ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁধ ভেঙ্গে দাও ভাঙ্গো

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১ আগস্ট ২০১৬

বাঁধ ভেঙ্গে দাও ভাঙ্গো

কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গী নিহত হওয়ার পর যখন জানা যায়, গণধিক্কৃত এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের মোসাহেব পদলেহী ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গবর্নর মোনায়েম খানের নাতিও রয়েছে নিহত তালিকায়, তখন অনেককাল পর মোনায়েম খানের নাম উঠে এলো আলোচনায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই বাংলাদেশবিরোধী নরপিচাশ এখন বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু ষাটের দশকের রাজনীতিকসহ পেশাজীবী ও সাধারণ স্তরের মানুষ হাড়ে হাড়ে চেনে তাকে। মোনায়েম খাঁর সবচেয়ে বড় ভয় ছিল বঙ্গবন্ধুকে। নিজের গদি রক্ষা করার জন্য শুধু নয়, আইয়ুব খানের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হেন কোন অপকর্ম নেই, যা করেননি। পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকারকে পদানত করার জন্য মানুষটি ধিক্কৃত হয়ে আছেন। তার প্রতি বাংলার মানুষের ক্রোধ ছিল তীব্র। ছাত্র সমাজ আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর পতনের দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের সঙ্গে সঙ্গে তারও গদি উল্টে যায়। এরপর নির্বাসনে যান। কিন্তু একাত্তর সালে আবার সরব হয়ে ওঠেন। বাংলার দুর্জয় সন্তান মুক্তিযোদ্ধার হাতে নিজ বাসভবনে একাত্তরেই নিহত হন। তার একপুত্র খালেকুজ্জামান খান হুমায়ুনকে জিয়া জাতীয় সংসদের সদস্য পদও দিয়েছিলেন। আরেক পুত্র কামরুজ্জামান খান এখন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা। আরেক পুত্র সাইফুজ্জামান খানের পুত্র অবশেষে জঙ্গীবাদে দীক্ষিত হয়েছিলো। এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই মনে হবে। রক্তের টানে অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ডিএন-এর কারণে পরম্পরায় একই মানসিকতা ধারণ করতে পারে। তার নাতির সঙ্গে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। আর এই গোয়েন্দা সংস্থা যে পাকিস্তানের তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। মোনায়েম খান নিজেকে খাঁটি পাকিস্তানী মনে করতেন। পাকিস্তানী হিসেবেই তাকে মরতে হয়েছে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মোনায়েম খান ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। আইয়ুব খান ঠিকই চিনেছিলেন উকিল পেশার এই খানকে। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নরের পদে আসীন হয়ে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত টানা সাত বছরের বেশি বাঙালীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছেন। বাংলার মানুষের স্বাধিকার তথা ছয় দফা আন্দোলন দমনে আইয়ুব খানের প্রধান বরকন্দাজ ছিল এই মোনায়েম খান। মোনায়েম খানের কীর্তিকলাপ নিয়ে এখনও অনেক কাহিনী শোনা যায় সে সময়ের রাজনীতি ও পেশাজীবীদের কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এক শিক্ষককে বলেছিলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখার জন্য। তার জ্ঞানের বহর এতেই ফুটে ওঠেছিল। শোকাবহ আগস্ট মাসের শুরু আজ। এই দিনে বঙ্গবন্ধুর মুখ ভেসে ওঠে মুক্তিকামী বাঙালীর চোখে। আর এই সময়ে আলোচনায় মোনায়েম খানের নাম আসায় অনেক ঘটনা স্মৃতিতে নাড়া দেয়। স্মৃতি কেন হবে? এসবই তো বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসের অংশ বিশেষ। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তাদের বশংবদদের কাছে শেখ মুজিব ছিলেন সাক্ষাত জমদূত। একমাত্র তিনিই পারেন তাদের টুঁটি চেপে ধরতে। বাঙালী শোষিত হচ্ছে, বাঙালীর স্বাধিকার প্রয়োজনÑ এসবই সামনে দিয়ে এসেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা। আর এর মধ্যেই বিপদের আভাস পেয়েছিল জান্তারা। তাই মোনায়েম খান বঙ্গবন্ধুকে জেল জুলুম, হুলিয়ার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। একদিকে জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিব, সঙ্গে সঙ্গেই অন্য মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হতো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করার অভিপ্রায় আইয়ুব-মোনায়েমে সফল হয়নি। বরং তাদের দুজনেরই গদি উল্টে গিয়েছিল। চুয়ান্নর নির্বাচনে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় হারিয়ে যাওয়ার পথে থাকলেও আইয়ুব খান তা ধরে রেখেছিলেন। মুসলিম লীগ ভেঙে দু’টুকরো হয়। একটি কাউন্সিল ও অপরটি কনভেনশন মুসলিম লীগ নামধারণ করে। মোনায়েম খান আইয়ুবের সঙ্গেই ছিল মুসলিম লীগে। কিন্তু সত্তরের নির্বাচনে দুই মুসলিম লীগই ভোটে বিলুপ্ত হয়ে যায় পূর্ববঙ্গে। তবে পাকিস্তানে মুসলিম লীগ আজও রয়েছে এবং বর্তমানে ক্ষমতায়। অথচ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজধানী ঢাকা শহরেই। পাকিস্তানীরা সেই ঝান্ডা ধরে রেখেছে। আর বাঙালী তা একাত্তর সালেই মুছে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনকে বিষিয়ে দেয়ার জন্য নানা ধরনের পীড়নের আশ্রয় নিয়েছিল গবর্নর খান। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে আলোচনা করলে অনায়াসে মোনায়েম খানের নাম সামনে আসে। বঙ্গবন্ধুর অনেক বক্তৃতা ভাষণে মোনায়েম খানের কর্মকা-ের সমালোচনা যেমন আছে, তেমনি হুঁশিয়ারিও রয়েছে। মোনায়েমের কানে শেখ মুজিব নামটি প্রবিষ্ট হলেই সে ভীত হয়ে পড়তো। গবর্নর হিসেবে কানাকড়ি দামও দিতেন না শেখ মুজিব। ষাট দশকে শেখ মুজিব যখন দলকে সংগঠিত করার জন্য শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জে যেতেন, সেখানে সমাবেশ আয়োজনে বাধা দিত মোনায়েমের সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোনায়েম খান মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ‘এনএসএফ’ গঠন করে। এই সংগঠনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের ত্রাসের রাজত্ব চালু করেছিল। এরা বর্তমানকালের জঙ্গীদের পূর্বসূরি হিসেবে অনায়াসে নির্ধারিত হতে পারে। সংবাদপত্র দলনের কাজটিতে মোনায়েম খান ছিল সক্রিয়। এই লোকটি বাঙালী জাতির সর্বনাশের জন্য সবধরনের প্রচেষ্টাই চালিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। শোকের মাসের শুরুতে বিস্মৃত মোনায়েম খান আলোচনায় এসেছে তার ‘গুণধর’ নাতির কারণে। নাতি আকিফুজ্জামান জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বংশলতিকা সূত্রে। তার পিতৃব্য স্বাধীন বাংলাদেশেও একা হলেও মুসলিম লীগের ঝা-া ধরে রেখেছিল মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত। এই আকিফুরের কাছে বিদেশ থেকে অর্থ আসত জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। জঙ্গী হামলার পরিকল্পক শুধু নয়, সে ছিল বাস্তবায়কদেরও একজন। বনানী ওয়ারহাউসের পাশে এক রসহস্যময় বাড়িতে সে থাকত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, সে আড়াই মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় মোবাইল সেট রেখে গেছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে বাড়িতে কোন জনমানব পায়নি। বরং জানিয়েছে, বাড়িটি রহস্যময়। পুলিশ জেনেছে, সে বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করত। পাকিস্তানী কূটনীতিকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল কিনা, পুলিশ তা অনুসন্ধান করছে। বিদেশ থেকে তার নামে কিভাবে টাকা আসত, তার হদিস হয়ত মিলবে তদন্তে। এই টাকা জঙ্গী খাতে ব্যয় করত। নিজেও প্রশিক্ষণ নিয়েছে, মানুষ হত্যার কলাকৌশল রপ্ত করেছে। অপারেশনেও অংশ নিয়েছে; কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। মোনায়েমকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাকিস্তানী দালাল হিসেবে। আর ‘মরলে শহীদ’ নামক জঙ্গীমতাদর্শে বিশ্বাসী, মানুষ হত্যায় পারদর্শী তার নাতিকে প্রাণ দিতে হলো আরও জঙ্গীর সঙ্গে। দেখেছি, মোনায়েমকে ‘শহীদ মোনায়েম খান’ অভিহিত করে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুসলীম লীগের বিভিন্ন খ- স্মৃতিসভার আয়োজন করত। এরা সবাই ছিল পাকিস্তানপন্থী ও মনোভাবাপন্ন। ইতিহাসের নির্মমতাই বলি আর বাস্তবতাই বলি, রাজাকারের বংশে রাজাকারই জন্মায়, আলবদরের বংশে আলবদর। এমনটাই হচ্ছে দেখে আসছি। পাকিস্তানী মোনায়েমের বংশধর একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে, বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে প্রশিক্ষিত জঙ্গীতে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা মনে হয় না। বরং পরিণতি এমনটাই হতে পারে বলে সরলীকরণ করা যায়। মোনায়েম খানের উত্তরসূরিরা আর যাই হোক, গবর্নর যে হবে নাÑ সেটা নিশ্চিত এবং তা হয়ওনি। