ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পিভিট টু এশিয়া ॥ আসল অস্ত্র আইএস

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৩ আগস্ট ২০১৬

পিভিট টু এশিয়া ॥ আসল অস্ত্র আইএস

মিকেল্যাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে প্রচুর। সিসটিন চ্যাপেলের ‘ফ্রেসকো’ নিয়েও। গ্রীক ও রোমান যুগের ভাস্কর্য দেখার পর ‘ডেভিড’ দেখলে রেনেসাঁর আগের ও পরের শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বোঝা যায়। রেনেসাঁর আগের শিল্পীরা দেবদেবী বা মিথলজিকেই বিষয়বস্তু করেছেন। পরের শিল্পীরা মানুষ এবং মানবিকতাকে সামনে এনেছেন। ফ্লোরেন্সের মিকেল্যাঞ্জেলো চত্বরে ‘ডেভিড’-এর সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়তে পারে এখান থেকেই শুরু হয়েছিল রেনেসাঁ। ছোট পাহাড়ের ওপর এ চত্বর থেকে যে সূর্যাস্ত দেখার জন্য উদগ্রীব পর্যটকরা পশ্চিমাকাশে চোখ রেখেছেন, ‘পশ্চিমের’ সে সূর্য একদিন অস্তমিত হয়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রায় পাঁচ শ’ বছর স্থায়ী হয়েছিল ইউরোপের সেই অন্ধকার যুগ। তারপর যে জাগরণ তার শুরু এখান থেকে। ভূমধ্যসাগর হয়ে এশিয়ার ভারত, চীন ও আরব দেশগুলো থেকে মসলা ও বিভিন্ন শৌখিন উপকরণ ইউরোপে আসত ইতালি হয়ে। মূলত এর ওপর নির্ভর করেই ইতালির নগর রাষ্ট্রগুলো বিকশিত হয়েছিল। সেই বিকাশই জন্ম দেয় রেনেসাঁর। এগার-বারো শতকে ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল তাতে এশিয়ার এ দেশগুলোর অবদান উল্লেখযোগ্য। প্রথম দিকে মসলা ও শৌখিন দ্রব্য আমদানি করলেও পরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা নিজেরাই পৌঁছে যায় ‘সোনার খনি’ ভারতবর্ষে। সেখানকার কাঁচামালে সমৃদ্ধ করে নিজেদের শিল্পকারখানা। ধীরে ধীরে হাতবদল হয় ক্ষমতার। ইউরোপীয় নাবিক কলম্বাস আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছতে গিয়ে পৌঁছে যায় আমেরিকায়। ধীরে ধীরে বিশ্বের ক্ষমতার ভর আটলান্টিকের এপাড় থেকে চলে যায় ওপাড়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য পুরোপুরি অস্ত যাওয়ার পর আটলান্টিকের ওপাড়ে নতুন সাম্রাজ্যের যে সূর্যোদয়-তার গঠন, প্রকরণ, রণকৌশল সবই নতুন। নিজেদের আগমনী জানিয়েছিল তারা পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে। ॥ দুই ॥ ট্রুম্যান ডকট্রিন এর ছক অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়ার পতন সম্পন্ন হয়েছে গত শতকের শেষ দশকে। সে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতার কেন্দ্র ছিল ইউরোপ। ডকট্রিনের পরের অংশে ছিল মধ্যপ্রাচ্য। এ শতকের শুরু থেকে দু’হাজার ষোল পর্যন্ত সেখানকার ধ্বংস যজ্ঞেও তারা সফল। যদিও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসেনি। তুরস্কের ইনসারলিক বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে আইএস ‘ধ্বংস করতে’ সিরিয়ায় হামলা চালাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া তারা অব্যাহত রাখছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে। এদিকে তাদের বড় হিসাব এখন চীনকে ঘিরে। বলা যায়, দক্ষিণ চীন সাগর হচ্ছে আসল মাথা ব্যাথা। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ফিলিপাইন ভিয়েতনাম ইন্দোনেশিয়া ব্রুনাইকে নৌশক্তি প্রদর্শনের জন্য উস্কাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শতকরা আশি ভাগ জ্বালানি তেল আসে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাঝখানের মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগও এ পথে। এ পথ বন্ধ করে দিয়ে চীনকে বাণিজ্য ঝুঁকিতে ফেলাই যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তারা নৌশক্তির এক বড় অংশ দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই গোটা পরিকল্পনার নাম ‘পিভট টু এশিয়া’। এর বাস্তবায়নের জন্য দু’হাজার পনের সালে প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক কৌশলগত দলিল- ‘এ ক্রিয়েটিভ স্ট্রাটেজি ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি সী পাওয়ার : ফরোয়ার্ড, এনগেজড, রেডি সংক্ষেপে সি এস ২১ আর। সিএস ২১-এ আরও বলা হয়েছে দুহাজার বিশ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমান শক্তির শতকরা ষাট ভাগ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। চীনকে ঘেরাও করার জন্যই যে এ পরিকল্পনা তাও এতে স্পষ্ট করা হয়, এ পরিকল্পনায় আরও রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান নৌযুদ্ধ এবং ভারত মহাসাগরে চীনের আমদানি রফতানি যে কোন সময় আটকে দেয়া। দু’হাজার বার সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে সে সময়ের মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিও পেনট্টা যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির শতকরা ষাট ভাগ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করার কথা জানান। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে চীন ও বসে নেই। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির কেন্দ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা এখন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চীন। ডলারের হিসাবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিনগুণ। দু’হাজার সাত সালেই আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। বেজিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান জিকে ড্রাগনোমিক্সের এক কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে অতিরঞ্জন নেই বলেই মনে হয়। কারণ বিশ্ব মুদ্রা মজুদের চল্লিশ শতাংশের বেশি রয়েছে চীনের কাছে। দুই হাজার পঁচিশ সালের মধ্যে দু’শ’ একুশটি নগর ও আটটি অত্যাধুনিক মেগাসিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার প্রতিটিতে জনসংখ্যা থাকবে দশ লাখ। চীনের অর্থনীতি লাফিয়ে এগোচ্ছে। দু’হাজার দশের শেষ দিকে ডলারের হিসাবে তার অর্থনীতির আয়তন ছিল পাঁচ দশমিক আট ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলার। এক শ’ পঁয়ত্রিশ কোটি দশ লাখ জনসংখ্যার দেশ চীন বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভোক্তা। প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্য চীনকে তাই বিভিন্ন মহাদেশে অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে। বিমানবাহী জাহাজ তারা সমুদ্রে ভাসিয়েছে সে খবর এখন পুরনো। সব শেষ খবর (২০১২ সালের) হলো, চীন দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন শুরু করেছে যা সমুদ্রে চলমান জাহাজে আঘাত করতে সক্ষম। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বে এই প্রথম। বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মূলস্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে নৌশক্তির প্রদর্শনের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল। চীনের এ দ্রুত এগিয়ে চলা ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠীর যে অংশ বুশ প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা এখন বেশি সোচ্চার। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যস্ততার থাকার সুযোগে চীন বিশ্বজুড়ে তার আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করেছে। নৌপথে আটকে যাওয়ার বিকল্প হিসেবেও চীনের বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। দু’হাজার চৌদ্দ সালে সিঙ্গাপুর থেকে চীনের কুন মিং পর্যন্ত রেল পথ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যা সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে লাওস অথবা মিয়ানমার হয়ে চীন পৌঁছাবে। এটি চালু হলে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সমুদ্র বন্দরগুলোর সঙ্গে চীন সরাসরি যুক্ত হবে। বেলুচিস্তানের গোয়াদরে আরব সাগর তীরে চীন যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে তার সঙ্গে চীনা ভূখ-ের সড়ক ও রেলপথ এবং তেল ও গ্যাস পাইপে লাইন নির্মাণের পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে এবং কাজও শুরু হয়েছে। দক্ষিণ চীন থেকে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে সড়ক ও রেল পথ নির্মাণের কাজ ও তারা শুরু করে। ওদিকে আফগানিস্তান-ইরান হয়ে আরব সাগর ও পারস্য সাগরে পৌঁছানোর পথ তৈরির পরিকল্পনা ও চীনের রয়েছে। চীন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিভিট টু এশিয়া’র মূল কৌশল তাই দক্ষিণ চীন সাগরে সংঘাত সৃষ্টি করা। আসিয়ান দেশগুলো, যাদের চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বিনিময় রয়েছে, তাদের চাপে রাখা। কথা না শুনলে বিপদ। কি বিপদ তা সহজে আন্দাজ করা যায়। বিপদের নাম আইএস। চীনের উইঘুর মুসলিম তরুণদের একটি বড় অংশকে আইএস এ প্রশিক্ষণ দেয়া আছে। যাতে সময় মতো চীনের অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টিতে তাদের কাজে লাগানো যায়। শুধু চীনে নয়। চীন ঘিরে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও প্রয়োজনে আইএস অস্ত্র প্রয়োগ করবে তারা। যার কিছু আলামত এর মধ্যেই শুরু হয়েছে।
×