ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষক লীগের রক্তদান কর্মসূচী উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

একাত্তরের পরাজিত শক্তিই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২ আগস্ট ২০১৬

একাত্তরের পরাজিত শক্তিই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, এখন নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে; জঙ্গীবাদ। এসব ঘটনার সঙ্গে যারাই ধরা পড়ছে গোড়ায় গেলে দেখা যায় তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের উত্তরাধিকারীরাই জড়িত। এসব জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ তাদেরই সৃষ্টি। এরা আবার পরাজিত হবে। বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসীর ঠাঁই হবে না। এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার শক্তি যে বাংলাদেশের রয়েছে, আমরা তা প্রমাণ করেছি। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে দেশবাসীর সহযোগিতার আহ্বানের পাশাপাশি সবাইকে আরও সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক এলাকার আশপাশে কে কে এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত, কারা মদদ দিচ্ছে এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। দেশ ও জাতিকে নিয়ে ২১ বছর ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। তবে দেশের জনগণ হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আমরা বিচার করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেশ অভিশাপমুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রেতাত্মা ও স্বজনরা বাংলাদেশ নিয়ে এখনও ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমরা বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাবই। সোমবার বিকেলে ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কে স্মৃতিবিজড়িত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে শোকের মাস আগস্টের সূচনা দিনে কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল ও বিভীষিকাময় হত্যাকা-ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। একদিনে বাবা-মা, ভাইসহ পরিবারের ১৮ সদস্য হারানোর বেদনা প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। আবেগময় এই স্মৃতিচারণের সময় আলোচনা সভায় উপস্থিত অনেক নেতাকর্মীই তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। পুরো আলোচনাসভা এক পর্যায়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে ও কৃষিবিদ সমীর চন্দ্রের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মাহবুবউল আলম হানিফ, ড. আবদুর রাজ্জাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল আহসান খান, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা প্রমুখ। কৃষক লীগের প্রকাশনা ‘কৃষক কণ্ঠ’ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন সাখাওয়াত হোসেন সুইট। আলোচনা সভা শেষে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। শতাধিক নেতাকর্মী আর্তমানবতার সেবায় দেহ থেকে এক ব্যাগ করে রক্ত দান করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান কেবল বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রই করেননি, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মৃত মানুষের চরিত্র হননেরও চেষ্টা করেছেন। আমি দেশে ফিরে আসার পর আমাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ বাড়িতে আমার বাবা-মা মারা গেছেন। আমি মিলাদ পড়ব, জিয়াউর রহমান সেখানে যেতে দেয়নি। রাস্তার ওপর বসেই শত বাধা অতিক্রম করে মিলাদ পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যে বাড়িতে (ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবন) আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি, রাস্তায় বসে মিলাদ পড়তে হয়েছে; সেই বাড়ি আমাকে হস্তান্তর করার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে যায়। আইনজীবীদের মাধ্যমে বাড়ি বুঝে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। তখন বুঝতে পারিনি তাদের তাড়া কেন। তিনি বলেন, বাড়ি হস্তান্তর করার পরে ৪০ দিন ধরে টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে ওই বাড়িতে হীরা, মুক্তা, টাকা পাওয়া গেছে। আর জিয়া একটি ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেড়া গেঞ্জি রেখে গেছেন। ১শ’ টাকার নোট বঙ্গবন্ধু বন্ধ করেছিলেন। সেই নোট ট্রাঙ্ক ভরে এনে দেখিয়েছিল এসব পাওয়া গেছে ওই বাড়িতে। কিন্তু বাংলার মানুষ এসব বিশ্বাস করেনি। কারণ, দেশকে কে কতটুকু দিয়েছে তা মানুষ জানে। তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে চরিত্র তৈরি করে সত্য চাপা দেয়া যায় না। আমাদের বিজয়ের ইতিহাস কয়েক প্রজন্ম জানতেই পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে ৭ মার্চের ভাষণ তারা শুনতে পেয়েছে। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু বাংলার মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র আর কোনদিন সফল হবে না। শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পাইনি। বরং খুনীদের ইনডেমনিটি দিয়ে রক্ষা, মদদদান ও পুরস্কৃত করার ঘটনা দেশবাসী দেখেছে দীর্ঘ ২১টি বছর ধরে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয় এই জিয়াউর রহমান। জেনারেল এরশাদও বঙ্গবন্ধুর খুনীকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। আর জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনী কর্নেল রশিদ ও হুদাকে এমপি করে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছিলেন। এভাবেই হত্যার ষড়যন্ত্র ও খুনীদের মদদ দিয়েছে তারা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আরও বলেন, হাইকোর্টের রায়ে জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সময় পরাজিত শক্তির দোসররা বার বার আঘাত হেনেছে। এখনও তাদের উত্তরাধিকারীরাই বার বার আঘাত করছে। তিনি বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সাজার রায় কার্যকর করা হয়েছে। আমরা যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার শুরু করেছি, রায়ও কার্যকরের মাধ্যমে দেশ অভিশাপমুক্ত হচ্ছে। তবে এদের প্রেতাত্মা ও ঘনিষ্টরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। খুনী-সন্ত্রাসীদের নিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। এসব পরাজিত শক্তিই সম্প্রতি এসব খুনখারাবি করছে। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের সেই হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই যতই ষড়যন্ত্র করুক, তারা পরাজিত হবেই। আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা বলেন, কী অপরাধ ছিল আমার মা ও ছোট ভাই শিশু রাসেলের? যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, বাঙালীর বিজয় মেনে নিতে পারেনি; তারাই কিছু আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় ১৫ আগস্ট আমার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। কখনও কল্পনাও করতে পারিনি আমরা দুই বোন সবহারা হয়ে যাব। তিনি বলেন, বাংলার শোষিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন বাঙালী জাতি। এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি তারা, এতে সমর্থন দিয়েছিল তাদেরই কিছু দোসর। তারাই বাংলার মানুষের কাছ থেকে জাতির পিতাকে কেড়ে নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে যাওয়ার আগে শেখ রাসেল আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। নিয়ে গেলে তাকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাউকে জীবিত না রাখতে ঘাতকরা একযোগে তিন বাড়িতে আক্রমণ করে আমাদের পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করে। সবাইকে রেখে গেলাম, কিন্তু ফিরে এসে কারোর মুখটুকুও আমরা দু’বোন দেখতে পারলাম না। দেশে এসে পরিবারের কাউকে না পেলেও দেশের লাখো-কোটি মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, তাদের কাছ থেকেই আমি আমার বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম একটাই লক্ষ্য নিয়ে, তা হচ্ছে দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের উন্নত জীবন দিতে। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ নিয়েই আমি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দিতে আমি আমার জীবনকে উৎসর্গ করেছি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই। এ ব্যাপারে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবই, ইনশাল্লাহ!
×