ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অবিশ্বাসের শিকড় আমরা গেড়েছি গভীরে

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১ আগস্ট ২০১৬

অবিশ্বাসের শিকড় আমরা গেড়েছি গভীরে

সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। অধ্যাপক জাফর ইকবালের ‘বিক্ষিপ্ত ভাবনা’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পুরোটা পড়ে, শেষ প্যারাটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে গেল। এখন যখন লিখছি, তখনও মোটামুটি নিজের ভেতর একটা শামুকের শেলের ভেতর ঢুকে আছি। বর্তমান সময়ের জঙ্গীবাদ এবং তরুণ বয়সী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তার লেখা, যা বরাবরের মতোই সুন্দর। আমি শুধু তার লেখার শেষ প্যারাটা কোট করছি। ‘সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে বিকশিত করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হয়। ক্লাসরুমের বাইরে ছাত্রছাত্রীদের সময় দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটুকু যেন তাদের আনন্দময় একটা স্মৃতি হয়ে থাকে তার জন্য চেষ্টা করতে হয়। আমি প্রায় দুই যুগ থেকে এখানে এই কাজগুলো করে এসেছিলাম। গত বছর যখন আবিষ্কার করেছি যে, এখানে একজন ভাইস চ্যান্সেলর ছাত্রলীগের ছেলেদের দিয়ে শিক্ষকদের গায়ে হাত ওঠাতে পারেন এবং সবকিছু জেনে-শুনেও সরকার তা না দেখার ভান করে তাকে বহাল তবিয়তে রেখে দিতে পারে তখন আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমার মনে হয় সারাদেশে আমার মতো কতজন শিক্ষক উৎসাহ হারিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন, সরকার তার একটা জরিপ নিয়ে দেখতে পারে। না দেখার ভান করলেই সমস্যা চলে যায় না, সমস্যার সমাধান করতে হলে তার মুখোমুখি হতে হয়।’ (বিক্ষিপ্ত ভাবনা, ২৯ জুলাই ২০১৬) অধ্যাপক জাফর ইকবালকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন তিনি কী পরিমাণ এনার্জিসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে এই দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার মতো ইতিবাচক মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই মানুষটি যখন ছাপার অক্ষরে লেখেন ‘আমার মতো কতজন শিক্ষক উৎসাহ হারিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন’ তখন সেটা আর কাউকে না হোক, আমাকে তাড়িত করে। ‘গুটিয়ে নেয়ার’ অর্থ আমি জানি। আর তার মতো অসংখ্য মানুষ যদি নিজেকে গুটিয়ে নেন, তাহলে আর সমাজটার ভেতর কী থাকে, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি এবং আমি উনার লেখার সঙ্গে আরও দুটি লাইন যোগ করে দেই। এই লেখাটা পড়ার পর কিছু মানুষ এটা নিয়ে হৈ চৈ করবে এবং যারা কাজের ওই পরিবেশটি ফিরিয়ে দিতে পারতেন তারা এটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবেন না। তাদের প্রাইয়োরিটি ভিন্ন। কিন্তু কেন বাংলাদেশের মতো সুন্দর একটি দেশে এমন বিষয়গুলো ঘটবে? ॥ দুই ॥ গত সপ্তাহে ‘আমার দিন’ কলামে ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়’ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটির মূল বিষয় ছিল, বাংলাদেশের মানুষ সত্যও বিশ্বাস করে না, মিথ্যাও না। বাংলাদেশের মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে, যা সে শুনতে চায়। এর মূল কারণ হলো, সে নিজেকেই বিশ্বাস করে না। অন্যকে বিশ্বাস করার আগে, নিজেকে বিশ্বাস করতে হয়; কিংবা নিজেকে বিশ্বাস করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। লেখাটি পড়ে অসংখ্য মানুষ আমাকে