ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

টনি ব্লেয়ারের ক্ষমা প্রার্থনা ॥ ইরাক আক্রমণের ভুলে আইএসের উত্থান

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২ আগস্ট ২০১৬

টনি ব্লেয়ারের ক্ষমা প্রার্থনা ॥ ইরাক আক্রমণের ভুলে আইএসের উত্থান

গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইরাক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। ইরাক যুদ্ধের কারণেই আইএসের উত্থান হয়েছে এমন দাবিতে সত্যতা থাকার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। সিএনএন ইউরোপে একটি অনুষ্ঠানে এসে এসব কথা বলেন টনি ব্লেয়ার। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ইরাকে হামলা চালানোর পেছনে যে শুধু মিথ্যা তথ্যের ওপর ভরসা করা হয়েছিল তাই নয়, অভিযান এবং ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের ফল কী হতে পারে তা আগে থেকে বিচার-বিবেচনা না করেই অভিযান চালানো হয়। ইরাক সম্পর্কে আমরা যেসব গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলাম সেগুলো ভুল ছিল। এজন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। সিএনএনকে ব্লেয়ার বলেন, আমি এজন্যও ক্ষমাপ্রার্থী, কারণ আমাদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। আমরা ভেবে দেখিনি সাদ্দাম শাসনামলের পতন হলে কী ঘটতে পারে। সাক্ষাতকারে জঙ্গি সংগঠন আইএসের উত্থান সম্পর্কে ব্লেয়ার বলেন, আপনি কখনই বলতে পারবেন না আমরা যারা ২০০৩ সালে সাদ্দামকে সরিয়েছি তারা ২০১৫তে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কোনভাবেই দায়ী নই। যারা দাবি করে ইরাক যুদ্ধ আইএসের জন্মের জন্য দায়ী, তারা কিছুটা হলেও সঠিক। ব্লেয়ার এর আগে গত ১২ বছর অসংখ্যবার ইরাক যুদ্ধ সঠিক ছিল বলে মন্তব্য করেন। সাক্ষাতকারে নিজের দায় স্বীকার করে অনুশোচনা করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমেরিকার একটি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, সাদ্দাম পরবর্তী যথোপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থতা এবং গোয়েন্দাদের দেয়া ভুল এবং অসত্য তথ্যের কারণে সাদ্দামের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ইরাক যুদ্ধ তথাকথিত ইসলামিক স্টেট উদ্ভাবনের মূল কারণ কিনা তা সাক্ষাতকার গ্রহণকারী ফরীদ জাকারিয়া ব্লেয়ারের কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, অবশ্য আপনি তা বলতে পারেন। কেননা এর মাঝে অবশ্যই সত্যতা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ দুঃখ প্রকাশ করা বা মাফ চেয়ে নেয়া সহজ ব্যাপার। কিন্তু টনি ব্লেয়ার এবং জংলী বুশের কারণে যে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমগ্র বিশ্বেই আজ ইসলামী জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে তার জন্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকেই মূল্য দিতে হচ্ছে। তথাকথিত মানবতাবাদীরা মিথ্যা অজুহাত তৈরি করে সাদ্দামকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে। আজকে হয়ত টনি ব্লেয়ার বা বুশ ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যাতে পারে কিন্তু সাদ্দামকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি? অথবা সমগ্র বিশ্বে যে জঙ্গীবাদকে ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিষিয়ে তোলা হয়েছে তার জন্য কি ইরাক যুদ্ধের কুশীলবদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না? এছাড়া মার্কিন নেতৃত্বে হওয়া অপারেশন ইরাকী ফ্রিডমের পরিকল্পনাতেও ভুল ছিল বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ব্লেয়ার। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া মার্কিন সরকারের এক গোপন নথিতে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যা অনেকটা বোমা বিস্ফোরণের মতো। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে পররাষ্ট্র সচিব কলিন পাওয়েলের পাঠানো ওই আনুষ্ঠানিক চিঠিতে উঠে এসেছে ইরাক যুদ্ধবিষয়ক অনেক জানা-অজানা পরিকল্পনার তথ্য। চিঠিতে ইরাক নিয়ে বুশ এবং ব্লেয়ারের পরিকল্পনার কথা লেখা আছে। চিঠির বক্তব্য থেকে দেখা যায়, মুখে সবসময় শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমাধানের কথা বললেও আসলে ইরাকে যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগেই বুশ এবং ব্লেয়ার ইরাকে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্লেয়ার সে সময় বার বার ভোটারদের বলেছিলেন, ‘আমরা ইরাকে কোন রকম সামরিক তৎপরতা প্রস্তাব করি না।’ প্রকাশিত গোপন চিঠিটা কিন্তু তার ঠিক উল্টোটাই বলছে। ২০০২ সালে টেক্সাসের ক্রফোর্ডে জর্জ বুশ এবং টনি ব্লেয়ারের মধ্যে এক সম্মেলন হয়, যেখানে এ দুজন ইরাকে হামলা চালানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। সেই প্রসঙ্গেই সম্মেলনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২৮ মার্চ কলিন পাওয়েল চিঠিতে বুশকে নিশ্চিত করেন ইরাক বিষয়ে যে কোন সামরিক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাজ্য আমাদের সঙ্গে থাকবে। শুধু তাই নয়, গোপন ওই ডকুমেন্টে আরও বলা হয়, ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এমন খবর প্রচারে প্রেসিডেন্ট বুশের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কাজ করবেন ব্লেয়ার, যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বলতে প্রকৃতপক্ষে সাদ্দামের কাছে কিছু ছিল না। কথা ছিল ব্লেয়ারের এই সহায়তার বিনিময়ে বুশ তার ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব নেবেন। পরিস্থিতিকে এমনভাবে তুলে ধরবেন যেন সবাই মনে করে ব্রিটেন আমেরিকার পোষা কুকুর নয়। দুটি দেশের মধ্যে একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে যেখানে দুটি দেশই সমান। ওই ডকুমেন্টের আরেকটি চিঠি থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে ব্রিটিশ জনমত প্রভাবিত করার জন্য বুশ যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টিতে গুপ্তচর নিযুক্ত করেছিলেন। আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভারের সব ই-মেইল প্রকাশ করার জন্য আদালতের দেয়া নির্দেশের প্রেক্ষিতে এই ডকুমেন্টগুলো প্রকাশ হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হিলারি ডকুমেন্টগুলো চেয়েছিলেন। এদিকে বিশ্ববাসী অবলোকন করল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ মার্কিন পতাকাবৃত কফিন বহন করে। ব্রিটেনের লন্ডন ও গ্লাসগোতেও হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও গাজা অবরোধ তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। এছাড়া, তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিচার দাবি করেছে। এছাড়া, স্পেনের বিভিন্ন শহরেও ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। ইরাক যুদ্ধের খেসারত দিতে হতে পারে টনি ব্লেয়ারকে। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করায় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে ব্লেয়ারকে। ইতোমধ্যেই ব্লেয়ারকে আলাদতের মুখোমুখি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আইনজীবীরা। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে ২০০৯ সালে চিলকোট কমিশন গঠিত হয়। ছয় বছর ধরে যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে তারা। গত বছর এক বিবৃতিতে স্যার জন চিলকোট জানিয়েছিলেন, চিলকোট প্রতিবেদন প্রকাশ করতে আরও এক বছর সময় লাগবে। এক বছরের মধ্যেই ওই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন বলেও জানান তিনি। ইরাক যুদ্ধের দীর্ঘ ১৩ বছর পর বহু প্রতীক্ষিত ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে চিলকোট বলেন, গোয়েন্দাদের তথ্যে সাদ্দামের জীবাণু অস্ত্র উৎপাদন অব্যাহত রাখার কোন প্রমাণ মেলেনি। ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র বিশ্বকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে দেশটিকে আক্রমণ করা হয়েছিল। খুব জোর দিয়ে বলা হলেও সেই তথ্যেরও কোন প্রমাণ মেলেনি। তাই যারা এই যুদ্ধকে সমর্থন করেছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি অবশ্যই হতে হবে। ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ করা হয়েছিল তা ছিল ভুল। ওই আক্রমণই ইসলামিক স্টেট জঙ্গীগোষ্ঠীর উত্থানের পথ করে দিয়েছে বলেও স্বীকার করেন ব্লেয়ার। এ কারণেই যে ইরাকে আজ আইএসের উত্থান সেটি স্বীকার করেছেন তিনি। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সহযোগী ব্লেয়ার এসব কথা বলেন। সাক্ষাতকারটি এখনও প্রচার করা হয়নি। ব্লেয়ার বলেছেন, ‘আমরা যারা সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করেছি, ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তাদের কমবেশি দায় নিতে হবে।’ তবে পাশাপাশি টনি ব্লেয়ার এ কথাও বলেছেন যে, সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত না করলে ইরাকের তখনকার অবস্থা হতো আজকের সিরিয়ার মতো। অর্থাৎ দেশটিতে গৃহযুদ্ধ লেগে যেত। শেষ পর্যন্ত ব্লেয়ার মানলেন আইএস উত্থানের দায় পেরিয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। এখনও পিছু ছাড়ে না যুদ্ধাপরাধী তকমা। তবে সাদ্দাম হোসেনকে গদিচ্যুত করা নিয়ে যে তার কোন অনুশোচনা নেই, তাও স্পষ্ট করে দিলেন টনি। বিশ্বজুড়ে লাগাতার সমালোচনার মুখে পড়েও এতদিন ইরাক যুদ্ধের প্রশ্নে এক প্রকার অনড়ই থেকেছেন তিনি। কিন্তু এই প্রথম এক দশক আগের সেই যুদ্ধ নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন ব্রিটেনের এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। লং রোড টু হেল, আমেরিকা ইন ইরাক’ শীর্ষক এই সাক্ষাতকারে টনি বলেন, সাদ্দামের সরকারের হাতে গণহত্যার অস্ত্র রয়েছে বলে যে খবর গোয়েন্দা সূত্রে পেয়েছিলাম তা ভুল ছিল। যদিও সাদ্দাম অন্য রাষ্ট্র এবং নিজের লোকদের ওপরই রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। যেভাবে পরিস্থিতি বিচার করেছিলাম, বাস্তবে তেমনটা ছিল না। [email protected]
×