ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পিতার সোহাগ ভাগ্যে জুটবে না এসি রবিউলের কন্যার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২ আগস্ট ২০১৬

পিতার সোহাগ ভাগ্যে জুটবে না এসি রবিউলের কন্যার

সৌমিত্র মানব ॥ পিতার আদর-সোহাগ থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়েই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতে হলো বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় নিহত সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল করিমের কন্যাটিকে। বড় হয়ে হয়ত কন্যা পিতার বীরত্বের কাহিনী শুনবে, পিতাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে, কিন্তু কোনদিনই পিতার আদর-সোহাগ ভাগ্যে জুটবে না। এদিকে বিভীষিকাময় জঙ্গী হামলায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে স্বামী হারানোর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি স্ত্রী উম্মে সালমা। তার চোখ-মুখে বেদনার ছাপ। এমন শোকের মধ্যেই জন্মগত নানা সমস্যা নিয়ে কন্যাশিশুটির জন্ম হওয়ায় উম্মে সালমা একেবারেই দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অথচ এমন দিনে তার চরম আনন্দে থাকার কথা ছিল। তারপরও তিনি সন্তানের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বলেছেন, সন্তানকে তিনি তার স্বামীর মতো বীরের বেশে দেখতে চান। তার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে। বরিবার রাত সাড়ে বারোটার দিকে সাভার এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশুটির জন্ম দেন নিহত ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী উম্মে সালমা (৩২)। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মা শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ আছেন। তবে মানিসকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। একদিকে স্বামীর শোক। সন্তান জন্ম হওয়ার পর স্বামীর কথাই বার বার মনে পড়েছে। আজ বেঁচে থাকলে তিনি খুব খুশি হতেন। সন্তানও হয়ত সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিত। স্বামী বেঁচে না থাকায় এবং মানসিকভাবে মারাত্মক দুশ্চিন্তায় থাকায় সন্তান হয়ত জন্মগত নানা সমস্যা নিয়ে জন্ম নিয়েছে। এমন ধারণাই জগদ্দল পাথরের মতো বুকে চেপে বসেছে উম্মে সালমার। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা উম্মে সালমার এমন ভাবনা ভুল বলে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি তা পুরোপুরি মানতে রাজি নন। এমন চিন্তায় উম্মে সালমাও রবিবার রাতে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার সুস্থও হয়ে ওঠেন। এজন্য সোমবার সকালে উম্মে সালমার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় উম্মে সালমা রবিবার রাত বারোটার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এজন্য রাতেই তার অস্ত্রোপচার করা হয়। হাসপাতালটির গাইনি বিভাগের চিকিৎসক কামরুন্নেচ্ছার নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক রাত বারোটা ২৮ মিনিটে উম্মে সালমার অস্ত্রোপচার করেন। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউলের অনাগত কন্যাসন্তানটি। চিকিৎসকদের পরামর্শে মাকে পোস্ট অপারেটিভ বেডে রাখা হয় আর কন্যাকে রাখা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা (এনআইসিইউ) বিভাগে। শিশুটি জন্মগত নানা সমস্যায় রয়েছে। এদিকে নিহত রবিউলের কন্যাকে দেখার জন্য হাসপাতালে ভিড় করেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিশেষ করে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা সেখানে ছুটে যান। রবিউলের স্ত্রী-সন্তানকে সুস্থ-স্বাভাবিক করে তুলতে পুলিশের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রবিউলের স্ত্রী দেশবাসীর কাছে তার সন্তান যেন সুস্থ-স্বাভাবিক হয় এবং মানুষের মতো মানুষ হয়, এজন্য দোয়া চেয়েছেন। তিনি তার সন্তানকে তার স্বামীর মতো বীরের বেশে দেখার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এজন্য সকলের সহযোগিতাও কামনা করেছেন তিনি। কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়ার পর স্বামীর কথা মনে করে অঝোরে কেঁদেছেন উম্মে সালমা। একদিকে স্বামীর শোক, আরেক দিকে সারাজীবনের জন্য কন্যাসন্তানটি পিতার আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা ভেবে ভেবে অত্যন্ত আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন তিনি। এরই মধ্যে নানা সমস্যা নিয়ে জন্ম হওয়ায় অনেকটা দিশাহারাও উম্মে সালমা। তিনি বার বারই নিজের ভাগ্যকে দোষারোপও করেছেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হয়েছেন বলেও তিনি বার বার উচ্চৈঃস্বরেই আফসোস করেছেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই। গত ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে ছয় জঙ্গী ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে। খবর পেয়ে গুলশান থানার ওসি সালাহউদ্দিন আহমেদ খান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হন। তাঁরা জিম্মি দেশী-বিদেশীদের উদ্ধার করতে অভিযান চালান। এ সময় জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলা ও গুলিতে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে জঙ্গীরা রেস্তরাঁটির ভেতরে ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। নিহত রবিউল করিমের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের কাটিবাড়ি গ্রামে। তিনি ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের মাদক প্রতিরোধ ও নির্মূল টিমে কর্মরত ছিলেন। তাঁর প্রথম সন্তান সাজিদুল করিমের বয়স সাত বছর।
×