ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

মেলের ক্যাফে ॥ ওয়েল্যান্ড

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৩১ জুলাই ২০১৬

মেলের ক্যাফে ॥ ওয়েল্যান্ড

(গতকালের পর) তিনি ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে ব্যাটারির মুখ দুটো পরীক্ষা করার পর গাড়ির সামনের এক্সেলে শিকল বেঁধে গাড়িটিকে ট্রেলারে তুলে নিয়ে গেলেন। কর্মশালা থেকে আমাকে ফোন করে বলা হলো, আমার গাড়ির অল্টারনেটারটি বদলাতে হবে এবং তা তারা ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে পারবেন। আমি ঘণ্টা তিনেক পর ওখানে যেতেই একজন তরুণ কর্মী বেরিয়ে এসে আমাকে চাবিটি দিয়ে বললেন, তোমার গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। তোমাকে দিতে হবে ৪৫০ ডলার। এখন দেয়া সম্ভব না হলে পরে পাঠিয়ে দিলেও চলবে। আমি ইঞ্জিনে চাবি ঘুরিয়ে চালু করার সাথে সাথে টের পেলাম যে আমার গাড়ির অল্টারনেটরটি চমৎকারভাবে লাগিয়ে দিয়েছে সে। কর্মের প্রতি নিষ্ঠা, সততার সাথে কথা বা ঠিকা অনুযায়ী কাজ করা এবং সবচাইতে বড় কথা গ্রাহকদের কল্যাণে ব্যবসায়িক মূলনীতি হিসেবে নিজকে নিয়োজিত রাখা যুক্তরাষ্ট্রের এই এলাকার সাধারণ মানুষের মূল্যবোধে নিহিত। এসব মূল্যবোধের উপকরণ আমাদের দেশে এখনও পূর্ণভাবে আহরণ করতে আমরা সক্ষম হইনি। মেলের ক্যাফেতে বসে দিনের পর দিন এ সব তরুণ কর্মীদের সময়ান্তরিক কফি খাওয়া এবং আলাপচারিতা লক্ষ্য করে ও শুনে সমাজ গড়ার পথে প্রতিনিয়ত সৎ কৃত্যক প্রযুক্ত করার অনুকূলতম পরিবেশ সংরক্ষণে ব্রতী থাকা যে কোন উৎপাদনশীল অর্থনীতির সচলতার দ্যোতক বলে আমার কাছে মনে হয়। তেমনি মনে হয় আমাদের দেশের পেশাজীবীদের সমিতি বা প্রতিষ্ঠানসমূহ যদি নিজেদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা আদায় করার চেষ্টার সাথে সাথে সমাজকে তাদের তরফ থেকে দেয় পেশাগত সেবার মান উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেন, তাহলে হাল আমলের প্রধানত: ব্যক্তি-উদ্যমভিত্তিক সমাজ আমরা অধিকতর উৎপাদনশীল অবয়বে সংরক্ষণ ও বিস্তৃত করতে সমর্থ হব। এসব অনুকরণীয় মূল্যবোধের বাইরে এই মেলের ক্যাফে বসেই আমি আমাদের দেশের কিংবা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন সমাজের কতিপয় ব্যত্যয় সম্পর্কে অভিজ্ঞান লাভ করেছি। এখানে দেখেছি অতিমাত্রায় বুড়ো বয়সে জনগণের মানবিক আশ্রয় বা সেবা যতœ পাওয়ার সাংস্কৃতিক বা সামাজিকভাবে গ্রহণীয় তেমন কোন সুযোগ নেই। এই ক্যাফেতে যাওয়ার পথে হঠাৎ একদিন চোখে এল টমসন নামে এক ব্যক্তির সকল সম্পদ নিলামে তুলে দেয়ার বিজ্ঞপ্তি টানিয়েছে কাউন্টি প্রশাসন। কথায় কথায় জানতে পারলাম এক নিঃসঙ্গ বুড়ো তার নির্জন ঘরে মারা যাওয়ার প্রায় ৫ দিন পর টের পেয়েছে কাউন্টি পুলিশ। স্বজনদের অনুপস্থিতিতেই তারা মৃতদেহ দাফন করেছে। ছেলে-মেয়ে বা কোন উত্তরাধিকারীর খবর না পেয়েই বুড়োর ঘরে পাওয়া কাগজপত্রে জানা গেছে যে, তার ২৫ বছরের একমাত্র ছেলে ছাড়া অন্য কোন স্বজন নেই এবং ঐ ছেলেরও কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল বুড়োর অজানা। গেল বড়দিনে ছেলের পক্ষ থেকে পাঠানো ঠিকানাবিহীন একটি কার্ড পাওয়া গেছে বুড়োর শয়নকক্ষে। কোন স্বজন বা উত্তরাধিকারীর বৃত্তান্ত একমাস ধরে বহু চেষ্টার পর না পাওয়ার কারণে কাউন্টি প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুড়োর ঘর-বাড়ি এবং সেখানে রক্ষিত সম্পদাদি জন সম্মুখে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিক্রি