বলেছেন, এটাই বর্তমানের বাংলাদেশ। আমরা সত্যকেও বিশ্বাস করি না; আমরা মিথ্যাকেও বিশ্বাস করি না। কেমন যেন সব কিছুতে আমাদের সন্দেহ ঢুকে গেছে। আমরা একটি সন্দেহপ্রবণ জাতিতে পরিণত হয়েছি। মানুষের যখন মানসিক অধঃপতন হয়, তখন মানুষ সন্দেহপ্রবণ হয়। সে নিজেকে যেমন বিশ্বাস করতে পারে না; আবার অন্যকেও বিশ্বাস করতে পারে না। একটি কনফিউজড নেশন। কল্যাণপুরে জঙ্গী হত্যার পর এই দেশের মানুষের কনফিউশন দূর করতে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন পুলিশের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম। আমি তার স্ট্যাটাস থেকে কিছু অংশ কোট করছিÑ ‘নাম-ঠিকানা না জেনে জঙ্গী বলছেন কিভাবে?’ ‘জঙ্গীরা এ রকম পাঞ্জাবি, কেডস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল কেন?’ ‘৪টি পিস্তল দিয়ে কিভাবে সারারাত মুহুর্মুহু গুলি চালানো সম্ভব?’ ‘কেন তাদের জীবিত ধরা গেল না?’ এ রকম অনেক যৌক্তিক প্রশ্ন কারও মনে আসতেই পারে। আমি যদি বলি আপনি বুঝে ও না বোঝার ভান করছেন আপনি খ-াবেন কি করে? সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে আলোচনা হচ্ছে যে প্রতিবশীরা বলছে, ওই বাসার লোকেরা সারারাতই কথিত জিহাদের সপক্ষে সেøাগান দিয়েছে, তাদের রুমে কথিত আইএসের পতাকা পাওয়া গিয়েছে, প্রচুর সংখ্যক উগ্রবাদী বইপুস্তক পাওয়া গেছে। তার পরও এরা জঙ্গী কিনা তা বোঝার জন্য কি রিসার্চের প্রয়োজন আছে? ... সারারাত মুহুর্মুহু গোলাগুলি হয়েছে এ রকম কোন তথ্য আমার জানা নাই। আমি যতটুকু জানি যখনই পুলিশ বাসাটিতে ঢুকতে চেষ্টা করেছে ততবারই গুলি চালানো হয়েছে। চূড়ান্ত অভিযান হয়েছে এক ঘণ্টার কাছাকাছি। ওই সময়েই মূলত চূড়ান্ত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আপনার বিশ্বাস এ তথ্য আপনার অজানা নয়। তাহলে কেন এ রকম প্রশ্ন তুলছেন? পুলিশের সাফল্য মানতে পারছেন না তাই তো! আপনি তো সবজান্তা অথচ আপনি এই ধরনের অপারেশনগুলোর ইতিহাস জানেন না। দেশে এবং দেশের বাইরে কোথায় এই ধরনের অপারেশনে কতজন জীবিত গ্রেফতার হয়েছে জানালে বাধিত হব। আসলে পুলিশের কেউ মারা যায়নি কিংবা কেউ গুরুতর আহত হয়নিÑ এতেই তো আপনার যত আপত্তি তাই না, বন্ধু!’ একজন পুলিশ অফিসার কতটা কষ্ট ও দুঃখ পেলে এমন একটি স্ট্যাটাস লিখতে পারেন তো বোধকরি অনেকেই বুঝতে পারছেন। একজন পুলিশ অফিসারের এই দেশেই তার জন্ম, এই মাটিতে তার বেড়ে ওঠা, এই দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ নিয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন, এবং জীবনের বাজি রেখে কঠিন কর্তব্যগুলো পালন করছেন। তারা যে কষ্টে দায়িত্ব পালন করেন, তা আমাদের অনেকেরই চিন্তা এবং কল্পনার বাইরে। আশা করি তার এই স্ট্যাটাসে অনেকেরই ভুল ভেঙ্গেছে। কিন্তু আমার ভয়, পুলিশের অসংখ্য অফিসার যদি অভিমানে নিজেদের গুটিয়ে নেন তা হলে এই দেশটার কী হবে! তার পরেও বাংলাদেশকে আমি যতটা চিনেছি, আমি বলতে পারি, অনেকে এত পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেয়ার পরেও বিষয়টি বিশ্বাস করবে না এবং সেই সংখ্যাটি যে খুব ছোট, তাও নয়। চায়ের আড্ডায় কিংবা নিজেদের ভেতর এটা নিয়ে নানান ধরনের থিওরি বের করবে। কেউ কি বলতে পারেন, কেন এমন হয়? কেন আমরা বিশ্বাস করতে পারি না? কেন আমরা সবকিছুতেই অবিশ্বাসের তীর ছুড়ে দেই? এই অবিশ্বাসের জন্য কি আমাদের দেশের মানুষকে সরাসরি দায়ী করা যাবে? ॥ তিন ॥ গত ২৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে স্বদেশ রায় ‘সঙ্গী হই সন্তানের’ শিরোনামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন। সেখানে তিনি বর্তমান সময়ের তরুণদের মনোজগত নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই লেখায় তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কিছু লিখেছেন, আমি তার থেকে কিছু অংশ কোট করছি - ‘এদের জন্য যে বহুত্বের জগত সৃষ্টির দায় শিক্ষামন্ত্রীর। সেটা তিনি বুঝছেন কিনা সন্দেহ আছে। বরং তিনি সব সময় সমস্ত জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেন। যেমন ২৪ তারিখ মাওলানাদের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বললেন, আমার মাদ্রাসার কোন ছাত্র জঙ্গী হয়নি। শোলাকিয়া ও হলি আর্টিজানের ঘটনায় উচ্চবিত্তদের এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্তানরা জড়িত, মাদ্রাসার কোন ছাত্র নয়। এর থেকে বোঝা যায় তিনি হলি আর্টিজানের ঘটনার নিউজগুলোই পড়েননি। সেখানে মূল নেতৃত্ব দিল বগুড়ার যে ছেলেটি সে যে মাদ্রাসার ছাত্র এটা তিনি জানেন না। অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির কম্বিনেশনের মতো জঙ্গীতেও যে উচ্চবিত্ত ও মাদ্রাসার ছাত্রদের একটি কম্বিনেশন হয়েছে এটা শিক্ষামন্ত্রী জানেন না। তাই এ মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত মানুষকে বলছেনÑ তা সম্পর্কে দেশের শিক্ষামন্ত্রী যদি এভাবে অজ্ঞ থাকেন তাহলে কীভাবে রাষ্ট্র সন্তানদের মনোজগত পরিবর্তন করতে সহায়ক হবে?’ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী তাহলে সত্যি কথাটি বলছেন না। কিন্তু পুরো মিডিয়া তার এই অসত্য ভাষণ প্রচার করছে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের ফলাফল নিয়ে এতদিন ধরে যেগুলো বলেছেন, সেগুলো কি সত্য ছিল? নকল এবং জিপিএ ফাইভ নিয়ে তিনি দেশকে যে নসিহত করেছেন সেগুলো কি সত্য ছিল? দেশের মানুষের কথা বাদই দিলাম, ছাত্রছাত্রী কিংবা অভিভাবকরা কি তাকে বিশ্বাস করেন, তার কথাকে বিশ্বাস করেন? এখানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একটি বক্তব্য কোট করছি- ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হচ্ছে চোর-বাটপার। ওই সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় অনেকেই আমার সমালোচনা করেছেন। তবে আমি জেনে-শুনে চোরদের পক্ষ নিয়েছি, যাতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। ওইসব মহাচোরকে শনাক্ত করে উৎখাত করা হবে এবং ছোট চোরদের সংশোধন করা হবে।’ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতী শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক ও পুরস্কার এবং বিশিষ্ট গবেষকদের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী, বুধবার, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৪) এই ছোট একটি কথাই কি বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে ধরে না? পুরো দেশের শিক্ষার্থীরা কি বোকা? তারা কি এগুলো দেখছে না? যেই দেশের শিক্ষামন্ত্রীকে অসত্যের মুখোমুখি হতে হয়, চোরদের সঙ্গে থাকতে হয়, সেই দেশের ছাত্রছাত্রীরা যদি কাউকে অবিশ্বাস করে তাতে তাদের দোষ দেয়া যাবে? গত ২৮ জুলাই ২০১৬ তারিখে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেড আয়োজিত বাল্ক ম্যানুফেকচারিং ফ্যাসিলিটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এমন ভ্যাকসিন তৈরি করুন যেন মাতৃগর্ভেই কোন জঙ্গী আর বেড়ে উঠতে না পারে।’ এমন একটি বক্তৃতা জাতীয় প্রচারমাধ্যমে ঘটা করে সম্প্রচার করার পর তরুণ শিক্ষিত শ্রোতাদের মনে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, তা কি আমরা জানি? কিংবা কখনও জানার চেষ্টা করেছি? রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা বর্তমান সময়ের মানুষ কতটা বিশ্বাস করে? কেউ কি একটু ঠা-া মাথায় হানিফ সাহেব কিংবা কামরুল সাহেবের বক্তৃতা শুনেছেন? সেগুলো সাধারণ মানুষ কিভাবে নেয় সেটা বিশ্লেষণ করেছেন? এটা শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বেলায় নয়। দেখুন তো কতকাল ধরে এই দেশের তরুণরা এরশাদ এবং রওশন এরশাদকে দেখে আসছে? তাদের কি এই প্রজন্মের তরুণরা বিশ্বাস করে? তাদের বক্তৃতা, তাদের কথা কিংবা তাদের নীতিমালা? এবার যদি বিএনপির দিকে তাকান- জঙ্গীদের নিয়ে হান্নান শাহ কিংবা গয়েশ্বর রায় বা এদের আশপাশের নেতাদের যে বক্তৃতা নিত্যদিন মানুষ শুনছে, তরুণরা কি এগুলো বিশ্বাস করে? আমি আবারও লিখছি, কিছু মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে, মিছিল করে। কিন্তু শিক্ষিত তরুণরা কি বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে? তারা কি মনে করে এই রাজনীতিবিদরা নিত্যদিন যা বলছেন, তা সত্য বলছেন? আমার মনে হয় করে না। তরুণরা রাজনীতিবিমুখ এবং তারা রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। সমাজবিজ্ঞানীরা একটি জরিপ চালিয়ে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন (যদি সেই জরিপের ফল আবার মানুষ বিশ্বাস করে!)। ॥ চার ॥ সম্প্রতি মিতু হত্যার ওপর একটি সংবাদের ক্লিপ দেই। ‘পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু আক্তার হত্যার মিশনে অংশ নেয়া দুজন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছে। এরা হলো নবী ওরফে নূরুন্নবী ও মোঃ নূরুল ইসলাম রাশেদ ওরফে ভাগিনা রাশেদ। ৫ জুলাই ভোর সাড়ে তিনটার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রানীরহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (দক্ষিণ) মোঃ কামরুজ্জামান মিডিয়াকে বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া মুছা, রাশেদ, নবীসহ কয়েকজন রানীরহাট এলাকায় অবস্থান করছিল। গোপন সূত্রে এই সংবাদ পেয়ে আমরা অভিযানে যাই। আমরা যখন তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি তখন তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকি। এক পর্যায়ে তারা পিছু হটে। পরে ঘটনাস্থল থেকে দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।’ এই ধরনের সংবাদ খবরের কাগজ, অনলাইন কিংবা টিভিতে দেখার পর মানুষ কী মনে করে? কেউ কি একবার জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই সংবাদটি বিশ্বাস করে কি না? আমার ধারণা, এটা কেউ বিশ্বাস করে না। এটা একটা বানানো গল্প, যা জাতিকে বছরের পর বছর ধরে শোনানো হচ্ছে। কত বছর ধরে এই গল্প শুনছে মানুষ? প্রায় ১৫ বছর ধরে। যে ছেলেটির সেদিন জন্ম হয়েছিল, তার বয়স এখন পনেরো। যে ছেলেটি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ত, সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরতাজা তরুণ। এই একটা প্রজন্ম কি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে বড় হয়নি? আমরা কি পুরো একটা জেনারেশনকে মিথ্যা বলা এবং চর্চা শিখাইনি? কেউ কি একটি বারের জন্য চিন্তা করেছেন, এভাবে প্রতিনিয়ত মিথ্যা তথ্য গণমাধ্যমগুলোয় প্রচারিত হতে থাকলে জাতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী কোন নেতিবাচক প্রভাব আছে কি না? এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শিশুরা কি এটাই শিখল না যে, হত্যা করে মিথ্যা বলা যায় এবং সেটা দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে। এতে সাময়িক লাভ হয়েছে দেশের, কিছু সন্ত্রাসীকে নির্মূল করা গেছে। কিন্তু আমরা যেভাবে এটাকে প্রচার করেছি, তাতে পুলিশের ওপর মানুষের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সাহায্য করছে। আমি নিশ্চিত, পুলিশের ভেতর পাবলিক সাইকোলজি নিয়ে কেউ কেউ কাজ করেন। তারা এটাকে আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কোন দায়িত্বশীল অফিসার চাইবে না, তাদের বিভাগের কোন দুর্নাম হোক। তারা সব সময় চাইবে, তাদের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস থাকুক। কিন্তু বিশ্বাস তো আর জোর করে আদায় করা যায় না। অবিশ্বাসের শিকড় আমরা কতটা গভীরে গেড়ে দিয়েছি, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? ॥ পাঁচ ॥ আমরা এবার অন্যান্য পেশার দিকে তাকাই যার ভেতর দিয়ে শিশু-কিশোর এবং তরুণরা বেড়ে উঠছে। প্রথমেই আসি শিক্ষায়। স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা কি তাদের শিক্ষকদের বিশ্বাস করে? শিক্ষকরা যা বলেন, তা কি তারা বাস্তবে দেখতে পায়? যদি না পায়, তখন সেই শিক্ষার্থী কী মনে করে? সে কি তার শিক্ষককে মনে মনে মিথ্যাবাদী ভাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেভাবে বিভিন্ন দলে বিভক্ত, মূল কাজ শিক্ষকতা রেখে তারা যেভাবে দলের কর্মকা-, কনসালটেন্সি, টিভি টকশোতে গিয়ে মিথ্যা যুক্তি প্রদান এবং নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তার প্রভাব কি শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ে না? নাকি শিক্ষার্থীরা কিছুই বোঝে না? তাদের কিছু বিষয় মুখস্থ করিয়ে দিলেই তারা সুনাগরিক হয়ে গেল? একজন শিক্ষার্থী কি দেখে না তার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে, কী তার যোগ্যতা, কোন্ লবির বলে তিনি আরেকজন যোগ্য শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে উপাচার্য হয়েছেন? এগুলো দেখার পর, সেই শিক্ষার্থী যদি কোন রকমে পাস করেই এই মিথ্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়, তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যাবে? শিক্ষকতার মতো আরেকটি মহৎ পেশা হলো চিকিৎসা। বাংলাদেশে যখনই কোন ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখেন কিংবা কোন কিছু টেস্ট করাতে বলেন, একজন রোগী কি সেটাকে বিশ্বাস করেন? নাকি মনে মনে ভাবেন, এত টেস্ট দিল ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন খাওয়ার জন্য? এত ওষুধ লিখল শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য? মানুষ যে এগুলো ভাবে, সেটা ডাক্তাররাও জানেন। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। যে ডাক্তারকে তার রোগী বিশ্বাস করেন না, সেই ডাক্তারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন হয়! একজন তরুণ যখন দেখতে পায়, বিনা কারণে তার বাবা-মায়ের ভুল চিকিৎসা করানো হয়েছে, কিংবা টেস্ট করতে দেয়া হয়েছে, তখন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের ভেতরে কী মানসিক চিন্তার খেলা খেলে কেউ কি দেখেছেন? শিক্ষকতা আর চিকিৎসকের মতো আরেকটি মহান পেশা হলো সাংবাদিকতা। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একজন সিএনজি স্কুটার চালক সাংবাদিককে ‘সাংঘাতিক’ বলে। সমাজের অন্য স্তরের মানুষও নিশ্চয়ই তাই ভাবেন। বাংলাদেশের পত্রিকা, টিভি চ্যানেল এমনকি অনলাইন প্রকাশনাগুলো তারা কি বিভিন্ন পক্ষ নিয়ে রিপোর্টিং করে না? তারা কি নিরপেক্ষভাবে কাজ করে? একটু ছোট সার্ভে করলেই বুঝতে পারা যাবে, কোন্ পত্রিকাকে মানুষ কিভাবে দেখে! টেলিভিশনের টকশোতে যারা আসেন, তাদের কি মানুষ বিশ্বাস করেন? নাকি মানুষ এটাকে এক ধরনের বিনোদন হিসেবে নিয়েছে? সমাজের একটি বড় অংশ হয়ত মিডিয়ার এই মারপ্যাঁচ বুঝতে পারে না। কিন্তু তরুণ সমাজ? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? সবশেষে বলি লেখকদের কথা, যাদের কিছু প্রভাব হয়ত জনমনে থাকে। লেখকরা কি বাংলাদেশে সত্যি কথাটা লেখেন? লেখকদের একটি বড় অংশ সুবিধাভোগী। তারা সরকারের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নেয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে বসে থাকেন। তাই তাদের কলম দিয়ে আর সাহাসী কথা বের হয় না। আরেক দল লেখক আছেন, যারা প্রতিনিয়ত মানুষকে স্বপ্ন দেখান এবং সবাই বলে থাকেন, লেখকদের কাজই হলো মানুষকে স্বপ্ন দেখানো। কিন্তু আমি বলি, অবশ্যই স্বপ্ন দেখানো একটি ভাল কাজ, কিন্তু যেই স্বপ্নটার কাছাকাছিও একজন মানুষ আসতে পারবে না, সেই স্বপ্ন তাকে হতাশ করে। সে তার লেখককে মিথ্যাবাদী দেখতে শেখে। আপনি একজনকে স্বপ্ন দেখালেন, কিছু দিনের মধ্যেই সে বিল গেটস হয়ে যেতে পারে; কিন্তু যখন সে রাস্তায় নামল বিল গেটস তো অনেক দূরে, সে ১০০ ডলারও আয় করতে পারছে না। তখন সেই তরুণটি আমাদের সম্পর্কে কী ভাবতে থাকে? বাংলাদেশের মানুষ ওভার কমিট করতে পছন্দ করে। আর যারা শুনতে চায়, তারাও ‘ওভার কমিটমেন্ট’ বিষয়টা শুনতে চায়। তারা দেখতে চায়, এক বছরেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে, তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ সিলিকন ভ্যালি হয়ে যাবে। তাই আমাদের বক্তারাও সেটা বলে দিয়ে মানুষকে উৎসাহিত করে। তারপর যখন রাস্তায় নেমে দেখে, কাজটা অনেক কঠিন, তখন হয় স্বপ্নভঙ্গ। আর স্বপ্নভঙ্গের অপর নাম মিথ্যা, অবিশ্বাস। বাংলাদেশের মানুষের অসংখ্যবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে এবং হচ্ছে। তারা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তারা বুঝতে শেখেছে, এই দেশে বাঁচতে গেলে মিথ্যা দিয়েই বাঁচতে হবে। মিথ্যা ছাড়া উপায় নেই। ॥ ছয় ॥ আমি বাংলাদেশে কিছুদিন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলাম। বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েদের ইমোশন বোঝার জন্যই এটা করা। তারা কিভাবে চিন্তা করে, কিভাবে তাদের দিন কাটে, তাদের ব্রেনে কি চলে- এই সব আরকি। একদিন আমি রিক্সায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানম-ি ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। ট্রাফিক জ্যামে রিক্সা আটকে আছে। পাশের রিক্সায় একটি ছেলে মোবাইল ফোনে চিৎকার করে কথা বলছে, ‘দোস্ত, আমি এখন মিরপুরে। মাত্র বাসা থেকে নামলাম। গুলিস্তান যাব। তুই কলাবাগান থাক। আমি গুলিস্তান থাইক্যা ফেরার সময় তোরে দেইখ্যা আসবনে।’ আমি ছেলেটির দিকে তাকালাম। সে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেই যাচ্ছে। চারদিকে যেহেতু ট্রাফিকের শব্দ, তাই তাকে অনেক চিৎকার করেই কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু বিপদ বাধল, একটু পরে দেখি সে আমার ক্লাসেই বসে আছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ধানম-িতে রিক্সায় বসে কেন বললে তুমি মিরপুর? তুমি ধানম-ি বললে কী হতো? ছেলেটি এমনভাবে একটি হাসি দিল যার অর্থ হলো আমি ভিনদেশ থেকে এসেছি। মৃদু হাসতে হাসতে বলল, স্যার, তাহলে তো ও এখনই ক্যাম্পাসে চলে আসবে। আমি তো এখন ওর সঙ্গে যাব না। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যেতে না চাইলে ও কি তোমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে? ছেলেটি কোন উত্তর দিল না। আমি বাকিদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা সবাই কি এভাবে মিথ্যা বল? সবাই একযোগে বলল, স্যার, ছোটখাটো ঝামেলা এড়ানোর জন্য তো প্রতিদিন মিথ্যা বলতেই হয়। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ক্লাসে এমন একজন কেউ আছে যাকে ক্লাসের অন্যরা বিশ্বাস করে? কেউ কারও নাম বলল না। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। অকারণেই এরা মিথ্যা বলতে শিখেছে, নিজেদের ভেতর অবিশ্বাস তৈরি করে রেখেছে এবং খুব বড় কোন ঝামেলা নয়, ছোটখাটো ঝামেলা এড়াতেই মিথ্যা বলছে। এই মিথ্যা বলা শিখল কোথা থেকে? ছোটবেলায় তো আমরা পড়িয়েছি, সদা সত্য কথা বলিব। তাহলে সেই শিক্ষা গেল কোথায়? বাংলাদেশে বাঁচতে গেলে প্রতিনিয়ত মিথ্যা শুনতে হয় এবং বলতে হয়। মানুষ সত্য-মিথ্যাকে গুলিয়ে ফেলেছে। তাই তারা এখন সত্যকেও বিশ্বাস করে না, মিথ্যাকেও পার্থক্য করতে পারে না। সব সময় একটি কনফিউজড স্টেটে থাকে। আর মিথ্যা মানেই হলো অবিশ্বাস। বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষ কাউকেই বিশ্বাস করে না। এটাই বাস্তবতা। বিশ্বাস না হলে সার্ভে করিয়ে দেখতে পারেন। ॥ সাত ॥ বাংলাদেশে মিথ্যা এবং অবিশ্বাসের শিকড় যেভাবে গভীরে গেড়ে দিয়েছি, ঠিক তার বিপরীতে সামাজিক আন্দোলনকে দেশ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। একটা সময়ে বাংলাদেশে খুব সুন্দর সামাজিক কর্মকা- ছিল। প্রায় প্রত্যেক পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল, খেলার মাঠ ছিল, বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতা হতো। এগুলো দেশজুড়েই হতো। ঈদের সময় সবাই মিলে ঈদ করা, আর পূজার সময় ম-পে ম-পে গিয়ে প্রসাদ খাওয়া ছিল এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের মেলা। কিন্তু কোন একটি গোষ্ঠী এগুলোকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে দীর্ঘমেয়াদী কাজ করে সফল হয়ে গেছে। একটি দেশে রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে গেলে তখন সবকিছুতেই তার ছোঁয়া লাগে। দেশের মানুষের ভেতর শান্তি এবং বিশ্বাসের যে ছায়া ছিল, তার স্থান করে নিয়েছে উগ্রবাদ। এখন শুধু শাহ্ আব্দুল করিম-এর ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটির কিছু কথা চরম সত্যি হয়ে আমাদের মাঝে ধরা দিয়েছে, যা তিনি অনেক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন, আমরা পাইনি। তার কথায়- ‘করি ভাবনা সেই দিন আর পাব নাহ ছিল বাসনা সুখী হইতাম॥ দিন হতে দিন আসে যে কঠিন করিম দীনহীন কোন্ পথে যাইতাম আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’... এই দেশকে যদি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের অন্যান্য সুন্দর দেশের মতো তৈরি করতে হয়, তাহলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলোÑ মানুষের ভেতর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার প্রথম ধাপ হলো সত্য কথা বলার চর্চা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থান থেকে নিচু স্থান পর্যন্ত বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারলে, এই দেশে কখনই ভাল মানুষরা থাকবে না। আর যারা থাকবে, তারা ‘গুটিয়ে’ থাকবে এবং এই প্রক্রিয়া নিচ থেকে হয় না, এটা হতে হবে ওপর থেকে। যদি সেটা করা না যায়, তাহলে নিজেদের গুটিয়ে নেয়াটাই হবে সম্মানজনক জীবন। ২৯ জুলাই ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×