ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চেšধুরী

আগস্ট মাসের পাঁচালি

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৩ আগস্ট ২০১৬

আগস্ট মাসের পাঁচালি

আগস্ট মাস এলেই মনটা ভারি হয়ে ওঠে। অনেকগুলো প্রয়াণ দিবস রয়েছে এই আগস্ট মাসেই। এই আগস্ট মাসেই আমরা হারিয়েছি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে। হারিয়েছি স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকেও আমরা হারিয়েছি এই আগস্ট মাসেই। এত স্মৃতিময়, মন্ময় এবং বেদনাময় মাসটির একটিই বৈশিষ্ট্য, এই তিনটি প্রয়াণ দিবসের মধ্য দিয়ে বাঙালীর মধ্যে এমন একটি জাতিসত্তাবোধ জেগে ওঠে, যা তাকে সকল সঙ্কটের মুখে অস্তিত্ব রক্ষায় প্রেরণা জোগায়। বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন বিশ্বকবি। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে শুধু একটি জাতি-রাষ্ট্রের ভাষা করা নয়, জাতিসঙ্ঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বসভায় এই ভাষার আসন তৈরি করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম পরিচিত হয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। বাংলার কবি, কিন্তু ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো তিনি সারা বিশ্বের দরিদ্র, পীড়িত, নির্যাতিত মানবসত্তাকে সকল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে অগ্নিবীণা বাজিয়েছেন। আগস্ট মাস তাই বাঙালীর জন্য শুধু শোক আর স্মরণের মাস নয়, জেগে ওঠার এবং আত্মোপলব্ধির মাসও। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাঙালীর পুনর্জাগরণের যে জোয়ার তৈরি করেছিলেন তারই পূর্ণ রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটে শেখ মুজিবের মধ্যে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রাম। তৈরি হয়েছে বাঙালীর নেশন স্টেট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু তার সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা অটুট রয়েছে। এই জাতিসত্তা ধর্ম-বর্ণভিত্তিক নয়। তার ভিত্তি লোকজ সংস্কৃতি। তার বৈশিষ্ট্য অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতা। এজন্যে একমাত্র বাংলার সাধক কবিই বলতে পেরেছেন “কালো বরণ গাভীরে ভাই শাদা বরণ দুধ/জগৎ ভ্রমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।” এই হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে পাহারা দিয়েছেন চর্যাপদ, ময়মনসিং গীতিকার কবিরা থেকে শুরু করে আলাওল, চ-িদাস এবং এ যুগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ও শামসুর রাহমান। বাঙালীর এই জাতিসত্তা হাজার বছর ধরে যখনই আক্রান্ত হয়েছে তার ভাষা ও সংস্কৃতিই তাকে আগলে রেখেছে, তাকে রক্ষা করেছে। ধর্মের ছুরিতে তাকে ভৌগোলিকভাবে ভাগ করেও তার সাংস্কৃতিক সত্তাকে ভাগ করা যায়নি। পাকিস্তানী শাসকেরা বিভক্ত বঙ্গের পূর্বাংশে কম চেষ্টা করেনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে উচ্ছেদ করতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মুছে দিতে। তারা তা পারেনি। বরং রবীন্দ্র-নজরুলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন শেখ মুজিব। তৈরি করেছেন বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক জাতি-রাষ্ট্র। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আজ নেই। নেই বঙ্গবন্ধুও। বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রটি এখনো টিকে আছে। কিন্তু তার অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে। এখনো এই চক্রান্ত ও চতুর্দিকের আক্রমণের মুখে বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক সত্তার বলিষ্ঠ পাহারা বাংলা ভাষা, রবীন্দ্র-নজরুল ও শেখ মুজিব। এই তিনটি রক্ষাকবচ থাকা পর্যন্ত যত জামায়াতি চক্রান্ত চলুক, তালেবানি ধরনের হামলা চলুক, হেফাজতি গর্জন উঠুক, বাংলার গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-ভিত্তি ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। একদা বাংলাদেশ জর্জরিত ছিল সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাসে। রাষ্ট্র কাঠামোই ছিল সাম্প্রদায়িক। এই সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামো থেকে মুক্তি লাভের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে সিকি শতাব্দী লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াই ছিল সাংস্কৃতিক লড়াই। রাজনৈতিক লড়াই এই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ফসল। প্রথমে ভাষার জন্য আন্দোলন। তারপর রবীন্দ্র্র সঙ্গীত ও সাহিত্য নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন। বাংলা ভাষার হরফ বদলের বিরুদ্ধে আন্দোলন। বৈশাখের নববর্ষ উৎসব, নবান্ন, শারদোৎসব ইত্যাদি বাঙালীর জাতীয় উৎসবগুলোকে হিন্দুয়ানী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন। যাত্রা, জারি, সারি, বাউল ও বৈষ্ণবদের গানকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা প্রতিরোধ ইত্যাদি নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতি-চেতনার বিকাশ ঘটে এবং যার পরিণতি স্বাধীন বাংলা দেশের প্রতিষ্ঠা। পুরনো সাম্প্রদায়িকতার দানব এখন নতুন রূপ ধারণ করেছে। এখন তা ধর্মান্ধতায় আরো ভয়াবহ সন্ত্রাস। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক সত্তাতেই তা এখন বারবার আঘাত করছে। মরণ কামড় হানছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ সময় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শিবির বিভক্ত ও দুর্বল। সরকার প্রশাসনিক সর্বশক্তি নিয়ে এই সন্ত্রাস দমনের চেষ্টা করছেন। সর্বতোভাবে পেরে উঠছেন না। ঠিক এই সময় পঞ্চাশের দশকের মতো আরেকটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার বাংলাদেশে। তাহলে অতীতের সাম্প্রদায়িকতার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য লাভের মতো বর্তমান ধর্মান্ধতার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে সাফল্য লাভ করা সহজ হবে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে রাজনৈতিক তথা গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে পঞ্চাশের দশকের অভিজ্ঞতাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের কথা। ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হওয়ার পরিণতিতে এ সময় নবপ্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। বরিশাল, নোয়াখালী, খুলনায় ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য ভারত প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হন। দাঙ্গাবিরোধী কমিটি গঠন করেন। দাঙ্গার বিরুদ্ধে কবিতা, গান, গল্প লেখা শুরু হয়। ঢাকাসহ সব জেলা শহরে দাঙ্গাবিরোধী মিছিল, সভানুষ্ঠান করা হয়। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘দাঙ্গা-বিরোধী পাঁচটি গল্প’ শীর্ষক বইটি এ সময়েই প্রকাশিত হয়। আমি তখন ছিলাম বরিশাল শহরে। তখন দেখেছি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের (তখন ছাত্র ফেডারেশন নাম বদল করে ছাত্র ইউনিয়ন হয়নি) কর্মীরা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেকটি স্কুল ও কলেজে গেছেন। ছাত্রদের মনে দাঙ্গাবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। যেসব ছাত্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতাদের উস্কানিতে বিভ্রান্ত হয়েছে তাদের অনেকের মধ্যেই সুস্থ মানসিকতা ফিরিয়ে এনেছেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জেলাতেই এই দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। জেলায় জেলায় গণসঙ্গীতের আসর বসিয়ে দাঙ্গাবিরোধী গণচেতনা গড়ে তোলা হয়েছে। বরিশালে এবং ঢাকায় দু’জন বুদ্ধিজীবী দাঙ্গা রুখতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। যে কোন কারণেই হোক বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িকতার দানব ধর্মান্ধতার দানবের রূপ ধরে আত্মপ্রকাশর সুযোগ পেয়েছে। তার আরও হিংস্র মূর্তি। এখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিরীহ মানুষকে তারা হত্যা করছে। এই জঙ্গীবাদ দেশের একদল বিভ্রান্ত তরুণকেও প্রভাবিত করেছে। সরকার চেষ্টা করছেন সর্বশক্তি প্রয়োগে এই সন্ত্রাস মোকাবিলার। কিন্তু কোন হিংস্রতা যখন কোন আদর্শের বা ধর্মের আলখেল্লা ধারণ করে আবির্ভূত হয় এবং সমাজের সকল স্তরে প্রবেশ করে তখন এই ব্যাধিটিকে দূর করার জন্য সামাজিক প্রতিরোধ দরকার। আর এই সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে পারে একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পঞ্চাশের দশকের মতো আমাদের তরুণ বুদ্ধিজীবী মহলও এখন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী নন। প্রবীণদের মধ্যে সুশীল নামধারী অংশটি স্বাধীনতাউত্তর দেশে নানা সামাজিক সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়ে সেই কায়েমী স্বার্থরক্ষার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন, সামাজিক দায়িত্ব পালনের কোন ঝুঁকি গ্রহণ করতে চান না। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে ছাত্র সমাজের একাংশকে লাইসেন্স, পারমিটবাজিতে ঢুকিয়ে এমনভাবে ছাত্র ঐক্যে ভাঙন ও দুর্বলতা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, তাতে বিভ্রান্ত অনেক তরুণকে জঙ্গীবাদ প্রভাবিত করার সুযোগ পাচ্ছে। এই অবস্থার পরির্তন ঘটানো প্রয়োজন। পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন এবং ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মতো একটা জোরদার এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আমাদের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, গায়ক, নাট্যকার সকলের এগিয়ে আসা উচিত। দেশের সকল স্থানে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল, শোভাযাত্রা হওয়া প্রয়োজন। রমেশ শীলের মতো কবিয়াল, যিনি পঞ্চাশের দশকে তার লোকগানের মাধ্যমে মুসলিম লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি আজ নেই। কিন্তু তার মতো মানসিকতার অনেক কবিয়াল এখনো দেশে আছেন, তাদের সংগঠিত করে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসবিরোধী গানের আসর বসালে তা অনেক বেশি কাজ দেবে। পঞ্চাশের দশকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা স্কুলে, কলেজে ঘুরে ঘুরে সভা করেছেন। তরুণদের মধ্যে দাঙ্গাবিরোধী চেতনা গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন এই কাজটি করতে পারে। প্রতিটি স্কুল-কলেজে সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশের তরুণদের মনে সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা তৈরি করতে পারে, যারা জঙ্গীবাদের মোহে আচ্ছন্ন হয়েছে, তাদের আচ্ছন্নতা দূর করতে পারে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সবচাইতে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের গান ও কবিতা এবং বঙ্গবন্ধুর বাণী ও বিবৃতি। এই আগস্ট মাসে তাদের মহাপ্রয়াণ দিবসে তাদের স্মরণ করতে গিয়ে আমরা যদি এ কাজটি করতে পারি, তাহলে বর্তমানের প্রকৃত ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজমেও আমরা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবো। লন্ডন, ২ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০১৬।
×