ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুকের আগুন নিয়ে তরুণের এখন বসে থাকার সময় নয় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৪ আগস্ট ২০১৬

বুকের আগুন নিয়ে তরুণের এখন বসে থাকার সময় নয় -স্বদেশ রায়

তারুণ্য বিপথে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? এ মুহূর্তে কারও কাছে এর কোন সঠিক উত্তর নেই। কারণ, বিপথগামী কোন তরুণের সঙ্গে আমাদের মনোবিজ্ঞানী বা বিদেশী কোন প্রথিতযশা মনোবিজ্ঞানী কথা বলেননি; কথা বলেননি আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা। যা কিছু কথা হচ্ছে তাদের সঙ্গে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের সঙ্গে। তারা তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করছেন, তাদের উপায়ে। তাদের মনোজগতের খোঁজ নেয়া বা উপলব্ধি করা তাদের কাজ নয়। তাদের আশু কাজ এদের হাত থেকে দেশকে পরিত্রাণ দেয়া। তাদের কাজ নয় একটি সমাজের মনোজগত গড়ে দেয়া। এটা সমাজের দায়িত্ব, এখন সমাজ যেহেতু ক্রমেই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের দাপটের নিচে চাপা পড়ছে, তাই এ দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলকে, সঙ্গে ক্ষীণকায় হলেও সামাজিক শক্তি থাকবে। কারণ, কোন মানব সভ্যতায় সামাজিক শক্তি আকারে যত ছোট হোক না কেন, তার শক্তি অসীম, যেহেতু তার শিকড় অনেক গভীরে, হাজার হাজার বছর ধরে সে মাটি থেকে রস জমা করেছে তার শিকড়ে। তাই ক্ষীণকায় হলেও সামাজিক শক্তিকেও এ কাজ করতে হবে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলে মনে হয় যে কোন যুদ্ধ, সংগ্রাম বা সমাজের কোন ক্ষত দূর করতে সুবিধা হয়। আমাদের সামাজিক শক্তি, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল দীর্ঘ সময় ধরে বড় ভুল করেছে : তারা প্রগতিশীল তরুণ সমাজ গড়তে দেয়নি। এমনকি যে প্রগতিশীল তরুণ সমাজ গড়ে উঠেছিল তাদের পরিণত বয়সে আমরা সঠিক কাজে লাগাতে পারিনি। বরং তাদেরও চরিত্র নষ্ট করা হয়েছে। আজ স্বীকার করতে হবে, ষাটের দশকে জেগে ওঠা আধুনিক তরুণ সম্প্রদায় যেখানে সমাজের আদর্শ হিসেবে, ভবিষ্যতের আদর্শ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে স্বাধীনতার পরে তা তারা করেনি। বরং তাদের একটি অংশ ওই অতি অল্প বয়সে সমাজের মোড়ল হওয়ার চেষ্টা করে। আর একটি অংশ সিরাজুল আলম খানের ভুল পথ নির্দেশনায় বিপথগামী ও সশস্ত্র হয়ে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এদের সঙ্গে যোগ দেয় স্বাধীনতাবিরোধী সিরাজ সিকদারের তথাকথিত সমাজ পরিবর্তনের নামে কিছু তরুণ। বাস্তবে একদিকে মোড়ল হয়ে আরেকদিকে সশস্ত্র ডাকাত হয়ে ষাটের দশকে জেগে ওঠা তরুণ সম্প্রদায়ের সিংহভাগ শেষ হয়ে যায়। তাদের ভেতর আর জাগ্রত তারুণ্যের কোন কিছুই থাকে না। এরপরে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে দেশে পাকিস্তানী সামরিক শাসনের আদলে সামরিক শাসন আসে। যার ভেতর একমাত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া আর কোথাও জাগ্রত তরুণ সমাজ গড়ে তোলার কোন পথ ছিল না। যা হোক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির মিলনে ওই সময়ে একটি জাগ্রত ছাত্র শক্তি গড়ে ওঠে : যা ছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রলীগ ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্র ইউনিয়ন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ওই জাগ্রত ছাত্রশক্তিকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো আবদুর রাজ্জাক বুড়িগঙ্গার পানিতে বিসর্জন দেন। অন্যদিকে সোভিয়েত পতনের পর পরই আমাদের প্রকৃত বাম শক্তিটি এমনই এতিম হয়ে পড়ে যা ছিল অবিশ্বাস্য। তাদের নেতারা গিয়ে গাঁটছড়া বাঁধে, এতদিন তারা যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে সেøাগান দিয়েছেন সেই মতাদর্শী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। যার রাজনীতি সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল লিখেছেন, তার ফ্লাইট হলো ঢাকা-ইসলামাবাদ-ওয়াশিংটন। যাহোক, আর এর ভেতর দিয়ে বিশাল বটবৃক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন বনসাই হয়ে যায়। এর পরে বাংলাদেশে প্রগতিশীল তারুণ্যর একটিই ঝলক আসে, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। কেন এই অভাগা দেশে হঠাৎ করে অমন আলোর ঝলকানি এসেছিল? এই আলোর ঝলকানির মূলে কিন্তু শেখ হাসিনার নির্বাচনী মেনিফেস্টো। তিনি জাগ্রত তারুণ্যের ডাক দিয়ে, নতুন প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান করায় তরুণরা তাকে ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী করে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসায়। তিনি তরুণদের প্রথম দাবি যুদ্ধাপরাধীর বিচার শত প্রতিকূলতার মাঝে শুরু করেন। কিন্তু প্রতিকূলতা যখন চারদিক থেকে শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরে তখনই তরুণ সমাজ জেগে ওঠে, তারা মনে করে এখন আলো হাতে, মশাল হাতে বাইরে আসা প্রয়োজন। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে জেগে ওঠে গোটা বাংলাদেশের তারুণ্য। এই তারুণ্যকে ধ্বংস করার জন্য বেগম জিয়া দেশের সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন, এরা নষ্ট তরুণ। আর এর সঙ্গে নামে আমাদের মিডিয়ার প্রায় নব্বই শতাংশ। মাহমুদুর রহমান নামক এক দুর্বৃত্ত ও প্রতিক্রিয়াশীলদের ‘শকুনী’; তার সমর্থনেও নেমে আসে দেশের শীর্ষ পনেরো সম্পাদক। শেখ হাসিনা ওই ধাক্কা কুলাতে পারেননি। তাকে যেমন বেগম জিয়ার প্রতিক্রিয়াশীলদের একটি অংশ হেফাজতে ইসলামীকে কৌশলে একটা সীমারেখার মধ্যে নিয়ে আসতে হয় তেমনি একই কায়দায় ওই পনেরো সম্পাদকের একজনকে একুশে পদক দিয়ে হেফাজত নেতা মাওলনা শফির মতোই একই শেকলে বাঁধতে হয়। অর্থাৎ একটি নষ্ট অংশকে শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে হয় তাঁর যুদ্ধের কৌশল হিসেবে। এদিকে গণজাগরণ মঞ্চ ছিল তারুণ্যের বুকের বজ্রানলে জ্বলানো একটি আলোকরেখা। তারা এই আলোকরেখার মুখপাত্র করেছিল ইমরান এইচ সরকারকে। ইমরান তরুণÑ সে আলোররেখা যখন আগুনের রং ধারণ করে তখন বুঝতে ভুল করে। অতি উৎসাহী কিছু বাম তরুণের খপ্পরে পড়ে সে আলোকরেখাকে কিছুটা সংগঠনের আদল দিতে গিয়ে সে মূল আলোররেখা হারিয়ে ফেলে। পাশাপাশি কোন এক অদৃশ্য ইন্ধনে কিছু ব্যর্থ প্রৌঢ় তারুণ্যের নামে এর ভেতর বিভেদ নিয়ে আসে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তারুণ্যে জয়রেখা দেয়ার কথা বললেও, তার সরকারে একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ কিন্তু বুঝতে পারেননি, তারুণ্যে কীভাবে তারা জয়রেখা এঁকে দেবে। তাই আবারও ভুল হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে যেমন তারুণ্যকে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছিল- রাষ্ট্র, সমাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায়ন করা হয়নি এবারও একই ঘটনা ঘটে। এমনকি উপলব্ধি করা হয় না, প্রযুক্তির কারণে তারুণ্যের প্রজন্মের সীমারেখা যে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। দ্রুতই যে একটি তরুণ আরেক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়টি রাষ্ট্র একেবারেই উপলব্ধি করেনি। পাশাপাশি হেফাজতকে শেকলে বাঁধা, পনেরো সম্পাদকের একজনকে একুশে দেয়া এগুলো আপাত কৌশলের থেকে তরুণদের কাছে আপোস বলেই মনে হয়। তার ফলে যে জাগ্রত তরুণ রাস্তায় নেমে এসেছিল, পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পরের যে তরুণ আজ যারা সিনিয়র সিটিজেনের পথে পা বাড়াচ্ছে অথচ যুবক তাদের ভেতরও এক ধরনের হতাশা এসে যায়। জাগ্রত তরুণ যখন হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে তখনই কিন্তু আলোর সময় কমে গেছে, আঁধারের সময় বেড়েছে। আর সেই আঁধারে, আঁধারের জীবরা নেমে পড়েছে হায়েনার হাসি নিয়ে শুধু নয়, ধূর্তামি নিয়েও। যার