লব্ধ অর্থ কাউন্টি প্রশাসন সংরক্ষণ করবেন ৭ বছর পর্যন্ত। এর মধ্যে যদি তার কোন বৈধ উত্তরাধিকারী এসে তার পরিচিতি এবং দাবি উত্থাপন করেন তা হলে বিক্রয়ে প্রাপ্ত অর্থ সম্পদ তাকে দিয়ে দেয়া হবে। প্রশাসনিক দৃষ্টি থেকে প্রক্রিয়াটি নির্ভেজাল। তথাপিও এর বিধিত অনুসরণে সুস্পষ্ট হয়েছে যে এই বুড়ো শেষ জীবনে নিঃসঙ্গ-দুঃখী ছিলেন এবং পারিবারিক মায়া মমতা যতœ তার স্বজন বা উত্তরসূরিদের তরফ থেকে তার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময়ে তার ভাগ্যে জুটেনি। ব্যক্তি স্বাধীনতাভিত্তিক সদাচঞ্চল এরূপ সমাজ সম্ভবত আমরা আমাদের এই নিম্নমধ্য আয়ের দেশে স্বাধীন সত্ত্বায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে আশা কিংবা ইপ্সিত মনে করি না। দ্বিতীয়, এই ক্যাফেতে বসে আরেক ঘটনা সম্পর্কে জেনে আমি হতবাক হয়ে যাই। প্রৌঢ় বয়সের এক গৃহহীন পুরুষ ঐ কচিচুয়েট হ্রদের পারে তার একমাত্র সঙ্গী আদরের কুকুরটি নিয়ে এই গ্রীষ্মে দিন কাটাতেন। উচ্ছিষ্ট হিসেবে যা পেতেন তাই প্রিয় কুকুরটির সাথে ভাগ করে খেতেন, পলিথিন মোড়া আচ্ছাদনের নিচে রাতে থাকতেন। মাস দুয়েকের মধ্যে স্থানীয় পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির কর্মীরা আইন অনুযায়ী কুকুরটির জীবনের ক্লেশ নিবারণের লক্ষ্যে তার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে উন্নততর জীবন যাপনের সুযোগ দেয়ার জন্য কুকুর পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যান। আমি জানতে চেয়ে জানতে পারলাম যে আইনের আওতায় এ ক্ষেত্রে কুকুরের ক্লেশ নিবারণের জন্যে গৃহহীন প্রৌঢ়ের কাছ থেকে কুকুরটিকে জোর করে নেয়া হয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করার দর্শন অনুযায়ী কুকুরের মালিকের ক্লেশ নিবারণের জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মনে হয় এ সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রত্যয় মানুষের ক্লেশ নিবারণকে পশুর ক্লেশ নিবারণ প্রচেষ্টার নিচে ফেলে রেখেছে। আরও এক ঘটনার কথাও বলি। ওয়েল্যান্ড থেকে আন্তঃরাজ্য মহাসড়ক ৯০ ধরে বস্টনে ঢোকার পথে সড়ক নিয়ন্ত্রণ বাতির সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম এক সুশ্রী ও ২৫ বছর বয়সী তরুণী, প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আমাকে সহায়তা করতে পারেন। দেখলাম দু’একজন গাড়ি থেকে নেমে তার হাতে ৫ বা ১০ ডলার গুঁজে দিচ্ছেন। তরুণী হেসে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়া কারও কাছ থেকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইনী বাঁধনের বাইরে এভাবে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিপরীতে তেমন কোন তিরস্কারমূলক অনুশাসন দেয়া আমার নজরে কিংবা শ্রুতিতে এলো না। মেলের ক্যাফেতে ব্যক্তি স্বাধীনতাভিত্তিক কর্মচঞ্চল, উদ্যমী ও পরিশ্রমী অসাম্প্রদায়িক সমাজের বিমূর্ত রূপ আমাকে আকর্ষিত করে। কিন্তু তার মোজেইকে এই ধরনের সাংস্কৃৃতিক বা সামাজিক ব্যত্যয় সম্ভবত আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আবার প্রগতিশীল রক্ষণশীলতার প্রয়োজন তুলে ধরে। এই সমাজে সমকামী বিয়ে ও মাদকাসক্তির অনুকূলে সহনশীলতা কি চলিষ্ণুতা বা বলিষ্ঠতার পরিচয় বহন করে? আমি ভাবি, অবাক হয়ে ভাবি এবং ভাবতে ভাবতে নিজের কথাই বলি : আমাদের সমাজ থেকে এদেরও শিক্ষণীয় উপকরণ আছে। (সমাপ্ত) লেখক : রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা ও মন্ত্রী
×