ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগারগাঁওয়ে মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা শুরু

জীবিকার জন্য গাছ জীবনের জন্য গাছ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২ আগস্ট ২০১৬

জীবিকার জন্য গাছ জীবনের জন্য গাছ

আনোয়ার রোজেন ॥ নার্সারির মালিক ফারুক হোসেন বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই বললেন কথাটা- প্রতিদিন সকালে খালিপেটে এই গাছের দুইটি পাতা চিবিয়ে খেলে ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়! গাছটা বিদেশী। এর আসল নাম তিনি জানেন না। ডায়াবেটিসের রোগীরাই গাছটি কেনেন, তাই এই গাছের নাম দিয়েছেন ‘ডায়াবেটিস গাছ’! ভেষজ ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছটি সর্বোচ্চ তিন ফুট লম্বা হয়। এরপর ডালাপালা বিস্তার করে জঙ্গলের মতো হয়ে যায়। সব ধরনের মাটিতে জন্মায়। পাতার রং কচি কলাপাতার মতো সবুজ। ‘ডায়াবেটিস গাছের’ মতো বাহারি নামের কয়েক শ’ প্রজাতির গাছের বিপুল সম্ভারের দেখা মিলছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাণিজ্য মেলার মাঠে। জাতীয় বৃক্ষ রোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলার অংশ হিসেবে ‘জীবিকার জন্য গাছ, জীবনের জন্য গাছ’ প্রতিপাদ্যে মাসব্যাপী এ মেলা রবিবার শুরু হয়েছে। সোমবার ছিল মেলার দ্বিতীয় দিন। এর মধ্যেই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের ফল, ফুল, লতা, গুল্ম, মসলা, ভেষজ, অর্কিড, বনসাই ও শোভাবর্ধক হাজারো গাছের ‘বাগান’ সাজিয়ে বসেছে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মেলায় মোট স্টল বসেছে ৭৫টি। এর মধ্যে পরিবেশ ও বনমন্ত্রণলায়ের আওতাধীন বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরসহ আটটি সরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি মালিকানাধীন ৫৭টি নার্সারি প্রতিষ্ঠান ও ১০টি নন-নার্সারি প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে। মেলা ঘুরে দেখা গেল, ব্যক্তি মালিকানাধীন বেশিরভাগ নার্সারি নিজেদের স্টলের ভেতরে ও সামনের উন্মুক্ত চত্বরে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা সাজিয়ে বসে আছে। দুয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি নার্সারি প্রতিষ্ঠান এখনও স্টল সাজানো ও ফুল, ফল, ভেষজ ইত্যাদি ভাগে গাছের চারা সাজাতে ব্যস্ত। নন-নার্সারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্টল সাজিয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের টব, হারবাল পণ্য, জৈব সারের প্যাকেট ইত্যাদি দিয়ে। মেলা সবে শুরু হয়েছে, তাই দর্শনার্থী ও ক্রেতার সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। তাও বেশির ভাগই ঘুরে ঘুরে দেখছেন, গাছের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন ও দরদাম জানতে চাইছেন। বৃক্ষপ্রেমী ও গাছ-পালার প্রতি আগ্রহী মানুষদের নতুন নতুন প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় এই মেলা। পাশাপাশি গাছের পরিচর্যার তথ্য, গাছ কেনা, উপকরণ, টব ইত্যাদি কেনারও সুযোগ রয়েছে। নার্সারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টলে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী ফুল, শোভাবর্ধক গাছ, বনসাই, অর্কিড ও ফলের গাছের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবেদনের শুরুতে যে ‘ডায়াবেটিস গাছের’ কথা বলা হয়েছে, সেই স্টলের মালিক ফারুক হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক বাঙালী ভদ্রলোক এই গাছ দেশে আনেন। ফারুক হোসেন তার কাছ থেকেই গাছটির গুণাগুণ ও চাষপদ্ধতি জেনে নেন। মেলায় প্রতিটি ‘ডায়াবেটিস গাছ’ তিনি বিক্রি