ফলে তারা সহজে বিপথগামী করতে পারছে একশ্রেণীর তরুণকে। কারণ এখানে আঁধারের বিপরীতে আঁধার, আলোর অংশ খুবই কম। অথচ সভ্যতার সত্য হলো আলো দিয়ে আঁধার কাটাতে হবে, অন্ধকার দিয়ে অন্ধকারকে দূর করা যায় না। যা হোক, তার পরেও এই ঘোর অন্ধকারে এটুকু আশা, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, সামাজিক শক্তি, পারিবারিক শক্তি ও রাষ্ট্রশক্তি এখন এককাতারে এসেছে সমাজে আলো ছড়াতে। কিন্তু ইতোমধ্যে সমাজের যে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ হয়ে গেছে সেখানে সামাজিক শক্তির যে অংশ এসেছে এদের বৃদ্ধি হবে কোন্ পথে? এরা যদি শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতাকে খুশি করার জন্য রাস্তায় নামে তাহলে সেখানে খুব আশার আলো নেই। তাছাড়া কোটি কোটি পরিবারে আলো জ্বালাবার মতো দীপ কই? রাজপথে যখন মানববন্ধন হচ্ছে তখন বাউলের একতারা আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে। এই ছাইভস্ম থেকে সুর জাগানো অনেক অনেক কঠিন কাজ। তারপরে প্রগতির চাকাটি এমনই, তাকে সব সময়ই চড়াই উতরাই পার হতে হয়। সকলের চেনা পথে, সহজ পথে কখনই এগোনো যায় না। ছেনি দিয়ে হিমালয়ের বরফ কেটে কেটে পথ করে তবেই তো এগোতে হয়। তবে এত কিছুর পরেও এখনও তরুণের ওপর, নিজের ওপর ভরসা রাখার সময়। পণ করার সময়। এখন হতাশ হওয়ার সময় নয়। এখন ভরসা রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে, যদি পণ করেই থাকি- ও পণ রবেই রবে। আর তাই এখন পণ করার সময়। এখন কঠিন প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে কিছু তরুণকে, বয়স যাই হোক, কিছু তরুণ প্রাণকে চারণের বেশে দেশের পথে পথে বের হওয়া উচিত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই মেবার পতনের চারণে গানের অনুকরণে এখন সুর তুলতে হবে, এনেছিস অন্ধকার, দুঃখ নেই- আবার তোরা মানুষ হ। কারণ এ মুহূর্তে সমাজে যে ক্ষত দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষত সারাতেই হবে। এখানে ভয় পেলে চলবে না, আশা হারালে চলবে না। কারণ আমার সন্তান, আমার ভাই আমার মৃত্যুদূত হতে পারে না। যে সমাজে সন্তান, ভাই ও বোন মৃত্যুদূত হয়- সে সমাজকে পরিবর্তন করতেই হবে। এ পরিবর্তনের জন্য, সামাজিক শক্তিকে বুঝতে হবে, তারা সকলে কি সঠিক দায়িত্ব গত কয়েক দশক ধরে এমনকি এখনও পালন করছেন? তারা এখন টেলিভিশনের পর্দায় গিয়ে অনেকে যা বলছেন, তা কি সমাজ ও রাষ্ট্রকে অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে না। তারাও যে পক্ষান্তরে এক ধরনের মৃত্যুদূত তা কি তারা বোঝেন? নষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে এই সত্য তাদের বুঝতে হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, আর তারুণ্যকে অবহেলা নয়, বরং তারুণ্যকে রাষ্ট্র, সমাজসহ সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করতে হবে। এ জন্য যদি একটি বা দুটি জেনারেশনকে পেছনের সারিতে গিয়ে বসতে হয় সে সারি হবে সম্মানের, অগৌরবের নয়। আর যে তরুণদের বুকের ভেতর আগুন আছে তাকে আপন বুকের বজ্রানলে এখনই জ্বলে ওঠার সময়। রাষ্ট্র কী করছে, সমাজ কী করছে- এ চিন্তা নিয়ে তরুণের বসে থাকা নয়। তরুণের কাজ আগে চলা, মশাল হাতে আগে এসে দাঁড়ানো। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো কেন এখনও ঢাকায় বসে, কেন তারা বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে নয়। এই ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের হাজার দোষ থাকলেও তাদের তারুণ্য তো আছে! আর সাধারণ তারুণ্যকে উপলব্ধি করতে হবে এখন যা ঘটছে বাংলাদেশে তা কোন রাজনীতি নয়, এ এক মহামারী, এক গভীরতর অসুখ। একে সারাতে পারে একমাত্র সাহসী তরুণের বুকের আগুন। তাদের বুকের আগুনে পুড়ে আবার জেগে উঠুক পদ্মা, মেঘনার জলে ধোয়া, বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওইয়া, মুর্শিদীর এই বাংলা। জেগে উঠুক সহজিয়া বাংলা। [email protected]
×