ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাদক অস্ত্র ও বিস্ফোরক ॥ ট্রানজিট রুট চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২ আগস্ট ২০১৬

মাদক অস্ত্র ও বিস্ফোরক ॥ ট্রানজিট রুট চট্টগ্রাম

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলার সুবাদে চট্টগ্রাম অস্ত্র ও সব ধরনের মাদক ও নিষিদ্ধ পণ্যের ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে। এর পাশাপাশি দুই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারত থেকেও সীমান্ত পথে এসব পণ্যের চালান আসছে দীর্ঘ সময় থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, মিয়ানমার থেকে মাদক ইয়াবাসহ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক যেমন এসে থাকে, তেমনি ভারত থেকেও ভারি অস্ত্রের চালান আসার ঘটনাও রয়েছে। চট্টগ্রাম সিইউএফএল জেটিঘাটে দুই ট্রলার বোঝাই ভারি অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার ঘটনা তা প্রমাণ করে। অস্ত্রের চালান মহেশখালী কক্সবাজারের চৌফলদ-ির উপকূল দিয়েও আসার পর ধরা পড়ার ঘটনা রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা দিয়ে দুই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে দেশীয় সন্ত্রাসী চক্রের অস্ত্র ও মাদক নিয়ে ব্যবসা চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে হেরোইনের কাঁচামাল কফি চাষে পাহাড়ীদের উদ্বুদ্ধ করে থাকে আন্তর্জাতিক চোরাচালানী চক্র। প্রতিবছর নবেম্বর থেকে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসব কফি বাগান ধ্বংস করে থাকে। সীমান্ত গলিয়ে ভারিসহ ছোট আকারের বিভিন্ন অস্ত্র যে হারে এসে থাকে সে পরিমাণ ধরা পড়ে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে তা এ দু’দেশের সীমান্ত পথ দিয়েই এসে থাকে। বর্তমানে দেশে যে জঙ্গী তৎপরতার উদ্বেগজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে তার নেপথ্যেও রয়েছে এ দু’দেশ থেকে আসা অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক দ্রব্যাদির ছোট, মাাঝারি ও বড় আকারের চালান। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশে জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে পাওয়ারজেল, উচ্চ ক্ষমতার ফসফরাস, গন্ধক সালফার ও ডেটোনেটর এনে থাকে। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় স্পিøন্টার। এসব সামগ্রী দিয়ে এরা ঘরে বসে বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক বানাচ্ছে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেছেন, বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহৃত নানা জাতের কেমিক্যাল বিস্ফোরক তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে আসছে বছরের পর বছর। লাখ লাখ টন পণ্য সামগ্রী আসছে। অধিকাংশ পণ্য এসে থাকে কন্টেনারযোগে। এসব কন্টেনারের মধ্যে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসার ঘটনা অহরহ। এসব ঘটনার ফাঁকফোকরে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান যে আসছে না তা হলফ করে বলা যাবে না। এ বন্দরে সর্বশেষ ধরা পড়েছে কোকেনের একটি বড় চালান। এর আগে অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার ঘটনা রয়েছে। এ সমস্ত অবৈধ, নিষিদ্ধ পণ্য চিহ্নিত করতে প্রতিনিয়ত উন্নততর প্রযুক্তি যুক্ত করা হচ্ছে খালাস কার্যক্রমে। কিন্তু এরপরও আন্তর্জাতিক চোরাচালানী চক্রের সদস্যরা এতই পারদর্শী যে এরা শুল্ক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের তদারকিকে ফাঁকি দিয়ে এ জাতীয় পণ্য ভিন্ন নামে খালাস করে নিতে সক্ষম হয়। চট্টগ্রাম বন্দর যেমন এসব নিষিদ্ধ পণ্যের ট্রানজিট রুট তেমনি দেশের এক দশমাংশ এলাকা অর্থাৎ তিন পার্বত্য জেলার সীমান্ত পথও চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায়ী চক্রের রুটে পরিণত হয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তৃতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে তৎপর হয়েছে। জঙ্গীদের অনেকে ধরা পড়েছে, অনেকে আত্মগোপনে রয়েছে। এসব জঙ্গী দেশে-বিদেশে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। দেশে বসে এদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয় বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ব্যক্তিরা। শুধু তাই নয়, এরা বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গেড়ে বোমাসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকও তৈরি করছে। এসব বিস্ফোরক তৈরির দ্রব্যাদি দেশে উৎপন্ন হয় না, আসে বিদেশ থেকে। যা সাধারণত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকেই অধিকহারে এদের কাছে পৌঁছে যায়। এছাড়া মিয়ানমারে যেমন রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী বেশ কয়েকটি গ্রুপ, তেমনি ভারতের পূর্বাঞ্চলেও রয়েছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা। এদের হাত ঘুরেই দেশীয় সন্ত্রাসী ও জঙ্গীপনায় জড়িতরা এসব অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্যাদি পেয়ে যায়। এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যের বিপরীতে অর্থের যোগানও চলে দেশ ও বিদেশী রুটে আসা অর্থে। ইতোমধ্যেই গ্রেফতারকৃত বিভিন্ন জঙ্গীদের কাছ থেকে গোয়েন্দারা যেসব তথ্য পেয়েছে তারপর থেকেই দেশজুড়ে সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কড়া তদারকি ব্যবস্থা বলবৎ করা হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারী অফিস-আদালত, বড় বড় মিল কারখানা বা স্থাপনা এখন কড়া নিরাপত্তার অধীনে। ইতোমধ্যেই সরকারের কঠোর তদারকি ব্যবস্থায় জঙ্গীদের সন্ত্রাসী তৎপরতা থমকে রয়েছে। তবে নির্মূল হয়নি। সূত্রমতে, এদের নির্মূল করতে গ্রেফতারের পাশাপাশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসার রুটও কঠোর তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চল থেকে বিভিন্ন পথে ভারি ও ছোট আকারের অস্ত্র এবং বিস্ফোরক আসার ক্ষেত্রে নজরদারি আরও বৃদ্ধির প্রয়োজন বলে গোয়েন্দাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রসমূহের ধারণা।
×