করবেন ২০০ টাকায়। পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল, ‘ডায়াবেটিস গাছের’ বৈজ্ঞানিক নাম ‘গাইনুরা প্রকাম্বেন্স’ (এুহঁৎধ চৎড়পঁসনবহং)? এটা চীন এবং সুইজারল্যান্ডে স্থানীয়ভাবে ডান্ডালিউয়েন নামেও বেশ পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চীন, মালেয়শিয়া, থাইল্যান্ড ঘুরে এই ‘এন্টি ডায়াবেটিস গাছ’ বাংলাদেশে শিকড় গেড়েছে। পাশের আরেকটি স্টলে বাহারি সব ফুলের গাছের ভিড়ে ‘ফার্স্টলাভ ফ্লাওয়ার’ লেখা গাছগুলো দৃষ্টি কাড়ছে সবার। একফুট মতন উচ্চতার গাছটির পাতার রঙ কালচে সবুজ-লাল। গাছে ফুল নেই। বোঝা গেল, বাহারি নামই আকর্ষণের কারণ। স্টলের বিক্রয়কর্মী জানালেন, এটা বিদেশী ফুলের গাছ। সারাবছরই ফুল ফুটে। ছোট ছোট ফুল দেখতে লাল ও হৃদয়াকৃতির। তাই এই নাম। এটি টবে চাষ করা যায়। প্রতিটি গাছের দাম ২০০ টাকা। গ্রীনল্যান্ড নার্সারির মালিক হারুন অর রশীদ প্রতিবছরই এই বৃক্ষমেলায় অংশ নেন। তার প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে তিন বার পুরস্কার পেয়েছে। হারুন অর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, মেলায় ফুলের গাছ, বনসাই, অর্কিড ও বাসা-বাড়ির শোভাবর্ধক হিসেবে বিভিন্ন গাছের চাহিদা বেশি থাকে। এবারও সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে স্টল সাজিয়েছেন। পাশাপাশি মৌসুমী বিভিন্ন ফল- যেমন, আম, কামরাঙা, জাম, জামরুল, বেদানা, সফেদা, পেঁপে, পেয়ারা, কমলা, লেবু, লটকন, বারোমাসি আমড়া, পেলাসহ একাধিক বিদেশী জাতের ফলের গাছের চারাও স্টলে রেখেছেন। তিনি জানান, গাছ, প্রজাতি ও আকারভেদে এসব চারার দাম ২০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি আরও জানান, শুধু গাছ বিক্রি নয়, মেলায় ঘর সাজানোর অর্ডারও পাওয়া যায়। অনেক বাণিজ্যিক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, অভিজাত হোটেল ও শৌখিন বাড়ির মালিক মেলা ঘুরে পছন্দমত শোভাবর্ধক গাছের অর্ডার দিয়ে যান। দক্ষ ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের দিয়ে সে সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কক্ষ বিভিন্ন ধরনের গাছ ও লতাপাতা দিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়। ব্র্যাক নার্সারির স্টলে দেখা গেল বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের বনসাইয়ের সমারোহ। এসব বনসাইয়ের মূল্য ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া মেলায় বিভিন্ন স্টলে বেগুনি টিপুনিয়া, বনসাই কদম, ফুকন্টি বনসাই, কারমনাই বনসাই, চাইনিজ বট, দেশী বট পাওয়া যাচ্ছে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। দেশী বিভিন্ন ফলের গাছের চারার স্টলভেদে দাম তিন শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা। তেজপাতা, দারুচিনি, ফলাও পাতা, চই, গুলমরিচ ইত্যাদি মসলা জাতীয় গাছের চারা পাওয়া যাচ্ছে কয়েকটি স্টলে। রঙ্গন, গোলাপ, জবা, বেলী, লিলি, নয়নতারা, ঝুলন্ত অর্কিড শোভা ছড়াচ্ছে প্রতিটি স্টলেই। সরকারী প্রতিষ্ঠানের স্টলগুলোতেও রয়েছে হরেক রকম প্রজাতির গাছ। তবে সবই প্রদর্শনীর জন্য। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের স্টলের সামনে স্থাপন করা গ্রামীণ, শহুরে ও পাহাড়ী এলাকায় বনায়ননের মডেলটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে। স্টল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, উপচে পড়া ভিড় এই মেলায় কখনও হয় না। তবে যা হয় সেটিই যথেষ্ট। মেলার সামনের দিনগুলোতে দর্শনার্থী ও ক্রেতার সংখ্যা বাড়বে। উল্লেখ্য, মেলা চলবে পুরো আগস্ট মাস জুড়ে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। মেলায় প্রবেশে কোন ফি লাগবে না।
×