ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাউলদের ওপর হামলা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২ আগস্ট ২০১৬

বাউলদের ওপর হামলা

নির্বিরোধী ও নিরীহ বাউলদের ওপর আবারও হামলার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাতে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার গোবিন্দপুরে বাউলদের একটি আখড়ায় পেট্রোল ঢেলে দুটি ঘর ভস্মীভূত করে দিয়েছে কতিপয় দুর্বৃত্ত। তারা নারীসহ তিন বাউলকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করে এবং চুল কেটে দেয়। দুর্বৃত্তরা ঘরের যাবতীয় আসবাব, ধর্মীয় বইপত্র ও বাদ্যযন্ত্রাদি জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলে। যাওয়ার আগে এই মর্মে হুমকি দিয়ে যায় যে, ১০ দিনের মধ্যে এলাকাছাড়া না হলে আখড়া বোমায় উড়িয়ে দেয়াসহ তাদের সবাইকে ছুরিকাঘাতে, গলা কেটে হত্যা করা হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক লাখ টাকা। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, আখড়ার মালিক ৬৫ বছর বয়সী জুলমত শাহ ছয় বছর আগে গোবিন্দপুর গ্রামে তিন বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলেন আখড়াটি। তিনি সেখানে পরিবার ও সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। ঘটনার দিন গুরুভাই প্রতাপপুরের রিনপদ হালদার তার সঙ্গে ছিলেন। তিনিও রক্ষা পাননি দুর্বৃত্তদের হামলা থেকে। চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ মামলা সাপেক্ষে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাটি যেহেতু ঘটেছে রাতের বেলায় সেহেতু এসব দুর্বৃত্তের পরিচয় জানা যায়নি। তবে পুলিশ যদি দ্রুত তৎপর হয় এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে বাউলদের অন্তত একটা সান্ত¡নার জায়গা থাকে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ১৬ জুলাই রাতে জীবননগর উপজেলার একতারপুরে বাউল আখড়ায় আকস্মিক হামলা চালিয়ে তিন বাউলকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এর বাইরেও মুন্সীগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানেও আখড়াসহ বাউলদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনাও আছে, যেখানে মেলা উপলক্ষে সমবেত বাউলদের জোরপূর্বক চুল-দাড়ি কেটে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনাসহ প্রতিবাদ, বিক্ষোভও হয়েছে সে সময়ে। বাউলরা সহজিয়া মতের অনুসারী। তাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সবাই আছেন ও থাকতে পারেন। তারা নিজ নিজ ধর্ম ও আচার-আচরণের পাশাপাশি সহজ-সরল সুর ও কথায় গানবাজনার মাধ্যমে সর্বশক্তিমানের আরাধনা তথা সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের সাধনায় নিরত থাকেন। বাউলমতের অনুসারীদের সঙ্গে কোন ধর্মমতের আদৌ কোন বিরোধ নেই। সুমহান সৃষ্টিকর্তার পাশাপাশি তারা মানবধর্মকেও শ্রেষ্ঠ মনে করেন। বলা হয় ফকির লালন শাহ এই ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক। বাউল গান এবং এর সুর সর্বদাই মানবধর্ম ও মানবাত্মার মুক্তির গান গায় এবং দেহ থেকে দেহাতীতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানায় মানবসমাজকে। মনে রাখতে হবে, এদেশের এক কবি ঘোষণা করেছেন বিনম্র কণ্ঠে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ তারা প্রেমভাবে মত্ত হয়ে দেহ থেকে দেহাতীত উর্ধলোকে উঠে ঈশ্বরে বিলীন হওয়ার কথা বলে থাকেন সর্বদাই। সর্বোপরি বাউল, বৈষ্ণব ও সহজিয়া মতের অনুসারীরা নিতান্তই নিরীহ ও নির্বিরোধী। এদিক থেকে ইরান-তুরস্ক-ইরাক-সিরিয়ার সুফীবাদের সঙ্গে বাউলধর্মের সবিশেষ মিল লক্ষণীয়। পূর্বাপর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিরীহ, শান্ত বাউল সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার আপাত কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অবস্থাদৃষ্টে ঘটনা পরম্পরায় প্রতীয়মান হয় যে, গত ক’বছরে দেশে মৌলবাদী ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে বাউলদের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। সর্বস্তরের মানুষ একে স্বাগত জানিয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশের পাড়া ও মহল্লায় সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা প্রতিরোধে কাজ চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সর্বস্তরের মানুষের গণপ্রতিরোধই পারে দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ নির্মূল করতে। দামুড়হুদার গোবিন্দপুরে বাউল আখড়ায় হামলার জন্য দায়ী দুর্বৃত্তদের পুলিশ খুব দ্রুতই ধরতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই হামলার সঙ্গে জঙ্গী কানেকশন থাকাও বিচিত্র নয়। সেক্ষেত্রে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের হাতে সোপর্দ করা বাঞ্ছনীয়।
×