ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সহপাঠী হোক ভালো বন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১ আগস্ট ২০১৬

সহপাঠী হোক ভালো বন্ধু

টুটুলকে কয়েকদিন ক্লাসে না দেখে একটু উদ্বিগ্ন হলো রাসেল। সাধারণত এমন তো হয় না। ও ক্লাস ফাঁকি দেয় কম। ফোন করবে কি করবে না একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। ক্লাস শেষে ফোন দিতেই ধরে টুটুলের মা। তার সঙ্গে এই প্রথম কথা হচ্ছে। তিনি জানানÑ টুটুলের প্রচ- মাথাব্যথা আর একটু জ্বর জ্বর ভাব। ফোনেও কথা বলতে পারছে না। ভাবল ক’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে এ আর এমন কী। এভাবে বেশ ক’দিন চলে গেল। টুটুলের দেখা নেই। সামনে পরীক্ষা এখন নিয়মিত ক্লাস করা জরুরী। শ্রেণীবন্ধুর সম্পর্ক ছাপিয়ে ওর জন্য কেন যেন একটু বেশি টান অনুভব করে রাসেল। কয়েকদিন ক্লাস ও ক্যাম্পাসে না দেখে আবার ফোন দেয় টুটুলের নম্বরে। এবারও ওর মা ফোন ধরেন। মা একটু কান্নাজড়িত কণ্ঠে যা জানালেন তাতে রাসেল থ-মেরে গেল। এমন মেধাবী, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা টুটুলের কিনা ব্রেন টিউমার হলো! অপারেশন জরুরী। মুহূর্তে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল ক্লাসে অন্যান্য সহপাঠীদের মধ্যে। এখন কী করা যায়? টুটুল না বললেও রাসেল আগেই বুঝতে পেরেছিল ওদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। ব্রেন টিউমারের অপারেশন বেশ ব্যয়বহুল। অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করল কিছু একটা করতেই হবে। সহপাঠীরা কেউ তো আর চাকরি করে না। সবাই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বড় ভাইদের সঙ্গেও করল আলোচনা। শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে গঠন করা হলো একটি কমিটি। সবাই ওর সাহায্যার্থে তুলবে চাঁদা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হলো। প্রেসক্রিপশনের কপি নিয়ে সম্ভাব্য দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে ছুটল দলবেঁধে। জনসমাগমস্থলে ‘যার যা সামর্থ্য’ এমন আবেদন জানানো হলো। মোটামুটি ভাল ফল পাওয়া গেল এতে। ঘটনাÑ২ জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটির মাস্টার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রীতি মনমরা হয়ে বসে আছে মহিলা কমনরুমের এক কোণার বেঞ্চে। ক্লাসে গেল না। ক্লাস শেষ করে এসে শিপ্রা ওকে এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে কাছে এল। একটু অবাকও হলো। চুপচাপ স্বভাবের ভাল ছাত্রী হিসেবে পরিচিত প্রীতি তো ক্লাস ফাঁকি দেয়ার মেয়ে নয়। হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপারেও ওর নেই কোন আগ্রহ। শিপ্রার সঙ্গেই টুকিটাকি কিছু কথা শেয়ার করে। উপজেলা পর্যায়ে প্রীতিদের বাড়ি। দূর থেকে যাতায়াত ব্যয়বহুল ও ঝক্কির। জেলা শহরে মেসে থাকে। বাবা গত বছর থেকে অসুস্থ, শয্যাশায়ী। সংসারে বেশ টানাপোড়েন। অন্য ভাইবোনেরাও লেখাপড়া করছে। দুবছর আগে বিয়ে হয়েছে এক বোনের। নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের যাতনা বোঝাবে কাকে? অনার্স করার পর বেশ কয়েকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির দরখাস্ত করলেও সোনার হরিণ আর ধরা দেয়নি। কয়েকটি টিউশনি করে মেস