ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় রায়

বন্ধুস্মৃতি ॥ একে একে নিভিছে দেউটি কমরেড সিদ্দিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৩ আগস্ট ২০১৬

বন্ধুস্মৃতি ॥ একে একে নিভিছে দেউটি কমরেড সিদ্দিকুর রহমান

আমার প্রিয় বন্ধু কমরেড সিদ্দিকুর রহমান ১৫ জুলাই ২০১৬ তারিখ রাতে তাঁর চামেলীবাগের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি নিবেদিত হলো ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে। ১৭ জুলাই সকালে তাঁর পার্টি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের অফিসে রাখা হয় সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর মানসে। সেখানে তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধারা এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বেলা ১২টা ৪৫ মি. জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সিদ্দিকুর রহমানের জন্ম বরিশাল শহরে মনসুর আবাসিক ভবনে ১৯৩৫ সালে। পিতা নিজামুল হক ও মা সেতারা বেগম। সিদ্দিকুর রহমানরা এক ভাই ও দুই বোন। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ধরশাকাঠি গ্রামে ছিল তাঁর পৈত্রিক নিবাস। বরিশাল জেলা স্কুলে পড়া অবস্থায় বরিশাল সমিতির (অনুশীলন সমিতি বরিশালে ‘বরিশাল সমিতি’ নামে কাজ করত) সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ তাঁর। পরে ‘আরএসপি’র (জঝচ) রাজনীতিতে যোগ দিয়ে দেশমাতৃকার সেবা এবং লড়াই করে গেছেন। বরিশাল বিএম কলেজের ব্যাচেলর, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। বিশ^বিদ্যালয় জীবন শেষে প্রথম জীবনে তিনি স্কুল ও কলেজে কয়েক বছর শিক্ষকতা করেন। সেই সুবাদে অনেকেই তাঁকে প্রফেসর সিদ্দিকুর নামে চেনে। এক সময় তিনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। বাংলা ক্রাফটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। পাকিস্তান পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন কমরেড সিদ্দিকুর রহমান। এর আগে ১৯৬৯ সালে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মেহনতি মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে যে ক’জন শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল গড়ে তোলেন বরিশালের অনুশীলন সমিতির নেতা ও পরবর্তীকালে অনিকেত নামে পরিচিত বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত নির্মল সেনের নেতৃত্বে তাদের মধ্যে কমরেড সিদ্দিকুর রহমানের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি ছিলেন এই দলের প্রথম সাধারণ সম্পাদক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ও তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির ছিলেন অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা। তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি গঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ১৫ দলীয় জোট, ৫ দল, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও ১১ দলীয় জোট গঠনে এবং পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিতেও সিদ্দিকুর রহমান অবদান রেখেছেন। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে মেহনতি মানুষের মুক্তিতে সকল সংগ্রামে জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন আপোসহীনভাবে। বলা যায়, সংগ্রামের আরেক নাম সিদ্দিকুর রহমান। জয়তু কমরেড, জয়তু সিদ্দিকুর রহমান। যেহেতু সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন আরএসপি রাজনৈতিক আদর্শের, আমার মতে শেষ সলতে, তাই পরিশিষ্টে আরএসপির একটি পরিচয় সংযোজন করা হলো। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন আমার সমবয়সী এবং আমার সাহসী বন্ধুদের অন্যতম। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী আমার এই বন্ধুটি পরম শ্রদ্ধেও বটে। আমার ঠিক মনে নেই কোন্ সময়ে আমরা পরস্পরের পরিচিত হয়েছিলাম। নির্মল সেন অবশ্য এর একটি উৎস। আমার মনে হয় ’৬২টির শিক্ষা আন্দোলনকালে পরিচিত হয়েছিলাম। আমি সে সময় ৫ বছরের জন্য দেশের বাইরে থাকায় এর বিরতি ঘটে। ১৯৬৮তে দেশে ফিরে সেই ৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলনে ও সত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে আবার কাছাকাছি এলামÑ সেই সংযোগ সূত্রের আর ছেদ ঘটেনি আমৃত্যু। বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল সম্পর্কে সামান্য কথা। বর্তমানে এই দলটি বর্তমানে ভারতে একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে স্বীকৃত। এর তৎপরতা মূলত পশ্চিমবঙ্গেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য কিছু দৃশ্যমান তৎপরতা কেরালা, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরাতেও রয়েছে। দলটির ১৮টি শাখা রয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় দলটি বাম ফ্রন্টের অংশীদার; কিন্তু কেরালায় এটি বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক দর্শনে দলটির অবস্থান বামপন্থী এবং সমাজবাদ ও মার্কস বা লেনিনবাদের আদর্শের ভিত্তিতে