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার উৎখাতে তার জঙ্গীতে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক বলে প্রতীয়মান হতেই পারে। মোনায়েম খানের লাশ দাফন হয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে ও প্রহরায়। মুক্তিযোদ্ধারা লাশ উঠিয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারে আশঙ্কায় পাকিস্তানীরা পুলিশ প্রহরা বসিয়েছিল। তার জঙ্গী নাতির লাশও পরিবারের পক্ষ থেকে দাফন করা হয়েছে বনানীতে। ঘৃণার বিষবাষ্পে ওরা এমনিতে দাহ হয়ে গেছে দেশবাসীর কাছে। মোনায়েম খান তার শাসনকালেই কুখ্যাত হিসেবে পরিগণিত হয়। আওয়ামী লীগ নামক দলটির প্রতি তার বিদ্বেষ ছিল তীব্র। আর কমিউনিস্টরা ছিল তার কাছে বিষতুল্য। তাই নিষিদ্ধ ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। আইয়ুব-মোনায়েমরা কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের নাজেহাল শুধু নয়Ñ নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল, হুলিয়া সবই প্রয়োগ করেছে। ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষত জামায়াত, নেজামে ইসলামী নামক দলগুলো বিকশিত হতে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। এদের দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বাঙালীবিরোধী তৎপরতা চালানো হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠনÑ কোনকিছুই নিস্তার পায়নি আচকান মোড়ানো মোনায়েমের দুঃশাসনের হাত থেকে। পাকিস্তানী আমলাদের তিনি বেশ মান্যগণ্য করতেন। সেসব নিয়ে অনেক গল্পসল্প শোনা যেত। শোকের মাস আগস্টের শুরুর দিনটিতে মোনায়েম খানের প্রতি বাঙালীর ঘৃণা আবারও বর্ষিত হচ্ছে যেন। শোকের এই মাসে আরও একজনের নাম সামনে এসেছে। জঙ্গী হিসেবে নিহত জেহাদ রউফ অর্কের পিতামহ আবদুর রউফ ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষদিকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিএফআইয়ের (বর্তমানের ডিজিএফআই) প্রধান। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রউফ, কর্নেল মালেক প্রমুখ অফিসাররা চাকরিচ্যুত হন। আব্দুর রউফ ১৯৭৭ সালে অস্ত্র ব্যবসার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। নিউভিক্টর লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়েন। এই প্রতিষ্ঠান পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কাছে সেনাপ্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করত। বছর দশেক পর ১৯৮৮ সালে রউফের পুত্র তৌহিদ রউফ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেয়। তারই পুত্র সেজাদ রউফ ছিল পরিচালক। গত ফেব্রুয়ারি থেকে সেজাদ নিখোঁজ ছিল। তবে তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি চীন, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্রাদি আমদানি করে আসছে। র‌্যাবের কাছেও সরঞ্জামাদি সবরাহ করত। সেজাদ উচ্চশিক্ষিত এবং মার্কিন নাগরিক বলে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। অস্ত্র ব্যবসায়ী যখন জঙ্গীতে পরিণত হয়, তখন ধরে নেয়া যায়, জঙ্গীদের অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণও সে দিত। আজকের প্রজন্ম এই দুই তরুণের অপচয়ের বিপরীতে সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সব বাধা ভেঙ্গে এগিয়ে যাবে। আর রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইবেÑ ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও, বাঁধ ভেঙ্গে দাও, ভাঙ্গো।’ আমরা সেই তরুণদের অভিবাদন জানাবোই।
×