ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগস্ট যেন শোকের শ্রাবণধারা

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১ আগস্ট ২০১৬

আগস্ট যেন শোকের শ্রাবণধারা

আগস্ট এলেই বাঙালী-হৃদয়ে নেমে আসে শোকের আঁধার। গোটা মাসটিই যেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। আগস্ট এলেই শ্রাবণের এক অনিঃশেষ করুণধারা যেন ছুঁয়ে যায় বাঙালী-আত্মাকে। এ মাসের বেদনার্ত আর্তি কালকে ছাপিয়ে মহাকাল, সীমানার গ-ি পেরিয়ে গোটা বিশ্ব বিবেককে স্তম্ভিত করেছে! একদিকে বাংলাদেশ বিরোধী দেশী-বিদেশী ঘাতকচক্রের সুপরিকল্পিত মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ বা হত্যা-নকশা, অন্যদিকে ‘নিয়তি’ বা ‘ভাগ্য’ নির্ধারিত বিয়োগান্তক ঘটনা; সব মিলিয়ে আগস্ট যেন শোকের শ্রাবণধারা। আগস্ট মাসটির নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী-হৃদয় যন্ত্রণাদগ্ধ হয়, শোকে মুহ্যমান হয় বাঙালী-আত্মা। হৃদয়পটে ভেসে ওঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আরও হত্যা করা হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত। শুধু বাঙালী জাতির ইতিহাসে নয়, গোটা বিশ্ব ইতিহাস তন্নতন্ন করে খুঁজলেও এমন নজিরবিহীন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া কঠিন। আগস্টকে ঘাতকরা তাদের নিষ্ঠুর টার্গেটের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছে বার বার। ১৯৭৫ সালের এ মাসে যেমন বাঙালী হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তেমনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুড়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই দেশবিরোধী ঘাতকচক্র ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে ৬৩টি জেলায় সিরিজ ৫০০ বোমা হামলা চালিয়ে প্রিয় এই মাতৃভূমিকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিল। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের ৭ তারিখ (বাংলা ২২ শ্রাবণ) আমরা হারিয়েছিলাম বাঙালী জাতির আত্মছবি অঙ্কিত করার নিপুণ কারিগর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম সাম্য-দ্রোহ-প্রেমের কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানকে। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু দিন। মৌলবাদ, কুসংস্কার, নারীর বঞ্চনা আর সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষুরধার প্রথাবিরোধী লেখক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সশস্ত্র মৌলবাদী হামলার ক্ষত বুকে নিয়ে মরতে হয়েছিল। তাই এমন মৃত্যুকে মৃত্যু না বলে হত্যা বলাই শ্রেয়। ১৯৭১-এর ২০ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম কবি সিকান্দার আবু জাফরকে। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম গীতি কবি অতুল প্রসাদ সেনকে। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম বিপ্লবের প্রেরণা ক্ষুধিরাম বসুকে। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশের সুস্থধারার চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ এবং বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক ও চিত্রনির্দেশক মিশুক মুনিরকে আমরা হারিয়েছিলাম। আরও কত গুণীজনকে আমরা এ মাসে যে হারিয়েছি তা একটু গবেষণা করলে সহজেই বের হয়ে আসবে। আগস্টের মৃত্যুগুলো আমাদের অশ্রুসজল করে তোলে। এই আগস্ট মাসেই ওইসব বিখ্যাত বাঙালীর মৃত্যু ছিল যেন নিয়তি নির্ধারিত! ॥ দুই ॥ সহমর্মিতা প্রকাশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিবেশীর ওপর শোকের কালো আঁধার নেমে এলে কোন সুস্থ, বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ সুখ-সাগরে ভাসতে পারে না, উল্লাসে ফেটে পড়তে পারে না। বরং শোকসন্তপ্ত প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানো, শোকাহত প্রতিবেশীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে শোককে ভাগাভাগি করে নেয়াটাই মানবিকতা ও মনুষত্বের পরিচয়। এটাই আমাদের সামাজিক, মানবিক রীতি। এমনকি, চরম শত্রুর মহাবিপদের দিনে, মহাদুর্দিনে বা শোকের দিনে আমরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠি না। কোন শ্রেণিকক্ষ থেকে আমাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়নি। পরিবার-পরিবেশ-প্রতিবেশ আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে। এর ব্যত্যয় মানে সমাজ ও মানুষের প্রতি অস্বাভাবিক, অসুস্থ, বিকৃত আচরণ। খালেদা জিয়া পৃথিবীর একমাত্র নারী, যিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৯Ñ এই কয় বছরের মধ্যে পাঁচবার জন্মগ্রহণ করেছেন! তাকে হেয় বা ছোট করার জন্য এ তথ্যটি নয়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাগজপত্র এবং সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্টে সেই তথ্যগুলো উঠে এসেছে। আসুন খালেদা জিয়ার জন্মদিন সমাচার সম্পর্কে জানিÑ ১৯৮৪ সালে খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাক্ষাতকারে বলেছিলেন আমার তৃতীয় মেয়ে হচ্ছে খালেদা। খালেদার জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, একটি ঐতিহাসিক দিনে, যেদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস থেকে পাঠানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবনী ছাপা হয়। ওই জীবনীতে উল্লেখ করা হয়, খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্কশিট অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বিয়ের কাবিননামা অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট। ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরণী ফরমে খালেদা জিয়া উল্লেখ করেন যে, তার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট। খালেদা জিয়ার এতগুলো জন্মতারিখ ও সাল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় জন্মসাল বদলিয়েছেন বয়স কমানোর জন্য। বিয়ের কাবিনে জন্মসাল ও মাস বদলিয়েছেন বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি আইন সিদ্ধ করার জন্য। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল এবং তারিখ বদলিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোসহ কটাক্ষ হানার জন্য। যে মহামানবের কারণে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি, লাল-সবুজের পতাকা, ‘আমার সোনার বাংলা’, সেই মহামানবকে খাটো করতে, অপমান করতে যিনি প্রতিবছর ১৫ আগস্টে মিথ্যা জন্মদিনের পসরা সাজিয়ে বসেন, উল্লাসে মেতে ওঠেন তার প্রতি কোন সুস্থ, বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে তো ‘ঘৃণা’ ছাড়া ন্যূনতম করুণা দেখানোও সম্ভব নয়। তবু প্রতিবছর খালেদা জিয়ার সেই মিথ্যা জন্মদিনের মহোৎসবে দেখি কিছু পা-চাটা দালালের মুখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য থেকে শুরু করে রুচিহীন নেতা, বিকৃত যুবক আর কিছু তোষামোদকারীকে। লাখো শহীদের রক্তে কেনা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল যে মহান নেতার কারণে তাঁর মর্মন্তুদ প্রয়াণ দিবসে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা বা নেত্রী মিথ্যে জন্মোৎসব পালন করবেন, এটিও কি প্রিয় মাতৃভূমির জন্য ‘এলিজি’ নয়? লেখক : সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
×