ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ॥ হিলারি-ট্রাম্প অপ্রিয় দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২ আগস্ট ২০১৬

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ॥ হিলারি-ট্রাম্প অপ্রিয় দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই

ফিলাডেলফিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কনভেনশনে হিলারি ক্লিনটন আনুষ্ঠানিকভাবে দলের মনোনয়ন গ্রহণের পরপরই শুরু হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্ব। এর পূর্ববর্তী সপ্তাহে ওয়াহাইও রাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন গ্রহণ করেন নিউইয়র্ক ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। এক সময়ের পারিবারিক এই বন্ধুকে হিলারি ক্লিনটন আগামী নবেম্বর মাসে নির্বাচন লড়াইয়ে মোকাবেলা করবেন শত্রু হিসেবে । যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন ইলেকশন চিত্রটি অতীতের অন্যান্য নির্বাচন থেকে নানাদিক দিয়েই পৃথক বৈশিষ্ট্যের। এর মধ্যে অন্যতম দ্রষ্টব্য বিষয় হলো সম্প্রতি দুই প্রার্থীর জনপ্রিয়তা নিয়ে গৃহীত সমীক্ষাসমূহ। এতে যেসব চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে ধারণা করা যায় ডোনাল্ড ও হিলারি উভয় প্রার্থীই দেশের একটি বৃহৎ অংশের ভোটারদের মধ্যে আগাপাছতলা অজনপ্রিয় । বিশেষত আমেরিকার বিশাল তরুণ প্রজন্মটি শাসক হিসেবে তাদের দু’জনের মধ্যে কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এতো বিপুলসংখ্যক নাগরিকের চিন্তা-চেতনায় অপছন্দনীয় এরকম দুই প্রার্থীকে ইতোপূর্বে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু দু’দল থেকে দলীয় মনোনয়ন সমাপ্তির পর এরকম পছন্দ অপছন্দে আটকে থাকবে না প্রেসিডেনসিয়াল ইলেকশন পর্ব। তাছাড়া দেশের মিলিয়নস মিলিয়নস সমর্থকও তো উভয় প্রার্থীকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন তারা ভোটও দেবেন নিঃসন্দেহে পছন্দের প্রার্থীকে । এরপর যুদ্ধ শেষে বাহির দুয়ারে অপেক্ষা করা বিজয় রথ এদের একজনকেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অভিষিক্ত করবে দুনিয়ার এক মাত্র সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির সিংহাসনে। ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু ওয়াশিংটন ডিসির শ্বেতবর্ণ বাড়ির ওভাল অফিস থেকে তিনি শাসন করবেন গণতান্ত্রিক আমেরিকা ও নেতৃত্ব দেবেন বাকি বিশ্বকে। দেশ-বিদেশের মানুষ সাগ্রহে এবারও লক্ষ্য করল রাষ্ট্রপতি পদে সর্বপ্রথম একজন নারীকে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনে মনোনয়ন দিয়ে দু’হাজার ষোলো সালে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি (ডিএনসি) পুনর্বার সূচনা করল এক নব ইতিহাসের। এখানে উল্লেখ্য, ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যখন প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ শুরু হয় তখন কোন নারীর প্রার্থী হওয়া তো দূরের কথা এর দু’শ’ বছরের অধিক সময় পর্যন্ত অর্জন করেনি ভোট দেবার অধিকার। জাতীয়ভাবে নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করে ১৯২০ সালে। ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রায় আট বছর আগেও এরকম কনভেনশনেই আর একটি ইতিহাস গড়েছিল একজন কৃষাঙ্গ মানুষকে দেশের সর্বোচ্চ পদে মনোনয়ন দিয়ে। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত আমেরিকায় বারাক ওবামার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হবার বিষয়টি প্রথম দিকে ছিল কল্পনাতীত। এমনতর ধারাবাহিকতায় নারী হিসেবে হিলারির মনোনয়ন শুধু দলের সমর্থকদেরই আলোড়িত ও উৎসাহিত করেনি, করেছে আমেরিকান নারী সমাজকেও। ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে উজ্জ্বলতম তারকা ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা আবেগাপ্লুতকণ্ঠে তাই ঘোষণা করেছেন যে, তার দুই সৌন্দর্যময়ী কন্যা যারা হোয়াইট হাউস লনে এখনও কুকুর নিয়ে খেলাধুলা করে সেই দু’জন এবং তাদের মতো সকল বালিকা এখন থেকে আশা করতে পারবে ভবিষ্যতে তাদের পক্ষেও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়া সম্ভব। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনের (আরএনসি) সঙ্গে ডেমোক্রেট দলের এই কনভেনশনের মধ্যে একটি পার্থক্য ছিল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মতো। আর এনসিতে দলের রাজনৈতিক তারকারা যেখানে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বয়কট করে গেছেন ডোনাল্ডকে, সেখানে শুধু রাজনৈতিক ময়দানের নয় দেশ ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল তারকাসম মানুষেরা হিলারিকে সমর্থন করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছেন ফিলির ডিএনসিতে। এমনকি মনোনয়ন যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্সই ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রথম রাতে এন্ডোর্স করলেন হিলারির প্রেসিডেন্ট মনোনয়নটিকে। অথচ সেদিনই উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে স্যান্ডার্সের বিরুদ্ধে করা পার্টি প্রধানের অসংখ্য ষড়যন্ত্রমূলক ই-মেইল। ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারপার্সন ডেবি শুলজ বার্নি সমর্থক ডেলিগেটদের রোষের মুখে পদত্যাগ করেছেন। ভেতরে-বাইরে এসব অনুসারী ডেলিগেট যাদের সংখ্যা ৪০ শতাংশ তারা ফুঁসে উঠে রিপাবলিকান কনভেনশনের অনুকরণে প্রথম দিন সেøাগান তুলেছিল ‘লক হার আপ’। তাদের সামলাতে বার্নিকে ভাষণ ছাড়াও দিনভর পাঠাতে হয়েছে টেক্সট মেসেজ। এমন কঠিন সময়েও আশ্চর্য অটলতায় বার্নি স্যান্ডার্স করে গেলেন তার করণীয় কর্তব্য। সমর্থকদের ভেঙ্গে পড়া কান্নার মাঝে এন্ডোর্স করলেন হিলারিকে। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে ও অশ্রুসিক্ত নয়নে সমর্থকদের উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য তিনি আওড়ালেন ‘নির্বাচনের দিন আসে, দিনও চলে যায়; কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বিপ্লবকাল অশেষ হয়ে পরিব্যাপ্ত থাকে সারাটা সময়।’ বার্নি স্যান্ডার্স কনভেনশনের আগেই হিলারির সঙ্গে এক সমঝোতা বৈঠকে বছরে এক লাখ ২০ হাজার ডলার যাদের আয় তাদের সন্তানদের ফ্রি কলেজ শিক্ষা, সকলের জন্য সুলভ স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির মতো নিজ এজেন্ডার অনেক শর্ত বাস্তবায়নে হিলারির প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে মনোনয়ন গ্রহণ করার পর এখন হিলারির অন্যতম প্রধান কাজ হবে সেসব তরুণ ভোটারকে সাফল্যের সঙ্গে ক্যাম্পেইনে সম্পৃক্ত করা যারা প্রাইমারিতে বার্নির ১৩ মিলিয়ন ভোটের অধিকাংশের মালিক। কনভেনশনের সমাপ্তি রজনীতে দলের মনোনয়ন গ্রহণে স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত উৎফুল্ল ছিলেন হিলারি। সে রাতের ভাষণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের যোগ্যতাগুলো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। অর্থনীতি, ইমিগ্রেশন, সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, গান কন্ট্রোল, সোশ্যাল সিকিউরিটি, ওয়াল স্ট্রিট, ধর্ম, পারমাণবিক নীতিসহ নানা বিষয় উঠে আসে তার সাবলীল বক্তব্যে। কিন্তু তার ই-মেইল কেলেঙ্কারির বিষয়ে কোন কথা সেদিন উচ্চারণ করেননি তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ২২ বার উচ্চারণপূর্বক কঠোর সমালোচনা করে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি বলেছিলেন একটি অশুভ শক্তির মতলব পৃথিবী থেকে আমেরিকাকে আলাদা করে দ্বিখণ্ডিত করা। ট্রাম্পের মুসলিম-নীতি প্রসঙ্গে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন আমরা কোন ধর্মকেই নিষিদ্ধ করব না, বরং সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করার জন্য আমেরিকার সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হবে আমাদের লড়াই। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হিলারি সবাইকে জানালেন তিনি প্রেসিডেন্ট হতে চান আমেরিকার সকল মানুষের। হিলারি আরও স্মরণ করিয়ে দিলেন নির্বাচনী বিতর্কগুলোর সময় ডোনাল্ডের সংযম হারানোর কথা। প্রতিযোগীর কটু কথা শুনে ক্রোধোন্মত্ত হওয়া কোন ব্যক্তি সঙ্কটকালে কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে ওভাল অফিসে কি করতে পারেন সেই ছবিটার কথা হিলারি ভাবতে বললেন। সেইসঙ্গে তার প্রশ্ন ছিল যে ব্যক্তি টুইটারে টোপ ফেলতে পারে এমন কারও হাতে পরমাণু অস্ত্র ভা-ার তুলে দিয়ে কি বিশ্বাস করা যায়? এর ফলে বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। ডেমোক্রেটিক পার্টির গত দু’হাজার আট সালের মনোনয়ন নির্বাচনের ময়দানে যে প্রেসিডেন্ট ওবামা ছিলেন হিলারির রাজনৈতিক শত্রু তিনি এবারের কনভেনশনে এক আবেগঘন ভাষণে হিলারিকে জানিয়েছেন জোর সমর্থন। শুধু তাই নয়, সোচ্চার কণ্ঠের সেই সমর্থনের ভাষা ছিল এমনটাই যে, ইতোপূর্বে হিলারির মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কোন পুরুষ বা নারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হননি। এমনকি বারাক ওবামা নিজে কিংবা বিল ক্লিনটন পর্যন্ত সেই পর্যায়ে যেতে পারেননি। রিপাবলিকান কনভেনশনকে ইঙ্গিত করে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আরএনসির কথাবার্তাকে হতাশাব্যঞ্জক ছাড়া আর কিছু বলে অভিহিত করা যায় না। কারণ ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং ক্রোধে পুঞ্জীভূত এমন আমেরিকাকে মানুষ চেনে না। তিনি আরও বলেন, আমেরিকা সবসময়ই গ্রেট কান্ট্রি- নতুন করে সে দেশকে গ্রেট বানানোর জন্য ট্রাম্পের কিছুই করণীয় নেই। কনভেনশনের দ্বিতীয় দিনে সবাই শুনলেন এক মজার গল্প। ১৯৭১ সালের বসন্তে এক তরুণের দেখা হয়েছিল ক্লাসের অনন্য স্বর্ণকেশী বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার এক অপরিচিত সহপাঠিনীর সঙ্গে। ক্লাস শেষে প্রসাধনবিহীন মুখশ্রীর সেই মেয়ে তরুণ ছাত্রটিকে যেন পিছু পিছু টেনে নিয়ে গেল চুম্বকের মতো। ধরাছোঁয়ার দূরত্বে হাঁটতে হাঁটতে সে অনুসরণ করতে লাগল অচেনাকে। অনেক দিন ধরে এভাবেই পিছু নেয়া আর তাকিয়ে দেখার মাঝে একদিন লাইব্রেরিতে ঘটে গেল এক কা-। নাছোড় প্রেমিককে দূর থেকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি বই বন্ধ করে ও মাথা থেকে এ মাথায় হেঁটে এসে বললÑ এভাবে যদি কেউ তারকা দেখার মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে তবে তো আমাদের পরস্পরের নামটি জানা প্রয়োজন। আমি হিলারি রডহ্যাম, তোমার নাম কী? প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন এভাবেই সম্মেলনে তাদের অনবদ্য প্রেম, দাম্পত্য ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে। হাস্যোজ্জ্ব্ল গর্বিত মুখে সেটি শ্রবণ করছিলেন উপস্থিত ডেলিগেটস ও সমর্থকদের মধ্যে বসে তাদের কন্যা চেলসিয়া। পরের দিন ক্লিনটন দম্পতির একমাত্র সন্তানটিও মনোগ্রাহী বক্তব্য রেখেছিলেন তার মা সম্পর্কে। পেনসেলভানিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় ২৫ থেকে ২৮ জুলাই অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী কনভেনশনে আরও বক্তব্য রেখেছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, হিলারির রানিংমেট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ভার্জিনিয়া সিনেটর টম কেইন, নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র ধনকুবের মাইকেল ব্লুম বার্গসহ দলীয় গবর্নর, সিনেটর, কংগ্রেসম্যান এবং শো বিজনেসের নামী-দামী তারকারা। বক্তারা সকলেই ট্রাম্পের নীতির তীব্র সমালোচনা করে অভিজ্ঞ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সিনেটর, ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনের মতো যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানান। অবশ্য ডিএনসি শেষ হবার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা তোপ দেগে হিলারিকেই সংযমহীন হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তার অভিযোগ হিলারি ক্লিনটনের নিকৃষ্ট বিচারবোধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলছে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের প্রলয় কা- এবং সারা দুনিয়া তছনছ করছে আইসিস। হিলারিও জবাব দিয়ে যাচ্ছেন এসব অভিযোগের। নবেম্বর মাসের নির্বাচন পর্যন্ত এভাবেই পরস্পরের বিরুদ্ধে চলবে নানা অভিযোগ চাপানউতরের পালা। আগামী ৮ নবেম্বর নির্বাচনের আগে আটলান্টিকে ভাংবে ঢেউয়ের পর ঢেউ। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×