ক্রিয়াশীল। ভারতীয় বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয় ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে। মূলত অনুশীলন সমিতির রাজনৈতিক বহির্প্রকাশ বা সংগঠনরূপে অথবা বলা যেতে পারে বাংলার স্বাধীনতা বা মুক্তি আন্দোলনরূপে। এর শেকড় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে হিন্দুস্তান সমাজবাদী প্রজাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী থেকে (ঐরহফঁংঃধহ ঝড়পরধষরংঃ জবঢ়ঁনষরপধহ অৎসু)। যে যুবকরা, যারা অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন তারা মার্কস-লেনিন পা-ুলিপি মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছিলেন। ফলে মৌলিক বা রেডিক্যাল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে ব্রিটিশ প্রশাসন তাদের বহুবার কারারুদ্ধ করে। যদিও এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী সময়ে অনুশীলন সমিতি থেকে বের হয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিআই) যোগ দেন; সিপিআই তখন সর্বাপেক্ষা পুরনো রাজনৈতিক দল, যারা ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত করে। তবে বেশিরভাগ সদস্যই সমিতিতেই থেকে যান, প্রাচুর্যপূর্ণ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পঠন-পাঠনে ব্যস্ত থেকে। আরএসপি হলো কমিউনিস্ট আদর্শভিত্তিক বহু দলের মধ্যে অন্যতম। এটির জন্ম হয়েছিল সেই সময় যখন ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিষ্পেষণে জর্জরিত হচ্ছিল। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং লেনিনের পরিচালনায় বলশেভিকদের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ে উজ্জীবিত হয়ে, এই তরুণ ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে মার্কসবাদের আদর্শকে ব্যবহার করতে চাইলেন। ‘সমাজবাদ একমাত্র দেশে এই ক্রমবর্ধমান গুঞ্জন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলল। তারা ‘জাতীয় সংস্কারবাদীদের কপটতা (যুঢ়ড়পৎরং) এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘সামাজিক ফ্যাসিস্ট’ নামে অভিহিত করলেন। তাদের উগ্র এবং বিপ্লবী চেতনা বা স্পিরিট দেশের শ্রমিক শ্রেণীর দুরবস্থা উন্নয়নের কাজে লাগাতে চাইলেন। উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের অনেক কমিউনিস্ট মিলিতভাবে কর্মজীবী, কৃষক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের অংশ হিসেবে। মার্কসবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত তাদের সেøাগান ছিল ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ (‘ডড়ৎশবৎং ড়ভ অষষ খধহফং টহরঃব’)। স্টালিনবাদের ফ্যাসিবাদী মানসিকতা বর্জন করলেও তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রটস্কিবাদ (ঞৎড়ঃংশুরংস) গ্রহণ করেননি। ১৯৪০ সালে বিহারের রামগড়ে অনুশীলন সমিতির সদস্যরা এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্যরাসহ একটি ঐতিহাসিক সম্মেলনে একত্রিত হয়ে আরএসপি গঠন করেন। আরএসপির শক্তিশালী এজেন্ডা হলো একসঙ্গে কাজ করা সমমনাদের নিয়ে। একত্রে অনুশীলন ও অধ্যয়ন, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যাতে আন্দোলনকে সিভিল ওয়ার ক্রাইয়ে (ঈরারষ ডধৎ ঈৎু) পরিণত করা যায়। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তরকালে আরএসপির মধ্যে নানা বিভাজন ও গোষ্ঠীর উদয় হয়। বর্তমানে ত্রিপুরায় বাম মোর্চা সরকারের শরিক এবং আইন পরিষদে দুটি আসন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ৭টি এবং কেরালা বিধানসভায় দুটি আসন রয়েছে। আরএসপির নির্বাচনী প্রতীক দলটির নির্বাচনী প্রতীক হলো ‘কোদাল ও স্টোকার’। এই প্রতীকটি লাল রঙের পতাকায়, যে রংটি সংগ্রামের প্রতীকরূপে গণ্য এবং যা কমিউনিস্ট পার্টিকে চিহ্নিত করে অঙ্কন করা হয়। লাল হলো বিপ্লবী উদ্দীপনা ও আদর্শের রং এবং ‘কখনও বলবে না মরব না’ এই শক্তির প্রতিনিধি। লাল হলো আর একদিকে রক্তের রং, যা কিনা শ্রেণী সংগ্রামকে চিহ্নিত করে। কোদাল এবং স্টোকার স্বতন্ত্রভাবে অতীব তাৎপর্যময়। এই প্রতীকের পেছনে যে মোটিভ কার্যকর তা হলো আরএসপি হচ্ছে কৃষক, চাষী, শ্রমিক ও কর্মীদের, যারা মাঠে, কল-কারখানায় জীবিকার জন্য কাজ করে। এটি শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থাকে তুলে ধরে বা প্রদর্শন করে। হ্যামার বা হাতুড়ি ভূমি কর্ষণে বা কল-কারখানায় ব্যহার হয়ে থাকে। একজন শ্রমিক বা চাষী সারাদিন শ্রম দিয়ে দিন শেষে সামান্য পারিশ্রমিক পায়। এই অবস্থানটির প্রতিনিধিত্ব করে আরএসপি। আরএসপি তার মার্কসীয় আদর্শের ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের সমর্থনে সারাদেশে নিজেদের তুলে ধরে, তুলে ধরে শ্রমজীবী মানুষের দাবি-দাওয়াকে। আরএসপি মনে করে এই শ্রেণী সংগ্রাম চলতেই থাকবে যতদিন না মার্কসের স্বপ্ন সমাজতন্ত্র ও শোষক শ্রেণীকে উৎখাত করে শোষিত জনতা বা প্রোলেটারিয়েটরা (ঢ়ৎড়ষবঃধৎরধঃ) রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সারা বিশে^। লেখক : পদার্থ বিজ্ঞানী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×