেখাটি ছিল এরকম- এবার নদীর জলে ধুয়ে নেই এই পরাজিত মুখ, ধুয়ে নেই সকলের অপমান্ত উপেক্ষার কালি।/ একবার ভালোবেসে, মাতৃস্নেহে/আমূল বদলে দাও আমার জীবন...। প্রিয় কবিতা এমন বাস্তব হয়ে ওঠা বিরল যেমন, বেদনারও। দেশ ছাড়ার প্রাক্কালে বারবারই কবি তার পাঠকের কথা তুললেন। বললেন, আমার কত পাঠক কত অনুরাগী কত ভালবাসার মানুষ ভক্ত সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে। খুব কষ্ট হয়। কথা বলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ কবি ও কবিতাকে ভালবাসে। এমন ভালবাসা আর কোথাও আমি দেখি না। এ পর্যায়ে আবেগী কবি কালজয়ী সেই কবিতা থেকে বলেন, স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। এই দেশ ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তার শেষ মন্তব্য- যাওয়া তো নয় যাওয়া। উল্লেখ করার মতো তথ্য হচ্ছে, আজ ২০ শ্রাবণ বৃহস্পতিবার কবির জন্মদিন। ১৩৫১ সালের এই দিনে পাবনার ধানঘড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ফুলজোড় নদী নিশ্চয়ই আজ বলবে, শুভ জন্মদিন! নিশ্চয় বলবে, অপেক্ষা করে আছি। ফিরে এসো তুমি কবি, যখন তোমার ইচ্ছে!
×