ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধে নতুন মাত্রা

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩ আগস্ট ২০১৬

দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধে নতুন মাত্রা

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় সীমানা চিহ্নিত করার স্থানীয় পদ্ধতির নাম নাইন ড্যাশ লাইন। ১৯৪৮ সাল কিংবা আরও আগে থেকে চীন সমুদ্র সীমা নির্ধারণে ঐ নাইন ড্যাশ লাইন পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছিল। ঐ আলোকেই চীন দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকায় একক সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু অধিকারের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে সম্প্রতি পার্লামেন্ট কোর্ট অফ আরব্রিট্রেশন এক রায়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্য ঐ জলরাশিতে চীনের সঙ্গে সার্বভৌমত্ব বিবাদের সূত্র ধরে ফিলিপিন্স ২০১৩ সালে এই মামলাটি দায়ের করে। মামলায় অংশ না নেয়া চীন তাৎক্ষণিকভাবে এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এক প্রতিক্রিয়ায় দেশটি বলেছে- ‘আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের এই রায় বেইজিং মানবে না। এখানে চীনা জনগণের অধিকার দুই হাজার বছর ধরেই স্বীকৃত।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ দক্ষিণ চীন সাগরের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত বহুজাতিক বিরোধ আরও ঘনীভূত হলো। গত দশক থেকেই ঐ জলসীমায় আঞ্চলিক দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি জোরদার হয়। বিশেষত ঐ জলরাশি ঘিরে বেইজিংয়ের সামরিক বেসামরিক তৎপরতায় নিজেদের অধিকার ক্ষুণœ হওয়ার দাবি করে আঞ্চলিক দেশসমুহ। বিশেষত ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ঐ জলরাশিতে বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের ন্যায্য তৎপরতা চালাতে গেলে বাধার সম্মুখীন হয়। আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে উপকুলীয় দেশের জন্য নির্ধারিত সমুদ্র সীমার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আঞ্চলিক দেশগুলোর তৎপরতা ক্রমেই সীমিত হয়ে পরে বৃহৎ শক্তি চীনের বাধায়। পক্ষান্তরে বেইজিং আঞ্চলিক দেশগুলোর দাবি অগ্রাজ্য করে সেখানে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আরও মরিয়া হয়ে উঠে। এ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুতে জড়িয়ে চীনের সঙ্গে বিবাদেলিপ্ত দেশগুলোকে সমর্থন দিতে থাকে। মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একক আধিপত্য কার্যত হুমকির মুখে পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আঞ্চলিক দেশগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় চীন শক্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যা দক্ষিণ চীন সাগরের সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত বহুজাতিক বিরোধকে সামরিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত ক্ষমতার পরীক্ষা হচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট। সঙ্গত কারণেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে ঐ জলসীমায় চীনের আইনগত অধিকার সীমিত হবে কিনা?। ফিলিপিন্স কিংবা অন্যান্য দেশগুলুর সার্বভৌম দাবি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? তবে এই রায় দক্ষিণ চীন সাগরের বিদ্যমান সমীকরণ পাল্টে দিবে নিঃসন্দেহে। মূলত এই ইস্যুতে চীনের ওপর আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর চাপ আরও বৃদ্ধি করবে এই রায়। যদিও বেইজিং পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে বাইরের হস্তক্ষেপ চীন বরদাস্ত করবে না। সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাই একমাত্র প্লাটফর্ম বলে বেইজিং তার পূর্বোক্ত অবস্থান পুর্নব্যক্ত করে।’ রায়ের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যেই চীন ঐ জলসীমায় তার সার্বভৌম অধিকার অক্ষুণœ রাখতে বেশ কিছু সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ঐ অঞ্চলে নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন অন্যতম। পাশাপাশি চীনের অনুকূল বাণিজ্যিক অগ্রগতি আরও দ্রুততর করতে উপকূলীয় এলাকায় বিশটি পরমাণুু শক্তি কেন্দ্র স্থাপনের অঙ্গীকার করেছে। এই রায়ের অব্যবহিত পর যুক্তরাষ্ট্র- চীনা বিশেষ আলোচনায় এসব পরিকল্পনার কথা জানায় বেইজিং। চীনের এ রকম পদক্ষেপ ঐ অঞ্চলে পাল্টা সামরিক তৎপরতার পথ বিস্তৃত করবে সন্দেহ নেই। গত এক বছর থেকেই ঐ জলরাশিকে কেন্দ্র করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেশ কয়েকবার সামরিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। আর চলমান পরিস্থিতিতে দক্ষিণ চীন সাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী সামরিক তৎপরতার আগ্রহকে আরও যৌক্তিকতা দিবে। ঐ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক জলসীমায় স্থায়ী মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত হলে বিরোধপূর্ণ এলাকায় আঞ্চলিক দেশগুলোর তৎপরতা নির্বিঘœ করবে বলেই প্রতীয়মান হয়। যে প্রক্রিয়ায় ঐ অঞ্চলের সামরিক সমীকরণে চীনের আনুকূল্যতা বিনষ্ট হতে পারে। বিদ্যমান স্থিতিশিলতা ভেঙ্গে পড়তে পারে। মোটকথা দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের বিরোধ আরও বিস্তৃত করবে আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায়। ফলে ফিলিপিন্সের মতো আরও অনেক দেশ যারা এই সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বেলিপ্ত আছেন তারাও আরও আইনগত ব্যবস্থা নিতে উৎসাহী হবে। এই ইস্যুতে আরও আন্তর্জাতিক পক্ষ জড়িয়ে পরলে সেটি চীনের জন্য চরম অসবস্থিকর হবে। ইতোমধ্যে ঐ জলরাশির আন্তর্জাতিক অধিকারের সুবিধা কাজে লাগাতে ভারতের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের মতো আরও অনেক দেশও আগামীতে এই পরিক্রমায় যুক্ত হলে চীনের পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবেলা খুব কঠিন হয়ে উঠবে। যা একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের পথও প্রসস্থ করতে পারে। তাই এই সঙ্কটের পরবর্তী সময়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
×