রুমেল খান, চট্টগ্রাম থেকে ॥ সুস্থ দেহ সবল মন খেলাধুলার প্রয়োজন। যদি কেউ সুস্থ দেহ ও সবল মন চায় তাহলে খেলাধুলার কোন বিকল্প নেই। খেলাধুলাই একমাত্র সঠিক ব্যক্তিত্ব বিকাশ, ভাল আচরণ গঠন ও সুস্থ শরীর গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। একটি শিশু বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিনোদন খোঁজে। তাদের সবচেয়ে বড় বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হলো খেলাধুলা। এর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিচ্ছন্ন বিনোদন ও খেলাধুলায় যে শিশু বেড়ে ওঠে, তার পক্ষে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব। আবার অপরিচ্ছন্ন বা কুয়াশাচ্ছন্ন বিনোদনে বেড়ে ওঠা শিশুর জীবন ধ্বংস হতে বাধ্য।
গত ২৪ জুলাই থেকে এখানে শুরু হয়েছে ‘জেবি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ’ ফুটবল আসর। প্রতিটি খেলা শুরুর আগে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়রা ঢোকেন, তখন তাদের সঙ্গে থাকেন ২২ শিশুও। তারকা ফুটবলারদের খুব কাছ থেকে দেখে ফুটবলের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করা এবং ফুটবল খেলতে অনুপ্রাণিত করার জন্যই তাদের মাঠে আনা হয়। ফিফাই এই নিয়ম করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার প্রথম ম্যাচের আগে (মোহামেডান বনাম ফেনী সকার) কথা হয় এ রকমই কিছু ফুটফুটে, টগবগে কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে। স্টেডিয়ামের বাইরের গেটে ‘কিচিরমিচির’ করছিল তারা! তাদের সঙ্গে এসেছে বেশকিছু অভিভাবক। জানা গেল, রেফারি, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা, চট্টগ্রাম জেলা ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন কর্মকর্তা এবং তাদের পরিচিত অন্য কিছু পরিবার থেকে আনা হয়েছে এই শিশুদের।
কথা হয় এক অভিভাবকের সঙ্গে। নাম নুরুল আফসার। তিনি জানান, এই বাচ্চাদের মধ্যে তার ভাইপো এবং নিজের মেয়েও আছে। বলেন, ‘এখানকার ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন এনাম ভাই, তিনিই এই শিশুদের এই লীগের জন্য সংগ্রহ করেছেন।’
আফসার এক সময় শৌখিন ফুটবলার ছিলেন। এখানকার বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে (আগ্রাবাদ নওজোয়ান, জাগ্রতি ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব প্রভৃতি) সত্তরের দশকের শেষদিকে ফুটবল খেলতেন উইঙ্গার হিসেবে। পরে ১৯৭৯ সালে উন্নত জীবনের অন্বেষণে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। ১৬ বছর পর আবার ফিরে আসেন দেশে। প্রবাস জীবনেও ওখানে বিদেশীদের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলতেন। ফুটবলটা তার রক্তে মিশে আছে এখনও। বর্তমানে চেষ্টা করছেন বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করার।
নিজের ছেলেকেও তিনি বানাতে চান ফুটবলার। ছেলে মাহের উদ্দিন পড়ে ক্লাস থ্রিতে। তার প্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। এখানকার কোন খেলোয়াড় প্রিয় না? ‘আমি তো এখানকার কাউকে ভাল মতো চিনি না। শুধু একজনকে চিনি, চট্টগ্রাম আবাহনীতে খেলে, বিদেশী। কিন্তু তার নামটা ভুলে গেছি।’ সরল স্বীকারোক্তি মাহেরের। লাজুক কণ্ঠে মাহের আরও জানালো, তার ফুটবল খেলতে অনেক ভাল লাগে। খেলে স্ট্রাইকার হিসেবে। অনেক গোলও নাকি পায় খেলতে গেলে। ভবিষ্যতে নামকরা খেলোয়াড় হতে চায় সে।
সরকার এবং পৃষ্ঠপোষকরা যেভাবে ফুটবলের উন্নতির জন্য এগিয়ে আসছে, এটা মুগ্ধ করেছে আফসারকে, ‘এখানে এখন দারুণ লীগ খেলা হচ্ছে। দর্শক আসছে। অথচ অনেক আগে ফুটবল ছিল দেশের এক নম্বর খেলা। তখন এলাকাভিত্তিক খেলাগুলো দেখতেও প্রচুর দর্শক আসত। আমি নিজেই তো সে সময় খেলতে গিয়ে এসব দেখেছি। আগে মানুষ খেলা দেখত, খেলোয়াড়দের যেভাবে আয় ছিল না। এখন খেলোয়াড়দের আয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু খেলা দেখতে মানুষ আসছে না!
তবে এখন অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করেন আফসার। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক প্রতিভাবান শিশু-কিশোর ফুটবলার আছে, যাদের ঠিকমতো তালিম দিতে পারলে দেশের ফুটবলের সঙ্কট কেটে যাবে। এজন্য সবার আগে সচেতন হতে হবে অভিভাবদের। ‘আমি যখন ফুটবল খেলতাম, তখন আমার অভিভাবকরা রাগ করতেন। ফলে লুকিয়ে ফুটবল খেলতে হতো। অথচ এখন আমি বা আমরাই ছেলেমেয়েদের ফুটবল খেলতে বলি।’
শিশুরা এখন খেলে, তবে সেটা মাঠে নয়, মোবাইলে। এটা ঠিক নয় বলে অভিমত আফসারের, ‘মাঠে গিয়ে খেললে শরীর-মন দুটোই ভাল থাকবে। কোন অপরাধ বা নেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না। ‘আমার মতে বাচ্চাদের খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া উচিত দেশের প্রতিটি এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। এগিয়ে আসা উচিত সমাজের বিত্তবানদেরও।’
অর্থের অভাবে এখানকার অনেক ক্লাবই বন্ধ বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলো আবার চালু করা দরকার বলে জানান আফসার। ‘এলাকার সবাই মিলে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া উচিত।’
এই উদ্যোগ সফল হলে মাহেরের মতো অসংখ্য ফুটবলার তৈরি হবে, যারা হতে পারে আগামীর ভবিষ্যত ফুটবলার।