ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

ভাইরাস উৎপাটনের এখনই সময়

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৩১ জুলাই ২০১৬

ভাইরাস উৎপাটনের এখনই সময়

গুলশান থেকে কল্যাণপুর, ঢাকা মহানগরীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত দুটি এলাকায় ২৬ দিনের ব্যবধানে সংঘটিত দুটি ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি উপলব্ধি করার জন্য শুধু দেশের ভেতরে নয়, সারাবিশ্বের মিডিয়া ও মানুষের দৃষ্টি পড়েছে ওই দুই ঘটনায় ও বাংলাদেশের ওপর। ২৫ জুলাই মধ্য রাতের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের একটা দল কল্যাণপুরের ছয়তলাবিশিষ্ট একটা ভবনকে ঘিরে ফেলে। ভবনের পাঁচ তলার একটা ফ্ল্যাটে অস্ত্রশস্ত্রসহ আগে থেকেই অবস্থান করছিল এক দল জঙ্গী। ২৬ জুলাই সকাল হওয়ার পর পরই পুলিশের বিশেষ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। উভয়পক্ষের গোলাগুলির ভেতরে ফ্ল্যাটে অবস্থান নেয়া জঙ্গীদের ৯ জন নিহত এবং একজন গুলিবিদ্ধ ও আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পুলিশের স্টর্ম-২৬ অভিযান। শুরু থেকেই সব প্রকার মিডিয়ার ব্যাপক উপস্থিতি এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর চলতি বিবরণীর ফলে দেশের মানুষ তো বটে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে মানুষ সব ঘটনাটি ধারাবাহিকভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছে। অভিযানের সফল সমাপ্তির ফলে সকল শান্তিকামী মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে, অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে ভালো কাজ করলে, মানুষের নিরাপত্তা বিধানে সক্ষম হলে জঙ্গী দমনের প্রচেষ্টায় সমগ্র জনগণ পুলিশকে সমর্থন করবে, সঙ্গে থাকবে এবং অভিনন্দন জানাবে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সঙ্কীর্ণ স্বার্থের কারণে ভিন্ন আচরণ করলেও সামগ্রিকভাবে মানুষ ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের সঙ্গে এবং শুভশক্তির পক্ষে আছে এবং থাকবে। এই সফল অপারেশনের পর মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে পুলিশের সকল সদস্যকে উপলব্ধি করতে হবে, ভাল কাজ করলে তারা জনগণকে সঙ্গে পাবেন। এ রকম সাফল্য অথবা পরিবেশ যদি পুলিশ বাহিনী তাদের মাঠ পর্যায়ের সকল স্তরে সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে জঙ্গীরা পালাবার জায়গা পাবে না। দেশ ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকার এবং সততাই কেবল পুলিশের মর্যাদার আসনে বসাতে পারে। মানুষ সবকিছু দেখে, জানে, বোঝে কিন্তু বহুবিধ বিরূপ কারণে সব সময়ে সব জায়গায় তা প্রকাশ করে না, করতে পারে না। এই সুযোগটা নিয়ে যারা অপকর্ম করেন, তাদের মানুষ ভাল করে চেনে। সময়-সুযোগ পেলে মানুষ সব অপকর্মের জবাব দিয়ে দেয়। অপারেশন স্টর্ম-২৬, জঙ্গী দমনে এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল অপারেশন। অন্তত জঙ্গী দমেনে পুলিশের এই আন্তরিকতার প্রতিফলন সর্বত্র ও সারাদেশে পড়বে, এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে এবং মনে করে এটা সম্ভব। অপারেশনে পুলিশের মাত্র একজন সদস্য আহত হয়েছেন। আশপাশের পুরোটাই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়া সত্ত্বে¡ও যতটুকুই জানা গেছে তাতে সাধারণ নাগরিকদের হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। সফল অপারেশনের ফলে পুলিশ বাহিনীর আত্মবিশ্বাস বাড়বে, পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে জঙ্গী দমনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচেষ্টার সঙ্গে জনসম্পৃৃক্ততা বাড়বে। এমন একটা সফল জঙ্গীবিরোধী অপারেশন সম্পর্কে সারাদেশের মানুষ যখন প্রশংসা করছেন, তখন ২৬ জুলাই বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতা যে রকম নেতিবাচক কথা বলেছেন এবং এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বৃথা চেষ্টা করেছেন, তাতে তারা নিজেরাই নিজেদের নিচে নামিয়েছেন। বোঝা যায় রাজনৈতিক অন্ধত্বই তাদের এমন মন্তব্য প্রদানে প্ররোচিত করেছে। এ রকম অন্ধ রাজনৈতিক নেতারা যত নিচে নামবে, রাষ্ট্র ও দেশের মানুষ ততই উপরে উঠবে। সুতরাং এটা নিয়ে আক্ষেপ করার কিছু নেই, ওদিকে নজর দেয়ারও প্রয়োজন নেই। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গুলশান অপারেশনের মাধ্যমে জঙ্গীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের একটা টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছাতে চেয়েছিল বলে মনে হয়। কিন্তু তাদের জন্য সেটি হিতে বিপরীত হওয়ায় তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইছে। উত্তরা, রাজশাহী ও কল্যাণপুরসহ আরও দু’-একটি জায়গায় প্রস্তুতি পর্বেই তারা তল্পিতল্পাসহ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। ধরেই নিতে হবে তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। সুতরাং আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই, বরং তাদের প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় তার সবকিছু আরও জোড়ালোভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্তের ফলে জঙ্গীদের শেকড় আপাতত অদূর ভবিষ্যতে সহজে উৎখাত করা যাচ্ছে না। সঙ্গত কারণেই জঙ্গীদের উৎপত্তি, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও জঙ্গীয়ায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। ৯ জন মরেছে তো আরও ১০ জন নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। আগামীতে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে জঙ্গীরা মাঠে নামার চেষ্টা করবে, এটাই ধরে নিতে হবে। তাই রক্তক্ষরণ ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে, ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে তা দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজ পক্ষের দুর্বলতা এবং সক্ষমতার মূল্যায়ন। এই প্রসঙ্গে মিডিয়ায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দু’-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর এখন আলোকপাত করছি। সপ্তাহ দুই আগে দেশের প্রায় সব পত্রিকায় যে খবরটি বিভিন্নভাবে এসেছে তা খুবই উদ্বেগজনক ও জঙ্গী দমনের পক্ষে অন্যতম প্রধান অন্তরায় এবং দুর্বলতা বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। সব প্রতিবেদনের সারাংশে দেখা যায়, ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়া জেএমবি প্রধান মাওলানা সাঈদুর রহমানসহ জঙ্গী নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী ও হিযবুত তাহ্রীর নেতা মহিউদ্দিনের মামলার বিচার শুরুর অনুমোদনের জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে। কিন্তু দুই বছরে জবাব আসেনি। এত সংবেদনশীল, অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলা, যার সঙ্গে রাষ্ট্রের ও জনগণের নিরাপত্তার ইস্যু সরাসরি জড়িত, তা ওই মন্ত্রণালয়ের ডজনের ওপর অফিসার সকলে দুই বছর যাবত ভুলে গিয়েছিলেন, এমন কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? একই সময়ে একই সঙ্গে জঙ্গী সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত, অভিযোগপত্র, প্রসিকিউশন, সাক্ষ্য হাজিরার বিষয়ে সীমাহীন অবহেলা, উপেক্ষা, গাফিলতি, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা ও ভয়ানক সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া প্রায় দেড় হাজার জঙ্গীর মধ্যে ৫০০ জন বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার জামিনে বের হয়ে আবার জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। জেলখানা থেকে জঙ্গী নেতারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ও ছদ্মবেশে আসা জঙ্গীদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময় কিভাবে জঙ্গী তৎপরতার নির্দেশনা দিচ্ছে তার একটা ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে ২৬ জুলাই একটা দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে বসে এসব করছে কারা, এদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও পরিচয় বের করা একান্ত প্রয়োজন। এটা কি শুধুই অনৈতিকতার প্রভাবে হচ্ছে, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছদ্মবেশী বিভীষণরা নীরবে বসে সুপরিকল্পিতভাবে করছে। সব বিবেচনায়ই এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর খবর। বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়নের সময় পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনার প্রাক্কালে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ছদ্মবেশে কোন্ চরিত্রের ও ব্যাকগ্রাউন্ডের চাটুকারদের হাতে ছিল তা মনে রাখা প্রয়োজন। এই জঙ্গীদের প্রধান ও এক নম্বর টার্গেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার, এ কথা দেশ-বিদেশের কে না জানে। ঘরের মধ্যে বিভীষণসহ দেশ-বিদেশের সীমাহীন প্রতিকূলতাকে ঠেলে শেখ হাসিনা আজ দেশটাকে যেখানে এনেছেন, তার সবকিছু জঙ্গী ও তাদের মেন্টর এবং গডফাদাররা উল্টে দিতে চায়, এটা বাংলাদেশের একটি শিশুও আজ বোঝে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরে তো অনেক সরকার ও সরকারপ্রধান বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। তাই দেশ ও দেশের বাইরের বুদ্ধিজীবী এবং বিশ্লেষকগণ বলছেন, বাংলাদেশের এই সঙ্কট থেকে তুলে আনার একমাত্র ভরসা শেখ হাসিনা, পারলে কেবল তিনিই পারবেন। তাই আমাদের জেনারেশনের মানুষ, যারা পঁচাত্তর দেখেছেন, তাদের সঙ্গে দেখা হলেই নানা রকম শঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের ভাবনার মধ্যে অনেক যৌক্তিকতা, বাস্তবতা আছে। এসব পরিণত মানুষের মতামত হলো- ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে যে ভূত ঢুকেছে, বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতী মন্ত্রীদের যারা আনুকূল্য পেয়েছেন, জামায়াত যাদের প্রশাসনে ঢুকিয়েছে, তারা এখন ভাইরাস হয়ে সর্বত্র বিরাজমান, এদের মূল উৎপাটন না করতে পারলে জঙ্গীদের কবল থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। এরা ভেতরে বসে সবকিছু ভ-ুুল করে দেবে। গুলশান ঘটনার পর বিশ্বের সব ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান আন্তরিক এবং নিঃশর্তভাবে বর্তমান সরকার ও শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশের সর্বত্র, সবশ্রেণী পেশার মানুষ জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে গণজাগরণ। বিশাল জনমত গড়ে উঠেছে। মিডিয়া জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সরব এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এই সময়ে রাষ্ট্র্রযন্ত্রের ভেতরে লুকিয়ে থাকা জঙ্গী মতাদর্শধারী ক্ষমতাবানদের মুখোশ উন্মোচন করা হলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দেবে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের সফল সেক্টর থেকে দূষিত ভাইরাস উৎপাটনের এখনই উপযুক্ত সময়। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×