ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারের এ মুহূর্তের নীরব যত ভবন

জঘন্য জেলহত্যা, অন্যদিকে রাজবন্দীর স্মৃতি জড়ানো ২২৮ বছরের সাক্ষী

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১ আগস্ট ২০১৬

জঘন্য জেলহত্যা, অন্যদিকে রাজবন্দীর স্মৃতি জড়ানো ২২৮ বছরের সাক্ষী

মশিউর রহমান খান ॥ মোগল আমল থেকে শুরু করে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের শাসক বা রাষ্ট্রনায়কের শোষণ আর শাসনের জন্য করা অত্যাচার, আবার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম সাক্ষী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। দেশের অন্যতম এ প্রাচীন স্থাপনার ইতিহাস নানান ঘটনায় পরিপূর্ণ। সৃষ্টির প্রায় ২শ’২৮ বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অন্যতম সাক্ষী রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের এ কারাগারটি। একসময় এ কারাগারের নাম শুনলেই অনেকেই ভয়ে আঁতকে উঠত। আবার দলে দলে দেশপ্রেমিকরা গিয়েছেন এই জেলে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার এ কারাগারটি রাজধানীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের তেঘরিয়ায় স্থানান্তরে মধ্য দিয়ে যার পরিসমাপ্তি ঘটে। বন্দীশূন্য হয় অভিশপ্ত এ স্থানটি। লাখ লাাখ বন্দীও নানা স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে দেশের জঘন্য সব ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত নাজিমউদ্দীন রোডের এ কারাগারটি। দীর্ঘ ২২৮ বছর আগে তৈরির পর মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশের বহু আন্দোলন, সংগ্রাম, জুলুম ও নির্যাতনের ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর এলাকার তেঘরিয়ায় এলাকায় নতুন কারাগারে বন্দী স্থানান্তরের মাধ্যমে দেশের প্রথম ও প্রাচীন এ কারাগারটির সৃষ্টির ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। তৈরির পর দীর্ঘ সোয়া দুইশ’ বছরেও এ কারাগারের মূল ফটকে কখনও তালা ঝুলেনি। কারাগারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বন্দীকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই নিñিদ্র নিরাপত্তা প্রদান আর বন্দীদের পদচারণায় মুখর ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। সেই সময় থেকেই এ কারাগারটিকে ঘিরেই আশপাশে গড়ে উঠে ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র। এটি শুধু কারাগারই নয় রাজধানী ঢাকা তথা দেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রথম কারাগারটি দেশের অন্যতম প্রচীন নিদর্শন। মোগল আমল, পাকিস্তান আমল আর বাংলাদেশ সৃষ্টির নানা আন্দোলন সংগ্রাম, জুলুম বঞ্চনার অন্যতম সাক্ষী ও নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের এ কারাগারটির মূল ফটকে তালা ঝুলল শুক্রবার রাত সাড়ে দশটার দিকে। সকল বন্দীকে স্থানান্তরের পর কারাগার সৃষ্টির পর ২শ’ ২৮ বছরের ইতিহাসে কোনদিন তালা ঝুলতে দেখেনি কেউ। এর মাধ্যমে বন্দীশূন্য এ কারাগারের লোহার বিশাল কপাটটি আর কখনও বন্দী গ্রহণ আর মুক্তির জন্য খোলা হবে না। কারা কর্তৃপক্ষের মতে, এ স্থানটিকে প্রায় সোয়া দু’শ বছরের মধ্যে কেউ এমন নীরব হতে দেখেননি। দেশের সবচেয়ে পুরনো এ জেলখানার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের শাসক, বিদ্রোহী প্রজা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচারকারী যুদ্ধাপরাধীদের বন্দী করাসহ নানা ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী দেশের প্রথম কারাগারটি। কারা ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোগল সম্রাট শের-শাহ এর শাসন আমলে তৎকালীন শাসকের নির্দেশে ঢাকাকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ঢাকার লালবাগ মৌজায় (বর্তমান পুরান ঢাকা) তৈরি করা হয় আফগানদুর্গ। পরবর্তীতে মোগল শাসক বাংলার সুবেদার ইসলাম খান দুর্গটিকে সংস্কার করে এর এক অংশে অফিস এবং অপর অংশে সামরিক সদর দফতর স্থাপন করেন। অনেকেই এ আফগান দুর্গটিকে দেশের প্রথম টাকশাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পরবর্তীতে রাজকীয় অফিসটিতে প্রতিদিনের কার্যক্রম চালু রাখতে ও এর নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করতে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের থাকার জন্য পাশেই আবাসিক ভবন তৈরি করা হয়। যা মেঘনা ভবন