ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ কানাগলিতে প্রমিত বাংলা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৩১ জুলাই ২০১৬

একুশ শতক ॥ কানাগলিতে প্রমিত বাংলা

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মূল ভিত্তি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। ধর্ম-গোত্র-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশ বাংলা ভাষারই রাষ্ট্র; বাঙালীর রাষ্ট্র। এটি মনে করার কোন কারণ নেই যে, আমরা রাগ করে পাকিস্তান ভেঙ্গেছি। মূলত আমরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় রূপান্তর করেছি। এই আধুনিক জাতীয়তাবাদী ধারণা এই অঞ্চলে বিরল। ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু কিছু দেশে এই জাতীয়তার উদ্ভব ঘটলেও আমাদের এই অঞ্চলে তেমন কোন দৃষ্টান্ত নেই। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে মূলত দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ করলেও ভারত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। তাদের পক্ষে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়াও সম্ভব নয়। তারা বহুধর্মী ও বহুভাষী। পাকিস্তানও বহুভাষার রাষ্ট্র। সেজন্য তারা ধর্মকে জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে বেছে নেয়। আমাদের দেশে কিছু উপজাতি থাকলেও তারা এখন প্রায় বাংলা ভাষাভাষী হয়ে গেছে। দেশের ৯৯.৯ ভাগ মানুষও বস্তুত বাংলা ভাষাভাষী। আমাদের এই ভাষারাষ্ট্র গঠনের কাজটি খুব সহজ ছিল না। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু করে ৫২, ৬২, ৫৫, ৬৯-এর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ধরে ’৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করি। এই রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে আর কোন ভাষাকে এই রাষ্ট্রে ব্যবহার করার বৈধতা দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার জন্য কোন শর্তও নেই। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারী অফিস আদালতে বাংলা প্রচলন করেন। বাংলা লেখার যন্ত্র অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার দিয়ে শুরু করা বাংলাকে আমরা ডিজিটাল যুগে পৌঁছে দিয়েছি। এখন দুনিয়ার এমন কোন ডিজিটাল যন্ত্র নেই যাতে আমরা বাংলা লিখতে পারি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরেও ডিজিটাল যন্ত্রে এর প্রমিতকরণকে প্রয়োগ করতে পারিনি। আমরা ৯২ সাল থেকে শুরু করে বছরের পর বছর চেষ্টা করে মোবাইল সেটের জন্য বাংলা ভাষার একটি কীবোর্ড প্রমিত করলেও সেটি না প্রয়োগ করতে পেরেছি, না সেটি নিয়ে কেউ কোথাও মাথা ঘামায়। দেশে কোটি কোটি মোবাইল সেট আসে; কিন্তু সরকারের প্রমিত কীবোর্ড কেউ ব্যবহার করে না। অন্যদিকে ৯২ সাল থেকেই বাংলা হরফমালার একটি প্রমিত মান তৈরি করার চেষ্টা করে বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ নামক একটি মান তৈরি করলেও সরকারী কোন অফিসে সেটি প্রয়োগ করা যায়নি। এটি প্রয়োগ করার কোন মাথাব্যথাও কারও নেই। বরং এই মানটি অনুসরণ করার জন্য হাতে পায়ে ধরলেও কেউ সেটি কানে তোলে না। যারা মানটি প্রণয়ন করেন তাদের যেমন আগ্রহ নেই তেমনি আগ্রহ নেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েরও। এই বিষয়ে কারও কোন সচেতনতা নেই। সম্প্রতি আমরা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৫০ হাজার ল্যাপটপ কেনার দরপত্রে বিজয় ও অভ্রকে উল্লেখ না করে বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ উল্লেখ করার অনুরোধ করলেও সেটি তারা করেননি। যারা এই মান প্রণয়ন করেন সেই কম্পিউটার কাউন্সিলের প্রতিনিধি নাকি এই বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাননি। আমি মোটেই বুঝতে পারছি না যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল কি বাংলা ভাষার একটি প্রমিত মানকে গুরুত্ব দেন না নাকি তারা এর গুরুত্ব বোঝেন না? