ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কল্যাণপুরের জঙ্গীদের ল্যাপটপে পাওয়া গেছে ১৫ জঙ্গীর নাম

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩ আগস্ট ২০১৬

কল্যাণপুরের জঙ্গীদের ল্যাপটপে পাওয়া গেছে ১৫ জঙ্গীর নাম

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার করা ল্যাপটপে পাওয়া গেছে ১৫ জঙ্গীর নাম। জঙ্গী আস্তানা থেকে অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযানের সময়ে পালিয়ে যাওয়া ৬ জঙ্গীকে খুঁজছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দারা। এ বিষয়ে মিরপুর থানায় দায়ের করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিও পালিয়ে যাওয়া ৬ জঙ্গী। এসব জঙ্গীর হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড। জিজ্ঞাসাবাদেও এই ধরনের তথ্য দিয়েছে অভিযানকালে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে আহত অবস্থায় আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যান। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযান শেষে মিরপুর থানায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রিপন। এই রিপন নিহত জঙ্গীদের কথিত বড় ভাই। এই রিপন জেএমবির নতুন টিমের একজন অপারেশনাল কমান্ডার। তার সম্ভাব্য বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। রিপন ওই অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন হামলায় সরাসরি জড়িত ছিল। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ১১টি হামলার মধ্যে অধিকাংশ ঘটনায় সে কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছে। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির এই রিপন আত্মঘাতী দলের (সুইসাইড স্কোয়াড) সদস্য। মিরপুর থানায় দায়ের করা এজাহারভুক্ত আরেক আসামি মানিক। সে সারাদেশের কো-অর্ডিনেটর ও অপারেশনাল কমান্ডার। সে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকত। বাদল নামের একজনও অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। তার বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুরে। সে বগুড়ায় বিভিন্ন হামলায় জড়িত। আরও রয়েছে গাইবান্ধার আজাদুল কবিরাজ। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরই উঠে আসে তার নাম। জেএমবির উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন এই কবিরাজ। উত্তরাঞ্চলে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে রিপন ও আজাদুল। আর নতুন জঙ্গীদের রিক্রুট করে রাজীব ও সাকিব। জঙ্গী খালেদকে কেউ কেউ মামা খালেক বলে ডাকে। সে দিনাজপুরে ছিল। কিন্তু প্রকৃত বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। খালেদের এক প্রধান শিষ্যের নাম আরিফুল। তার বাড়িও দিনাজপুরে। এ খালেদও আঞ্চলিক অপারেশনাল কমান্ডার। খালেদের জঙ্গী দলে বিজয় নামে আরও এক যুবকের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী বিজয়। জেএমবির জঙ্গী দলের আত্মঘাতী দলে (সুইসাইড স্কোয়াড) জঙ্গী সদস্যদের এসব নাম ছদ্মনাম। গায়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা ছয় জঙ্গীর মধ্যে আরেক জনের একজনের বাসা ধানম-ি। সে তার বাড়ির পাশেই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখানে বিদেশী অতিথিদের যাতায়াত ছিল। হামলার বিষয়ে কল্যাণপুরের ওই আস্তানায় তারা বৈঠক করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে জঙ্গীদের হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যায় বলে তাদের দাবি। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে অভিযানে নিহত জঙ্গী নিবরাসের নিখোঁজের বিষয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ধানম-ি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। ওই ডায়েরিতে নিখোঁজের কথা উল্লেখ আছে তাওসিফের নামও। সে মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাওসিফকে পলাতক হিসেবে দেখনো হয়। রিয়াজ ওরফে কাচ্চি, সালভি আলী ওরফে মালাভী, ইয়াসিন তালুকদার ও গালিব নামে আরও কয়েকজন জঙ্গীকে ধরতেও অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দারা। এদের সঙ্গে কল্যাণপুরের জঙ্গীদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তামিমের সহযোগী তাওসিফ একটি সেলের প্রধান। এই তাওসিফও ঝিনাইদহের আস্তানায় গুলশানে নিহত নিবরাস ও শোলাকিয়ায় নিহত আবীরের সঙ্গে ছিল। মামলার এজাহারে নাম আসা অন্য জঙ্গীদের মধ্যে ইকবাল, মামুন, জোনায়েদ খানসহ অজ্ঞাতনামা যারা রয়েছে। তাদের আটকের চেষ্টা চলছে। এরা বিভিন্ন স্থানে হামলার সঙ্গে জড়িত। তারাও বিভিন্ন কিলিং মিশন সেলের প্রধান হিসেবে কাজ করে। এদের অনেকেই ভারি অস্ত্র চালাতে পারে। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া জঙ্গী হামলার সময়ে আহত অবস্থায় আটক জঙ্গী শফিউলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। কল্যাণপুরের ঘটনায় এজাহারে আসামির তালিকায় যাদের নাম আছে এদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী অন্যতম। তামিম চৌধুরীর সঙ্গে অপর পলাতক মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য চল্লিশ লাখ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এই দুই জনের নাম বলেছে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে আহত অবস্থায় আটক হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিবুল হাসান রিগ্যান। রিগ্যানই জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে কল্যাণপুরের ঘটনায় জেএমবির নতুন অপারেশনাল কমান্ডার ও কো-অর্ডিনেটরদের নাম। পলাতক অপারেশনাল কমান্ডাররা হচ্ছে কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গীদের কথিত বড়ভাই হিসেবে পরিচিত। তারাই সিরিয়াল কিলিং মিশনে নেপথ্যের চিহ্নিত নায়ক। কল্যাণপুরে অভিযানের পর করা মামলায় এদের ১০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বিষয়েও খোঁজ করছে গোয়েন্দারা। এই রিগ্যানই বলেছে, পলাতক ৬ অপারেশনাল কমান্ডারদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানান, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পাওয়া গেছে একটি ভাঙা ল্যাপটপ। জঙ্গীদের ব্যবহৃত এ ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ছক। এতে পাওয়া গেছে ১৫ জনের নামের তালিকাও। পাওয়া গেছে পোশাক ছাড়াও নিহত জঙ্গীদের অডিও রেকড। ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে রেকর্ড উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। জঙ্গীরা তাদের অডিও বার্তায় বাবা-মাকে ভুল পথ ছেড়ে জিহাদের পথে আসারও আহ্বান জানায়। রেকর্ডের কপি দেশের বাইরেও পাঠানো হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। নিহত হওয়ার আগে তারা বার্তাগুলো রেকর্ড করে। নির্দিষ্ট স্থানে এগুলো পাঠানোর পর মুছে ফেলে। কিন্তু শুক্রবার রিকভার ডাটা দিয়ে বার্তাগুলো উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত পাওয়া গেছে জঙ্গীদের একটি তালিকা। কল্যাণপুরে নিহত জেএমবি সদস্যদের একাধিক বড় ভাই বিভিন্ন এলাকার অপারেশনাল কমান্ডার ছিল। তামিম চৌধুরী তাদের সবাইকে বড় ধরনের জঙ্গী হামলার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে শহিদী পথে পরকালে বেহশত লাভের মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গীদের খুনী চক্রে সক্রিয় করা হয়েছে। কিন্ত এই জঙ্গী চক্রের নেপথ্যের পরিকল্পনাকারীদের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকার বিরোধী শক্তিকে দুর্বল করে দেয়ার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো। কথিত জিহাদের নামে হামলায় জঙ্গীদের নামানো হলেও তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যানপুরের জঙ্গীরা একই গ্রুপের এবং গোয়েন্দা জালে ধরা পড়বে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীরা। জঙ্গীদের আস্তানাগুলোর খোঁজ করে বের করার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
×