নামে পরিচিত। ৩ তলা বিশিষ্ট মূল দুর্গটির একটি তলা বর্তমানে দৃশ্যমান নেই। ইতোমধ্যেই মাটির নিচে দেবে গিয়েছে। তবে সাক্ষী হিসেবে এ ভবনের নিচতলায় যেতে তৈরি করা সিঁড়িটি আজও দেখা যায়। সামরিক দফতরের পাশেই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ঘোড়া রাখার জন্য তৈরি করা হয় ঘোড়াশাল। এরপর সময় পরিক্রমায় গড়ে উঠে নিত্য নতুন অনেক ভবন। সব ভবন মিলে এটির নাম দেয়া হয় ঢাকা কারাগার। এটি দেশের প্রথম কারাগার। তৈরির প্রায় ১শ’ ৪১ বছর পর এটিকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেয় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জন্য তৈরি করা এ তিনতলা ভবনটিকে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল হিসেবেই ব্যবহার করা শুরু করে। বর্তমানে দৃশ্যমান ২ তলা ভবনটিতে বড় বড় ৫টি আর সামনের দিকে ছোট ২টি কক্ষ রয়েছে। এক সময় সেন্ট্রাল জেল নামটি বললেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে বোঝানো হতো। এ কারাগারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। মূলত রাষ্ট্রীয় নির্দেশ প্রতিপালনের অন্যতম স্থাপনা এ কারাগার। মোগল আমল থেকে শুরু করে দেশের প্রথম সারির রাষ্ট্রীয় নির্দেশ প্রতিপালনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রেলওয়ে, ডাক বিভাগের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হচ্ছে অন্যতম। যখন এ দেশে তেমন কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি তখনও বন্দীশালা হিসেবে এ কারাগার তৈরি করা হয়। আর এটিই হচ্ছে বাংলার প্রথম বন্দীখানা যার নাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারা সূত্র জানায়, ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ সরকার বাংলার মানুষকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি প্রদানের লক্ষ্যে রাজকীয় নির্দেশ অমান্যকারীদের ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারীদের আটকের মাধ্যমে শাসনের লক্ষ্যে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণ করেন। যেখানে তাদের বিচারে অপরাধী সাব্যস্তকারীদের রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এর মাধ্যমে মোগল আমলের তৈরি দুর্গটিকে সংস্কার করে দুর্গটিকে কারাগারে রূপান্তরিত করে এর কার্যক্রম শুরু করা হয়। দ্বিতল বিশিষ্ট এ ক্রিমিনাল ওয়ার্ডটিই সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা আজও বিদ্যমান। পরবর্তীতে ক্রিমিনাল ওয়ার্ড থেকে বেড়ে সাধারণ ও রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন আন্দোলনের নেতাদের জেলে পুরে দেয় তৎকালীন বাংলার সব শাসকগণ। এরপর পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালীদের এ কারাগারে রেখেই কঠোরভাবে দমন করত। প্রায় ৪০ একর জমির মধ্যে মূল কারাগারটি তৈরি করা হয় প্রায় ১৭ একর জমিতে। ২শ’ ৩৩টি কক্ষের ১২টি সেল আর কিছু স্থাপনা নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অবস্থিত। সর্বশেষ মূল ভবনটিতে ১শ’ ৭২ শয্যা বিশিষ্ট কারা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮১৮ সালে রাজবন্দীদের আটকার্থে বেঙ্গল বিধি জারি করে ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীতে চাহিদার প্রেক্ষিতে এর ঠিক ১৮ বছর পর ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সর্বপ্রথম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে এ কারাগারকে পুঁজি করেই কারা এলাকায় বাংলাদেশ জেলের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে পুরান ঢাকার কারা এলাকায়ই কারা সদর দফতর অবস্থিত। ১৯৩৬ সালে ঢাকাকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণার পর নতুন বেশ কয়েকটি ভবন তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত এসব ভবন লাল রং করায় এরপর থেকেই কারাগারকে ‘লাল দালান’ বলে সবার কাছে পরিচিতি পায়। কিছুদিন পূর্বেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রং লাল ছিল। যা বর্তমানে আর নেই। কারাসূত্রে জানা গেছে, অত্যচারের অংশ হিসেবে শোষকগণ তাদের মতাদর্শের বিরোধীদের বা বিভিন্ন সময়ের অপরাধীদের লাল দালানের অর্থাৎ কারাগারে পাঠানোর ভয় দেখানো হতো। লাল দালান সম্পর্কে অপর একটি সূত্র জানায়, মোগল আমলে শের শাহের তৈরি আফগান দুর্গটির রং লাল থাকায় পরবর্তীতে তৈরি করা সারাদেশের সকল কারাগারের রং লাল করতে নির্দেশ দেয়া হয়। অবশ্য বর্তমানের নতুন সকল কারাগারের ভবনে সাদা রং করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলের শেষ সময় পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পরে জীবনের প্রায় ২০ বছর কারাবরণ করেন। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় এ কারাগারেই কাটাতে হয়েছে। জানা গেছে, ভাষা আন্দোলনের কারণেই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। অনেকের মতে, এ থেকে শুরু করে কারা জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে এ কারাগারেই রাখা হতো বিধায় কারা কর্তৃপক্ষ তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সেলের নির্দিষ্ট স্থান ফাঁকা রাখতেন। কারা কর্তৃপক্ষও বেশ ভাল করেই জানতেন বঙ্গবন্ধরু দেহে যতদিন প্রাণ থাকবে বাংলাদেশের জন্য ততদিনই পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচারের স্টিমরোলারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন। আর আন্দোলনের শেষ পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তান জুলুমবাজ সরকার কর্তৃক আটক করে কারাগারে প্রেরণ। মূলত প্রায় সকল আন্দোলনের পরই বা কোন মিথ্যা মামলায় আটকের পরপরই তাকে এ কারাগারে প্রেরণ করা হবে বিধায় তৎকালীন কারাগারে কর্মরত দেশপ্রেমিক বাঙালীরা দেশপ্রেমিক নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্য কারাগারের ভেতরের নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করে রাখেন। আবার কারাভ্যন্তরে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রও কারা কর্তৃপক্ষ রেখে দিতে পরবর্তী সময়ে তার প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য। পরবর্তীতে এ কারাগারের ভেতরের বঙ্গবন্ধুর কারা জীবনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে কারাগারের ভেতর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কারা যাদুঘর উদ্বোধন করেন। ১৭৮৮ সালে ক্রিমিনাল ওয়ার্ড দিয়ে যাত্র শুরু হলেও চাহিদার প্রেক্ষিতে এর পরিসর বাড়তে থাকে। বাঙালীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কভু মাথা নোয়াবার নয় বিধায় মোঘল আমল থেকে শুরু করে ইংরেজদের কঠোর শাসনের রক্তচক্ষুকেই উপক্ষো করতেন না। পাকিস্তান আমলে হাজার হাজার দেশপ্রেমিককে অত্যাচারের অংশ হিসেবে এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে হয়েছে। দেশপ্রেমিক এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন যাদের কারাগারের ভেতরেই মৃত্যু হয়েছে। আবার অনেককে কারাফটক থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে গিয়ে আটক করে আবার এই কারাগারেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এমন উদাহারণও অনেক। স্বাধীনতার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় উর্দি পেশাকের শাসক থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত শাসকগণও তাদের মতবিরোধীদের দমাতে গিয়ে এ কারাগারেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের আটক রেখেছেন। এছাড়া এ কারাগারেই দীর্ঘ বছর আটক ছিলেন দ-িত একজন সাবেক স্বৈরশাসক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ কারাগারের অধীনে সর্বশেষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও কারাবরণ করেন। দেশ মাতৃকার অবদান রাখতে অনেক দেশপ্রেমিক আন্দোলন করে দিনের পর দিন বছরের পর বছর এ কারাগারেই থাকতে হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ইতিহাস অতি জঘন্য। কারাগারকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান মনে করা হয়। কিন্তু দেশের প্রথম এ কারাগারে কারাভ্যন্তরে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকা- সংঘটিত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে যা জঘন্যতম হত্যাকা- বলে বিবেচিত হয়। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধী শত্রু কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সকল সদস্যকে (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতীত) ধানম-ির ৩২নং বাড়িতে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যার পর দেশের জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর রাতের আঁধারে বন্দী থাকা অবস্থায়ই কারাভ্যন্তরে একটি কক্ষে সবাইকে একসঙ্গে এনে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যা জেলহত্যা নামে পরিচিত। নির্মম ও বর্বরোচিত এ হত্যাকা-ের ঘটনাটি এ কারাগারেই অনুষ্ঠিত হওয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ কারাগারে জাতীয় ৪ নেতা স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরপর থেকেই দিবসটিকে জাতি প্রতিবছর ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস বলে পালন করে আসছে। হত্যাকা-ের বিদগ্ধ স্মৃতি নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে এ কারাগারটি। এ কারাগারের ভেতরেই ব্রিটিশ আমলে সরকারের করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ে কংগ্রেস নেতা সত্যেন সেনসহ দুই কমিউনিস্ট নেতা আমরণ অনশন শুরু করে। তৎকালীন সরকারের নির্দেশে তাদের অনশন ভাঙ্গতে অনুরোধ করা হলেও তারা আমরণ অনশন বন্ধ করেননি। এরপর সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ নানা অত্যাচার শুরু করে। একপর্যায়ে এসব নেতাদের জোর করে নাক দিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করে। ফলে দম বন্ধ হয়ে মারা যান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এ তিন নেতা। এ কারাগারের আটক বন্দীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে ভারত থেকে ছুটে আসেন ভারত কংগ্রেসের অন্যতম নেতা চিত্ত রঞ্জন দাস। জানা গেছে, বাংলার প্রথম অগ্নিকন্যা হিসেবে খ্যাত ভাষা আন্দোলনের নেত্রী নাদিরা বেগমকে এই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল গেটে বিচার করতে পাকিস্তান সরকারের একজন বিচারপতি আসেন। বিচার চলাকালীন তিনি এ অন্যায় বিচারের প্রতিবাদ করলেও পাকিস্তানী বিচারপতি অন্যায়ভাবে তার শাস্তি নির্ধারণ করেন। এর প্রতিবাদে এ দেশের প্রথম অগ্নিকন্যা নাদিরা বেগম নিজের পায়ের জুতা খুলে বিচারকের মুখে ছুড়ে মারেন। এ রকম শত শত ইতিহাসের সাক্ষী এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। দেশ স্বাধীনের পর এ কারাগারেই দেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ইসলামীর নেতা রাজাকার, আলবদর, আল শামস, গ্রুপের নেতা কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী, সর্বশেষ দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ এ পর্যন্ত দ-প্রাপ্ত সব নেতাদের ফাঁসি এ কারাগরেই কার্যকর করা হয়। ৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী স্বীকৃত ও কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নেতা আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত জামায়াত ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম এ কারাগারে আটক অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জঙ্গী নেতা জাগ্রত মুসলিম বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানকেও এ কারাগারেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ কারাগারে আটকাবস্থায় যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীমেরও মৃত্যু ঘটে। মূলত নানা ইতিহাস আর স্মৃতি-বিস্মৃতি নিয়েই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি। সদ্য যা পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এর বাইরে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, মরহুম আব্দুর রাজ্জাক, ওবায়দুল কাদেরসহ বিএনপির সাবেক মন্ত্রী বা জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন ইসলামিক দলের এমন অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন যারা এ কারাগারেই বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। মূলত এ কারাগারটির অপর বৈশিষ্ট হচ্ছে অনেকটা নেতা তৈরির কারখানা। ইতিহাসের এ অন্যতম কারাগারটি দেখলেই যে কারো মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা। শাস্তি বা দুঃখ পাবার পাশাপাশি অনেক সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন বন্দীর এ কারাগারে থাকাবস্থায় নির্বাচন করে জয়ী হয়ে ফুলের মালা পরে আদালতের রায়ে নির্দোষ হয়ে বের হতেও দেখা গেছে। মূলত বাংলার সব ধরনের ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী হিসেবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সদ্য বন্দীশূন্য হওয়া পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের এ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এ কারাগারটি, যা চিরকালই থাকবে।
×