ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর জিয়া ও তামিমকে ধরিয়ে দিতে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩ আগস্ট ২০১৬

মেজর জিয়া ও তামিমকে ধরিয়ে দিতে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গীদের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে শনাক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টাকারী বরখাস্তকৃত মেজর জিয়াউল হক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। এ দু’জনকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। পুরস্কার ঘোষিত মেজর জিয়া নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাস্টারমাইন্ড। আর তামিম চৌধুরী জেএমবির নতুন একটি গ্রুপের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে। দুই মাস্টারমাইন্ড দেশে থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। কারণ, তামিম চৌধুরী গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার মাত্র দুদিন আগেও বাংলাদেশে ছিল। হামলাকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক এবং আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করেছে তামিম চৌধুরী। দুই মাস্টারমাইন্ড গোয়েন্দা জালে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করে কিছুই জানানো হয়নি। কোন জঙ্গী যদি স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে চায়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে তাকে এবং তার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। মঙ্গলবার জনাব এ কে এম শহীদুল হক পুলিশ সদর দফতরে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এমন ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টাকালে পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের বন্দুকযুদ্ধ হয়। জঙ্গীদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। সেখান থেকেও গ্রেফতার হয় জঙ্গী। সর্বশেষ কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে নয় জঙ্গীর মৃত্যু হয়। গ্রেফতার হয় এক জঙ্গী। ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। বিশেষ করে গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, গুলশান ও শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলার মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। সে জেএমবির নতুন একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে। জেএমবির সেই নতুন গ্রুপটিই গুলশান হামলার ঘটনাটি ঘটায়। তামিম চৌধুরীর সঙ্গে হামলাকারীদের একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। সে হামলাকারীদের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করেছে। গুলশানের ঘটনার মাত্র দুদিন আগেও তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে ছিল। তামিম চৌধুরী পলাতক। সে এখনও বাংলাদেশেই থাকতে পারে। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। তথ্য দাতার সবকিছুই গোপন রাখা হবে। পুলিশ প্রধান বলেন, সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা এবং আগের ঘটনার তদন্তে তামিম চৌধুরী ছাড়াও যারা জেএমবির নতুন গ্রুপের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের প্রধান তাদের সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় ঘরছাড়া তরুণদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজ ১০ জনের যে প্রথম তালিকা দিয়েছিল, তাতে সিলেটের তামিম আহমেদ চৌধুরীর নাম আসে। তামিম জেএমবির নেতা। আইএসের বিভিন্ন প্রকাশনার ওপর ভিত্তি করে তাকে সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়ক বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সিলেটের বাসিন্দা কানাডার উইন্ডসরের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী তামিম চৌধুরী ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ। সে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দোবাক ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি। মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তিনি সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমান। এছাড়া গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে নিহত হয় ৯ জঙ্গী। রাকিবুল হাসান রিগ্যান নামে একজন আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়। আর পালিয়ে যায় ইকবাল নামের এক জঙ্গী। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হাসানের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে মিরপুর মডেল থানায় কল্যাণপুরের ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের হয়। সেই মামলায় আসামিদের মধ্যে আহত রিগ্যান ছাড়াও পালিয়ে যাওয়া ইকবাল, তামিম আহমেদ চৌধুরীও আসামি। অন্য আসামিরা হচ্ছে রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জোনায়েদ খান, বাদল ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ। সূত্র বলছে, রাজধানীর গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ডদের মধ্যে তামিম চৌধুরী নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিমের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক হয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি গিয়াস উদ্দিন আহমেদের বাসায় এবং কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায়। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের দিনে জঙ্গী হামলার ছক বাস্তবায়নের পরই কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলে জেএমবির এই জঙ্গী গোষ্ঠী। কে এই তামিম চৌধুরী ॥ তামিম আহমেদ চৌধুরীর পিতার নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী। মায়ের নাম খালেদা শফি চৌধুরী। বাড়ি সিলেট জেলার বিয়ানিবাজার থানাধীন দোবাক ইউনিয়নের বড়গ্রাম সাদিমাপুর গ্রামে। পাসপোর্ট নম্বর-এএফ-২৮৩৭০৭৬। পুরাতন পাসপোর্ট নম্বর-এএল-০৬৩৩৪৭৮। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর-১৯৮৬০০৯১২৪১০০১৩৪২। জন্ম তারিখ ২৫ জুলাই ১৯৮৬ইং। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর সর্বশেষ দুবাই থেকে ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সে বাংলাদেশে আসে। পুলিশ প্রধান বলেন, কয়েক বছর ধরে দেশে গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর আনসার আল ইসলামের নামে বিভিন্ন হত্যার দায় স্বীকার করেছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া কাজ করছে বলে তাদের ধারণা। এই জঙ্গী সংগঠনটি দেশে একের পর এক গুপ্তহত্যা চালিয়েছে। তাদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও প্রগতিশীলসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। আইএসের নামে হত্যার দায় স্বীকার করে সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বিবৃতি প্রকাশিত হতে থাকে। মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন পুলিশ প্রধান। কে এই মেজর জিয়া ॥ পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। পিতার নাম সৈয়দ মোঃ জিল্লুল হক। বাড়ি মৌলভীবাজার সদর জেলার মোস্তফাপুর গ্রামে। পাসপোর্ট নম্বর-এক্স ০৬১৪৯২৩। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার উৎখাতে ধর্মান্ধ কয়েক সেনা কর্মকর্তার একটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা নস্যাত করার খবর প্রকাশ করে। তখনই প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নাম ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এ দু’জন সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়। জিয়াকে ধরতে সে সময় পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় জিয়ার শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। রাজধানীর কয়েকটি স্থানেও জিয়ার খোঁজে চলে অভিযান। মেজর জিয়ার শাশুড়ি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হামিদা বেগম সেই সময় গণমাধ্যমকে জানান, জিয়া পটুয়াখালীর বাসায় কখনও আসেনি। পুলিশ প্রধান আরও বলেছেন, কোন জঙ্গী যদি স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে চায়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে তাকে এবং তার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে হামলা এবং কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গীরা একই দলের সদস্য। কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় পুলিশের তরফ থেকে জঙ্গীদের আত্মসর্মপণ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ না করে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। পুলিশ প্রধান আরও বলেন, এখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের সরাসরি কোন নাশকতায় জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। জঙ্গী সংগঠনটির অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। যাদের অনেকেই এক সময় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ছিল। গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনায় নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম সন্দেহের বাইরে নয়। তিনি নজরদারিতে রয়েছেন। প্রয়োজন হলে যে কোন সময় তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘটনার সঙ্গে হাসনাত করিম জড়িত ছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে তথ্য-প্রমাণ যোগাড় এবং যোগাড়কৃত তথ্য-প্রমাণ যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। গুলশানের হলি আর্টিজানে জিম্মি দশা থেকে ৩২ জনকে মুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে হাসনাত করিম ও তার পরিবারের সদস্যও রয়েছে। হাসনাত করিমের পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার পরিবর্তে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে পল্লবীর পলাশনগরের নিজ বাড়ির সামনে রাত সাড়ে আটটার দিকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে খুন হয় প্রকৌশলী অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, সিলেটে অনন্ত বিজয় দাশসহ অনেকেই। ২০১৩ সাল থেকে হালনাগাদ এ ধরনের ৫১টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৭২ জন জড়িত বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এরমধ্যে গ্রেফতার হয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে ৫৮ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। ইতোমধ্যেই ১৪টি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। আরও কিছু মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে। এসব ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েই বেরিয়ে আসতে থাকে জঙ্গীবাদ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
×