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলার ব্যবহার বাড়িয়েছে। কিন্তু কাজের পদ্ধতি ডিজিটাল করার নামে সরকারী ব্যাংক ও অফিস আদালতসহ সকল স্তরে বাংলাকে বিদায় করে ইংরেজীকে গুরুত্ব দিচ্ছে। বেসরকারী অফিসের ভাষা একতরফাভাবে ইংরেজী। উচ্চশিক্ষা বা উচ্চ আদালতের ভাষা ইংরেজী এবং এখন ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা গৌরবের বিষয়। এসব বিষয়ে সরকারের কোন ধরনের আগ্রহ আছে তেমনটি মোটেই লক্ষ্য করি না। বাংলাদেশের বৃহত্তম ডাটাবেজ ভোটার তালিকা বা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করার সময়ও জাতীয় মানকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি যে নির্বাচন কমিশন এই ডাটাবেজ তৈরি করে তারা তখনকার মানটিকে পাশ কাটিয়ে যায়। তারা ডাটাবেজের জন্য একটি ফন্ট বানায় যার নাম ছিল নিকস। সেই নিকস ফন্টটি কেবল যে জাতীয় মানের বাইরের তাই নয় সেটির অসংখ্য ত্রুটি রয়েছে। আমরা এখানে নিকস ফন্টের কিছু ত্রুটি তুলে ধরতে পারি। স্মরণে রাখা যেতে পারে যে, নিরাপত্তার কথা বলে নির্বাচন কমিশন নিকস ফন্ট তৈরি করেছিল যখন শত শত ইউনিকোড ফন্ট বাজারে ছিল। তখন তারা বলেছিলেন ভোটার তালিকার নকল রোধে এমন ফন্ট বানানো হচ্ছে যা বাজারে নেই। কিন্তু পরে তারা সেটি বাজারে ছেড়েছে তো বটেই পুরোই উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে এখন ভোটার পরিচয়পত্র নকল করার জন্য টাইপিস্ট দোকানে নিকস ফন্ট পাওয়া যায়। জাতীয় মানের বদলে ইউনিকোডকে ধারণ করা যেমনি সংবিধানের লঙ্ঘন ছিল তেমনি করে অন্যের মেধাস্বত্ব চুরি করাটাও নির্বাচন কমিশনের বড় অপরাধ ছিল। দুঃখজনক বিষয় এটি যে, নির্বাচন কমিশনের সেই ফন্টকে ব্যবহার করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে জবরদস্তি এই ফন্টকে ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়। সম্প্রতি আমি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই ফন্ট ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতার জটিলতার খবর পেলাম। তারা প্রথমত ইউনিকোড ব্যহারের জটিলতা নিয়ে ‘বিপন্ন’। অন্যদিকে নিকস ফন্টের ত্রুটিতে অসহায়। আসুন একবার চোখ বুলিয়ে দেখি নিকস ফন্টটির কি কি ত্রুটি রয়েছে। নিকস ফন্টে অনেক ক্ষেত্রে লেখা বোল্ড করা হলেও বোল্ড দেখায় না এবং বোল্ড লেখাকে নরমাল ফন্টে আনলে তা নরমাল হয় না। বিশেষত এ সমস্যা বেশি পরিলক্ষিত হয় যখন অন্য ইউনিকোড ফন্টে লেখা টেক্সট ‘নিকস’ ফন্টে নেয়া হয়। এই ত্রুটির মূল কারণ হচ্ছে যারা নিকস ফন্ট তৈরি করেছিলেন তারা ফন্টপ্রযুক্তিই বোঝেননি। বস্তুত, প্রতিটি ফন্টেরই স্বাভাবিক, বোল্ড, ইটালিক ও বোল্ড ইটালিক ফন্ট আলাদাভাবে তৈরি করলে বোল্ড, ইটালিক ও বোল্ড ইটালিক করা যায়। নিকস ফন্টের সেইসব স্টাইল তৈরি করা হয়নি। যুক্তাক্ষরসহ বাংলা ভাষায় ব্যবহƒত চিরাচরিত লিখিত রূপ ‘নিকস’-এর লেখায় দেখা যায় না। উদাহরণ : ‘বঙ্গ’ শব্দটি নিকস-এ এরূপে দেখা যায় না। সেটি ঙ এবং গ যুক্ত হয়ে একটি যুক্তাক্ষর গড়ে ওঠে। এরকমভাবে ‘রূপান্তর’ শব্দটি নিকস-এ ‘রুপান্তর’ দেখায়; অথচ º গ্ধ ন্দ ন্ধ ইত্যাদি বর্ণের ক্ষেত্রে প্রচলিত রূপ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি জটিল অবস্থা। দেশের বই-পত্র-পত্রিকার ব্যবহƒত রূপটি ব্যবহার না করায় এটি বিভ্রান্তি তৈরি করে। এছাড়াও স্বরচিহ্নগুলোর চিরায়ত রূপ এই ফন্টে নেই। যেমন রু রূ, দ্রু, দ্রƒ গু, শু, প্রু, গ্রু ইত্যাদি এভাবে দেখায় না। নিকস ফন্টে ‘য’ ফলা যোগ করতে সমস্যা হয়। ‘য’ ফলা যথাযথভাবে যোগ হয় না। যেমন ‘র‌্যাব’ লিখতে গিয়ে দেখা যায় ‘র্যাব’। ‘নিকস’ ফন্টে তৈরি ডকুমেন্টকে ফাইলে রূপান্তর করলে তা পাঠযোগ্য থাকে না। ডকুমেন্ট জুড়ে চতুষ্কোণ সব চিহ্ন দ্বারা ‘এ’ কার’ ‘ও’ কার বা যুক্তাক্ষরগুলো প্রদর্শিত হয়। আমরা আগেই বলেছি যে, নিকস বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ মান অনুসরণ করে না। ফলে নিকস বাংলাদেশের প্রমিত মান মেনে চলে না। নিকস-এর ডাটা জাতীয় ই-আর্কিটেকচারে ব্যবহার করতে হলে তাকে কনভার্ট করতে হবে। এটি একটি শ্রমসাধ্য ও জটিল কাজ হবে। এখনই বিডিএস ১৫২০ : ২০১১ কম্পাটিবল ফন্ট ব্যবহার করা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। নিকস ফন্টের টাইপোগ্রাফি বা ডিজাইন মুদ্রণ মানের নয়। কম্পিউটারের বাংলা ফন্টের মুদ্রণ মান সুতন্বী এম জে। যে কোন বই বা পত্রিকা সুতন্বী ব্যবহার করে বা তার মতো অন্য কোন ফন্ট ব্যবহার করে। ফলে কাগজে ছাপা হলে বা ইন্টারনেটে ব্যবহƒত হলে নিকস তার নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে পারে না। বিশেষ করে মুদ্রণ করার সময় তাকে ফন্টে কনভার্ট করে প্রিন্ট করতে হয়। এটি বস্তুত ডিজাইন ত্রুটি। দুনিয়ার সকল ভাষায় ফন্ট বিশেষ এক ধরনের সৃজনশীল শিল্পী ডিজাইন করে থাকেন। চারুকলায় সেটি পাঠ্য থাকে। কিন্তু নিকস ফন্ট তেমন কেউ ডিজাইন করেননি বলে এর নান্দনিক রূপ নেই। নিকস ফন্টের কারিগরি ত্রুটিও আছে। নিকস ফন্টে বাংলায় ব্যবহৃত হয় এমন শব্দ নেই আবার ব্যবহৃত হয় না তেমন শব্দ রয়েছে। ফন্টটিতে হিন্দী ভাষার মতো নোকতাসম্পন্ন অনেক বর্ণ আছে যা বাংলায় ব্যবহƒত হয় না। এসব বর্ণের কোন ইনপুট মেথড নেই। যাহোক আমার বড় আশঙ্কাটি হচ্ছে এখন প্রমিত নয় এমন মানে যে ডাটা আমরা ডিজিটাল করছি তাকে প্রমিত মানে নিতে যে বিশাল আয়োজন, সময় ও অর্থ ব্যয় এবং বিড়ম্বনা হবে তার দায়টা কার? বস্তুত এখনই সময় একদিকে প্রমিত বাংলা এনকোডিং-এর মান মেনে নিকসকে আপডেট করা বা যে ফন্ট প্রমিত মান অনুযায়ী তৈরি সেটি ব্যবহার করা। আমরা সুতন্বী ও এম জে নামে একটি প্রমিত মানের ফন্ট বাজারে ছেড়েছি বহু আগে থেকে। সেটি ব্যবহার করে আপাতত প্রমিত মানে নতুন ডাটা তৈরি করা যায়। অন্যদিকে একটি কনভার্টার তৈরি করে প্রমিত মানে নেই এমন ডাটাকে প্রমিত মানে আনা যায়। একই সঙ্গে মাইক্রোসফটকে তাদের অপারেটিং সিস্টেমকে বাংলা প্রমিত মান অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করা যায়। আমরা লক্ষ্য করেছি এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে লাখ লাখ কপি উইন্ডোজ বিক্রি করলেও তাদের অপারেটিং সিস্টেমকে বাংলা ভাষার সঙ্গে বা তার প্রমিতকরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করেনি। তাদের নতুন অফিস বাংলা ফন্টকে সমর্থন না করলেও সেটি তারা বাজারজাত করছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে আমি সবিনয়ে অনুরোধ করছি বাংলা ডাটাকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে কানাগলিতে নেবেন না। আর দেরি করা মোটেও সমীচীন হবে না। ঢাকা, ২৯ জুলাই, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×