ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার চার নদী পানিতে থৈ থৈ, তবে বন্যার শঙ্কা নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ আগস্ট ২০১৬

ঢাকার চার নদী পানিতে থৈ থৈ, তবে বন্যার শঙ্কা নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার চার নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও ঢাকার ভেতরে বন্যার কোন আশঙ্কা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ঢাকার পূর্ব দিকে বালু নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে ডেমরা এলাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তবে ঢাকার ভেতরে পানি প্রবেশের কোন আশঙ্কা নেই। অপরদিকে পশ্চিমাংশ বন্যা প্রতিরোধে অধিক সুরক্ষিত। এ কারণে পশ্চিমে তুরাগ নদীর পানি বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পশ্চিমাংশ দিয়েও ঢাকায় বন্যা হওয়ারও সম্ভাবনা এখনই নেই। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানান পাউবো কর্মকর্তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, দেশে বিভিন্ন নদীর সমতলের ৯০ পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ৫৭ পয়েন্টে পানি কমছে। বেড়েছে মাত্র ২৮ পয়েন্টে। ১৭ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে উত্তরের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে। বোর্ডে বন্যা পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকার চার নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে বালু নদী ডেমরায় বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে পশ্চিমে মিরপুরের কাছে তুরাগ নদীর পানি সমতলে ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার চার নদী সমতলের পানি বৃদ্ধি আরও আশঙ্কা রয়েছে। তবে এ কারণে ঢাকার ভেতরে বন্যার পানি ঢোকার কোন আশঙ্কা নেই। তিনি জানান, ঢাকার পশ্চিমে দিক সুরক্ষিত বন্যা প্রতিরোধে। অপরদিকে বালু নদীর ডেমরায় পানি বৃদ্ধি পেলেও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এ কারণে বালু নদীর পানি সমতলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ডেমরার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। কিন্তু ঢাকার ভেতরে পানি ঢোকার আশঙ্কা নেই। কারণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আগামীতেও অব্যাহতভাবে কমতে থাবে। এদিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। আবার উজানে গত কিছুদিন ধরে ভারি কোন বর্ষণ না থাকায় সেখান থেকেও অতিরিক্ত কোন পানি আসছে না। দেশের ভেতরেও বড় ধরনের বর্ষণ আপাতত নেই। আগামী ৬-৭ দিনের মধ্যে ভারি বৃষ্টিপাতের আশা নেই। এ কারণে পানি দ্রুত নেমে গিয়ে এ সময়ের মধ্যে উত্তরের বন্যা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে রিপন কর্মকার জানান, গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি এখন স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে অমাবস্যার কারণে সাগরে জোয়ার ভাটার ফলে পানি স্তর একটি উঁচু রয়েছে। এ কারণে পানি ধীরে ধীরে নামছে। অমাবস্যা কেটে গেলে এবং আগামী ১ সপ্তাহে যতদিন কোন বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে পদ্মার পানি দ্রুতই নেমে যাবে। সেক্ষেত্রে নতুন করে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কাও থাকবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০ পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ১৭ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি বয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর এলাকায় বন্যা পরিস্থিতিও স্থিতিশীল থাকতে পারে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণাধীন সমতলে ৯০ স্টেশনের মধ্যে পানি কমছে ৫৭ পয়েন্টে। বেড়েছে ২৮ পয়েন্টে। অপরিবর্তিত রয়েছে ১ পয়েন্টের পানি। আত্রাই, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা নদী ও পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দর কাছে সবচেয়ে বেশি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে উত্তরের পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা দুর্গত এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে উপদ্রুত এলাকায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, শ্বাসনালীর প্রদাহসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বানভাসিরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেল্থ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বানের পানিতে ডুবে নয় দিনে শিশুসহ ৫৫ জন ও সাপে কাটায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। উপদ্রুপ এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার মানুষ। তবে উপদ্রুত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে চিকিৎসাকর্মীদের ৭শ’ দল কাজ করছে বলে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর জানিয়েছে ১৬ জেলার ৭২ উপজেলার ৩৭৮ ইউনিয়নের ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৪ পরিবার এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ১১২ পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি জিআর চাল, জিআর ক্যাশ, প্যাকেটজাত শুকনো খাবার, গুড়সহ পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের Ñ জামালপুর ॥ যমুনা নদীর পানি ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ায় জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে পানিবাহিত রোগ দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত কেউ ডায়েরীয়ায় আক্রান্ত হয়নি। বন্যার রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে মেডিক্যাল টিমের পাশাপাশি ইসলামপুরের গুঠাইল অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তবে বন্যার পানি কমতে শুরু করলে ৭টি উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগ জানায়, বন্যায় জেলায় ২০ হাজার ১শ’ ৫০ হেক্টর বিভিন্ন ফসলী জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভোলা ॥ সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে মেঘনা নদীর ভাঙ্গন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙ্গে গত ২ দিন ধরে মেঘনা নদীর অতি জোয়ারের পানিতে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে করে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে ঘরবাড়ি, তলিয়ে গেছে পুকুর ও মাছের ঘেরসহ শত শত এক ফসলী জমি। উত্তর অঞ্চলের বন্যার পানি কমার সঙ্গে নদী ও সাগর মোহনার এ দ্বীপ জেলায় নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। সড়ক বাঁধ ভেঙ্গেও জোয়ারের পানি হু হু করে গ্রামের পর গ্রাম ৩-৪ ফুট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। গাইবান্ধা ॥ সকল নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও বন্যাকবলিত ৪টি উপজেলার বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। এদিকে ফুলছড়ি উপজেলার সকল সড়ক বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় এবং বাঁধ ও ৬টি ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ওই উপজেলা সদর, সকল ইউনিয়ন ও জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকাই সেখানে চলাচলের একমাত্র বাহন। বন্যা দুর্গত এলাকায় ৩ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমির রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত অবস্থায় থাকায় সেগুলো এখন বিনষ্ট হওয়ার পথে। এছাড়া ১শ’ ৮৯ কি.মি. কাঁচা রাস্তা, ২৯ কি.মি. পাকা রাস্তা, ৪শ’ মিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসে গেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে বিশুদ্ধ পানির জন্য ২১টি নলকূপ ও ৬৪টি ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় চর্ম রোগ দেখা দিয়েছে। ৬৫টি মেডিক্যাল টিম বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করছে। টাঙ্গাইল ॥ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জেলায় সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় ত্রাণ সামগ্রী না পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কোন মেডিক্যাল টিমও বন্যা দুর্গত এলাকায় যায়নি চিকিৎসা সেবা দিতে। ঘরবাড়ি হারিয়ে হাজার হাজার বানভাসি মানুষ এখন বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে পড়েছে। এদিকে ধনবাড়ীতে ঝিনাই ও বৈরান নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মুশুদ্দি ইউনিয়নের কসাইবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ৯ জায়গায় ভেঙ্গে মুশুদ্দি, পাইস্কা, বলিভদ্র, ধোপাখালি ও হাদিরা ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কসাইবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১২শ’ মিটার বাঁধ ভেঙে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে অন্তত ৫০টি গ্রাম। বগুড়া ॥ বন্যার কারণে তিন উপজেলার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া বাকি নয় উপজেলায় সময়মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার থেকে সকল সরকারী প্রাথমিক স্কুলে একযোগে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসেন আলী জানিয়েছেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পরীক্ষা গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গেই দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হবে। পরীক্ষা স্থগিত হওয়া সরকারী প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৪শ’ ৯২টি। মুন্সীগঞ্জ ॥ বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। এলাকায় পদ্মার পানি কমতে শুরু করেছে। নতুন করে আর কোন এলাকা প্লাবিত হয়নি। তবে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। নিম্নাঞ্চলের পানিবন্দী পরিবারগুলোর কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বিশুদ্ধ খাবার পানিসহ নানা সমস্যায় পড়েছে তারা। মানিকগঞ্জ ॥ পদ্মা যমুনার তীরবর্তী এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। আরিচা পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ২০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জেলার অভ্যন্তরীণ নদী ও খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানিকগঞ্জ পৌরসভার কয়েকটি এলাকাসহ জেলার ভেতরে নতুন কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাবনা ॥ চাটমোহর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এ উপজেলার স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
×