ও শিক্ষার খরচ চালাচ্ছিল। নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিউশনি কমে যায়। মার্চ এপ্রিলে হয় টানাটানি। মেসের টাকা বাকি পড়েছে এরপর আবার সেশন ফি জমা দেয়ার নোটিস হয়েছে জারি। মাথায় এখন অর্থচাপ। কোথা থেকে জোগাড় হবে টাকা? লোন করার অভ্যাসও নেই। বিষণœ হয়ে ভাবছিল অনেক কিছু। মন সায় দিচ্ছিল না ক্লাসে যেতে। বার বার বাবার অসুস্থ মুখ উঠছে ভেসে। অনেকটা জোর করেই জানতে চাইল শিপ্রাÑ ‘কী এমন ঘটেছে যে তুই ক্লাসে গেলি না?’ কোন উত্তর না দিয়ে তেমনি চুপচাপ বসে থাকে প্রীতি। পরের ঘণ্টায় ক্লাস নেই। ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের এক কোণায়। জোরাজুরির পর বিস্তারিত জানতে পেরে শিপ্রার মনটাও কিছুটা বিষণœ হয়ে ওঠল। ছুটি হয়ে গেল। শিপ্রা চলে গেল ওদের সরকারী কোয়ার্টারে। বাবার সরকারী চাকরি। জেলা শহরে বড় পদেই চাকরি করেন তিনি। প্রীতি চলে যায় মেসে। পরদিন ক্যাম্পাসে দেখা হতেই শিপ্রা প্রীতিকে বলল, তোর বেতনবইটা কইরে? প্রীতি জবাব দিল মেসে। শিপ্রা বলল, ছুটি শেষে তোর মেস দেখতে যাব। সঙ্গে সঙ্গে ওর বাবাকে ফোন করে বলে দিল, বাবা আজকে আমি আর আইফোন কিনব না। আগামী মাসে কিনি?... শিক্ষাজীবনে দিন, সপ্তাহ, মাস বছর এমনকি জীবনের একটি বড় সময় কাটে সহপাঠীদের সঙ্গে। একই গুরুর শিষ্য বা সতীর্থ হয়ে একই লক্ষ্যের যাত্রী হতে হয় এ সময়। এ লক্ষ্য হলো জীবনের মূলমন্ত্রÑ শিক্ষা। যাদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে হৃদয়ঙ্গম করতে হয় শিক্ষা, তারা কি শুধু সহপাঠী নামের শব্দবন্ধের মধ্যেই থাকে সীমিত? এর উত্তর হবে নিশ্চয়ই না। আরও অধিক কিছু দাবি করে সহপাঠীর কাছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তো আশা করাই যায় সেই সঙ্গে স্বজন ভাবাটাও আবশ্যক। সহপাঠী কারও কারও ক্ষেত্রে শিক্ষার স্তরভেদে অধ্যয়নের শেষ দিবসটি পর্যন্ত স্থায়িত্ব হয়। এই যে একজন অপরিচিত শিশু, কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী পরিচিত হয়ে দিনের পর দিন শিক্ষাজীবন যাপন করে তাদের মধ্যে যদি শুধু সহপাঠী নামক সংকীর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে; তা একজন সাক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও মেনে নিতে চাইবে না। এ সম্পর্ক হতে হবে এক কথায় মানবিক। একজনের বৈধ, সৎ প্রয়োজনে অন্যজন আসবে এগিয়ে। বিপদ-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে বলতে হবেÑ ভয় কী, এই তো পাশে তোমার স্বজনের হাত। গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক দর্শনের বহুমত বহুপথের সারথি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেটাকে মেনে এগিয়ে চলাটাই সভ্য নাগরিক ও শিক্ষার্থীর পরিচায়ক। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যারা সিনিয়র, জুনিয়র, ইয়ার বা ক্লাসমেটের হৃদয়, শরীর রক্তাক্ত এমনকি জীবন পর্যন্ত সংহার করে বসে শুধু ভ্রান্ত রাজনৈতিক দর্শনের বশবর্তী হয়ে; তারা আর যা-ই হোক স্বজন তো দূরের কথা তাদের সতীর্থ ভাবাটাও বোধকরি সঠিক নয়। তবে এক্ষেত্রে একটু বাছবিচার সবাই আশা করেÑ সম্পর্ক হোক তার সঙ্গে যার হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের আপসহীন চেতনার বসবাস। তারাই হোক সহপাঠী, বন্ধু কিংবা তারও অধিক স্বজন। যাপিত ডেস্ক
×